উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যগুলো মুলত ধর্মীয়। ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়াও জাগতিক বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অনেক মানুষ হাদীস বানিয়েছেন। অর্থ কামাই, সম্মান বা সুনাম অর্জন, রাজা-বাদশাহদের দৃষ্টি আকর্ষণ, দরবারে মর্যাদা লাভ, রাজনৈতিক বা গোষ্ঠিগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে তারা হাদীস বানিয়েছেন।

শাসক-প্রশাসকদের কাছে যাওয়ার ও তাদের প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য মানুষ অনেক কিছুই করে থাকে। দ্বিতীয় হিজরী শতকে কোনো কোনো দুর্বল ঈমান ‘আলিম’ খলীফা বা আমীরদের মন জয় করার জন্য তাদের পছন্দ মোতাবেক হাদীস বানানোর চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তৃতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস যুহাইর ইবনু হারব (২৩৪ হি) বলেন: তৃতীয় আববাসী খলীফা মুহাম্মাদ মাহ্দী (রাজত্ব ১৫৮-১৬৯ হি)-এর দরবারে কয়েকজন মুহাদ্দিস আগমন করেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন গিয়াস ইবনু ইবরাহীম আন-নাখয়ী। খলীফা মাহ্দী উন্নত জাতের কবুতর উড়াতে ও কবুতরের প্রতিযোগিতা করাতে ভালবাসতেন। খলীফার পছন্দের দিকে লক্ষ্য করে গিয়াস নামক এ ব্যক্তি তার সনদ উল্লেখ করে বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘তীর নিক্ষেপ, ঘোড়া ও পাখি ছাড়া আর কিছুতে প্রতিযোগিতা নেই।’ একথা শুনে মাহদী খুশী হন এবং উক্ত মুহাদ্দিসকে ১০ হাজার টাকা হাদিয়া প্রদানের নির্দেশ দেন। কিন্তু যখন গিয়াস দরবার ত্যাগ করছিলেন তখন মাহদী বলেন, আমি বুঝতে পারছি যে, আপনি মিথ্যা বলেছেন। আমি আপনাকে মিথ্যা বলতে প্ররোচিত করেছি। তিনি কবুতরগুলো জবাই করতে নির্দেশ দেন। তিনি আর কখনো উক্ত মুহাদ্দিসকে তার দরবারে প্রবেশ করতে দেন নি।[1]

এখানে লক্ষণীয় যে, মূল হাদীসটি সহীহ, যাতে ঘোড়দৌড়, উটদৌড় ও তীর নিক্ষেপে প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার প্রদানে উৎসাহ দেয়া হয়েছে।[2] এ ব্যক্তি খলীফার মনোরঞ্জনের জন্য সেখানে ‘পাখি’ শব্দটি যোগ করেছে।

পঞ্চম আববাসী খলীফা হারূন আর-রাশীদ (শাসনকাল ১৯৩-১৭০ হি) রাষ্ট্রীয় সফরে মদীনা আগমন করেন। তিনি মসজিদে নাবাবীর মিম্বারে উঠে বক্তৃতা প্রদানের ইচ্ছা করেন। তাঁর পরনে ছিল কাল শেরোয়ানী। তিনি এ পোশাকে মিম্বারে নাবাবীতে আরোহণ করতে দ্বিধা করছিলেন। মদীনার মশহুর আলিম ও বিচারক ওয়াহ্ব ইবনু ওয়াহ্ব আবুল বুখতুরী তখন বলেন: আমাকে জা’ফর সাদিক বলেছেন, তাঁকে তাঁর পিতা মুহাম্মাদ আল-বাকির বলেছেন, জিবরাঈল (আঃ) কালো শেরোয়ানী পরিধান করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আগমন করেন।[3]

এভাবে তিনি খলীফার মনোরঞ্জনের জন্য একটি মিথ্যা কথাকে হাদীস বলে চালালেন। আবুল বুখতুরী হাদীস জালিয়াতিতে খুবই পারদর্শী ছিলেন।

[1] খতীব বাগদাদী, আহমাদ ইবনু আলী, তারীখ বাগদাদ ১২/৩২৩-৩২৪।

[2] তিরমিযী, মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা (২৭৯ হি), আস-সুনান ৪/২০৫।

[3] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৪৫২।