হাদীসের নামে জালিয়াতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিষয়ক জাল হাদীস ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

আমাদের দেশে প্রচলিত ধারণা, রাসূলুল্লাহ আদম সৃষ্টির পূর্বে তারকারূপে বিদ্যমান ছিলেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন ভাষ্য প্রচলিত। যেমন, রাসূলুল্লাহ ফাতেমাকে (রা) বলেন, জিবরাঈল তোমার ছোট চাচা ...। এ বিষয়ে প্রচলিত সকল কথাই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। আমাদের দেশের সুপ্রসিদ্ধ একটি ইসলামী কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত একটি খুতবার বইয়ে লেখা হয়েছে:

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ  قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ: إِنَّهُ سَأَلَ جِبْرَائِيْلَ فَقَالَ: يَا جِبْرَائِيْلُ، كَمْ عُمِّرْتَ مِنَ السِّنِيْنَ؟ فَقَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ، لَسْتُ أَعْلَمُ غَيْرَ أَنَّ فِيْ الْحِجَابِ الرَّابِعِ نَجْماً يَطَّلِعُ فِيْ كُلِّ سَبْعِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ مَرَّةً، رَأَيْتُهُ اثْنَيْنِ وَسَبْعِيْنَ أَلْفَ مَرَّةً. فَقَالَ: يَا جِبْرَائِيْلُ، وَعِزَّةِ رَبِّيْ جَلَّ جَلاَلُهُ، أَنَا ذَلِكَ الْكَوْكَبُ. رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ.

উপরের কথাগুলোর অনুবাদে উক্ত পুস্তকে বলা হয়েছে: ‘‘হযরত আবূ হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, হযরত রাসূলে কারীম () হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে জিব্রাঈল, আপনার বয়স কত? তিনি উত্তর দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি এ সম্পর্কে কিছু জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি যে, চতুর্থ পর্দায় (আসমানে) একটি সিতারা আছে যা প্রতি ৭০ হাজার বছর পর সেখানে উদিত হয়। আমি উহা এ যাবত ৭০ হাজার বার[1] উদিত হতে দেখেছি। এতদশ্রবণে হুজুর () বল্লেন, হে জিব্রাঈল, শপথ মহান আল্লাহর ইজ্জতের, আমি সেই সিতারা। (বুখারী শরীফ)।’’[2]

এ সকল কথা সবই ভিত্তিহীন মিথ্যা কথা যা হাদীস নামে প্রচলিত।[3] তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এ ভিত্তিহীন কথাটিকে বুখারী শরীফের বরাত দিয়ে চালানো হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, সীরাহ হালাবিয়া গ্রন্থের লেখক একজন অজ্ঞাতনামা লেখকের উপর নির্ভর করে এ জাল হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু আমরা কি একটু যাচাই করব না? এ সকল ইসলামী কেন্দ্রে এমন অনেক আলিম রয়েছেন যারা যুগ যুগ ধরে ‘বুখারী’ পড়াচ্ছেন। বুখারী শরীফের অনেক কপি সেখানে বিদ্যমান। কিন্তু কেউই একটু কষ্ট করে পুস্তকটি খুলে দেখার চেষ্টা করলেন না। শুধু সহীহ বুখারীই নয়, ‘তারীখ বুখারী’, বুখারীর লেখা বা অন্য কারো লেখা কোনো গ্রন্থেই এ কথাটি সনদ-সহ বর্ণিত হয় নি। অথচ সে জাল কথাটিকে বুখারীর নামে চালানো হলো।

কেউ কেউ এ ভিত্তিহীন কথাটিকে শুধু বুখারীর নামে চালানোর চেয়ে ‘বুখারী ও মুসলিম’ উভয়ের নামে চালানোকে উত্তম (!) বলে মনে করেছেন। উক্ত প্রসিদ্ধ দীনী কেন্দ্রের একজন সম্মানিত মুহাদ্দিস, যিনি বহু বছর যাবৎ ছাত্রদেরকে ‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম’ পড়িয়েছেন তিনি এ হাদীসটি উল্লেখ করে লিখেছেন: ‘‘মুসলিম শরীফ ও বুখারী শরীফ।’’[4]

আমরা মনে করি যে, এ সকল বুযুর্গ ও আলিম জেনেশুনে এরূপ মিথ্যা কথা বলেন নি। তাঁরা অন্য আলিমদের উদ্ধৃতির উপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু আলিমদের জন্য এটি কখনোই গ্রহণযোগ্য ওযর নয়। এখন আমরা যতই বলি না কেন যে, এ হাদীসটি বুখারী বা মুসলিমে কোথাও নেই, আপনারা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে অনুসন্ধান করুন...সাধারণ মুসলিম ও ভক্তগণ সে সকল কথায় কর্ণপাত করবেন না। তাঁরা কোনোরূপ অনুসন্ধান ছাড়াই বলতে থাকবেন, এতবড় আলিম কি আর না জেনে লিখেছেন!!

[1] অনুবাদে এভাবেই লেখা হয়েছে, যদিও মূল আরবীতে ৭২ লেখা হয়েছে।

[2] শাহ মুহাম্মদ মোহেববুল্লাহ, পীর সাহেব ছারছিনা শরীফ, খুতবায়ে ছালেহীয়া, পৃ. ৪২।

[3] ইবনু তাইমিয়া, আল-ইসতিগাসাহ ফির রাদ্দি আলাল বাকরী ১/১৩৮; মাজমূউল ফাতাওয়া ১৮/৩৬৬-৩৬৭; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৪২-৪৩।

[4] আল্লামা মুহ. মুস্তফা হামীদী, মীলাদ ও কিয়াম (ছারছিনা দারুচ্ছুন্নাত লাইব্রেরী), পৃ. ১৮।