হাদীসের নামে জালিয়াতি ৭. মিথ্যার পরিচয় ও চিহ্নিত করণ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৭. ৩. ১. মূল নিরীক্ষায় সহীহ বলে প্রমাণিত

যদি বর্ণনাকারীগণের সাক্ষ্য ও সকল প্রাসঙ্গিক নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে, কথাটি ‘রাসূলুল্লাহ ()-এর বাণী, কর্ম বা অনুমোদন, তবে তা ‘ওহীর’ নির্দেশনা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। এখানেও ‘শুযূয’ ও ‘ইল্লাতের’ বিচার করতে হবে, যেখানে ভাষা ও অর্থগত নিরীক্ষার প্রক্রিয়া বিদ্যমান। তবে এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্যণীয়:

(ক) এ পর্যায়ের প্রমাণিত কোনো হাদীসের মধ্যে ভাষাগত বা অর্থগত দুর্বলতা বা অসংলগ্নতা পাওয়া যায় না। কারণ শব্দগত বা অর্থগত ভাবে অসংলগ্ন ‘হাদীস’ বর্ণনা করা, অথবা বুদ্ধি, বিবেক, বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক তথ্যের বিপরীত কোনো ‘হাদীস’ বর্ণনা করাকেই ‘রাবী’র দুর্বলতা বলে বিবেচনা করা হয়েছে। অনেক সৎ ও প্রসিদ্ধ রাবী এরূপ হাদীস বর্ণনা করার ফলে দুর্বল বলে বিবেচিত হয়েছেন এবং তাঁদের বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এজন্য সনদ ও সাধারণ অর্থ নিরীক্ষায় (৫টি শর্ত পূরণকারী) ‘সহীহ’ বলে প্রমানিত কোনো হাদীসের মধ্যে ভাষাগত ও অর্থগত দুর্বলতা পাওয়া যায় না।

(খ) অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘বিবেক’, ‘বুদ্ধি’ বা ‘আকল’-এর নির্দেশনা আপেক্ষিক। একজন মানুষ যাকে ‘বিবেক বিরোধী’ বলে গণ্য করছেন, অন্যজন তাকে ‘বিবেক’ বা বুদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করতে পারেন। এজন্য মুসলিম উম্মাহর মূলনীতি হলো, কোনো কিছু ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত হলে তা মেনে নেয়া। যেমন কুরআন কারীমে ‘চুরির শাস্তি হিসেবে হস্তকর্তনের’ নির্দেশ রয়েছে। বিষয়টি কারো কাছে ‘বিবেক’ বিরুদ্ধ মনে হতে পারে। কিন্তু মুমিন কখনোই এ যুক্তিতে এ বিধানটি প্রত্যাখ্যান করেন না। বরং বুদ্ধি, বিবেক ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে এ বিধানের যৌক্তিকতা বুঝতে চেষ্টা করেন। হাদীসের ক্ষেত্রেও মুমিনগণ একইরূপ মূলনীতি অনুসরণ করেন।

(গ) বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক তথ্যের ক্ষেত্রেও মুসলিম উম্মাহ একইরূপ মূলনীতি অনুসরণ করেন। স্বভাবতই কুরআন ও হাদীসে বিজ্ঞান বা ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হয় নি। তবে প্রাসঙ্গিকভাবে এ জাতীয় কিছু কথা আলোচনা করা হয়েছে। ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত কোনো বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ যদি কোনো ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক সত্যের বিপরীত হয়, তবে তাঁরা কখনোই সে বক্তব্যকে মিথ্যা বা ভুল বলে মনে করেন না। যেমন কুরআন কারীমের কোনো কোনো আয়াতের ব্যাহ্যিক অর্থ দ্বারা মনে হতে পারে যে, পৃথিবী সমতল বা সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত। এক্ষেত্রে মুমিনগণ এ সকল বক্তব্যের সঠিক অর্থ বুঝার চেষ্টা করেন। হাদীসের ক্ষেত্রেও একই নীতি তাঁরা অনুসরণ করেন।

(ঘ) নিরীক্ষায় প্রমাণিত কোনো ‘সহীহ হাদীসের’ সাথে অন্য কোনো সহীহ হাদীস বা কুরআনের আয়াতের মূলত কোনো বৈপরীত্য ঘটে না। বাহ্যত কোনো বৈপরীত্য দেখা দিলে মুহাদ্দিসগণ ঐতিহাসিক ও পারিপার্শ্বিক তথ্যাদির ভিত্তিতে ‘ডকুমেন্টারী’ প্রমাণের মাধ্যমে সেই বৈপরীত্য সমাধান করেছেন। কিন্তু কখনোই ঢালাওভাবে শুধু বাহ্যিক বৈপরীত্যের কারণে কোনো প্রমাণিত তথ্যকে অগ্রাহ্য করেন নি। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ () কোন্ স্থান থেকে হজ্জের ‘তালবিয়া’ পাঠ শুরু করেন সে বিষয়ে একাধিক ‘সহীহ’ বর্ণনা রয়েছে, যেগুলো বাহ্যত পরস্পর বিরোধী। মুহাদ্দিসগণ এ বাহ্যিক বৈপরীত্যের সমাধানের জন্য ঐতিহাসিক ও পারিপার্শিক তথ্যাদি বিবেচনা করেছেন, যা আমরা এ পুস্তকের প্রথমে আলোচনা করেছি।

এভাবে কোনো হাদীস ‘ডকুমেন্টারী’ নিরীক্ষায় ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত হওয়ার পরেও যদি বাহ্যত অন্য কোনো হাদীস বা আয়াতের সাথে তার বৈপরীত্য দেখা যায়, তবে মুহাদ্দিসগণ সে বৈপরীত্যের ইতিহাস, কারণ ও সমাধান অনুসন্ধান করেছেন ও লিপিবদ্ধ করেছেন।