৫. ৩. ১. নেককারগণের অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা

সূফী দরবেশ আল্লাহওয়ালা মানুষেরা সরলমনা ভালো মানুষ। সবাইকে সরল মনে বিশ্বাস করা ও দয়া করাই তাঁদের কাজ। আর মুহাদ্দিসের কাজ দারোগার কাজ। দরবেশের শুরু বিশ্বাস দিয়ে আর দারোগার শুরু অবিশ্বাস দিয়ে। কোনো মানুষ যদি তার কোনো বিপদের কথা বলে, বা কোনো অপরাধের জন্য ওজর পেশ করে তখন সাধারণত সরল প্রাণ মানুষেরা তা বিশ্বাস করে ফেলেন। কিন্তু একজন দারগা প্রথমেই অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করেন। তিনি তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে জানতে চেষ্টা করেন, সে ধোঁকা দিচ্ছে না সত্য কথা বলছে। এরপর তিনি তা বিশ্বাস করেন।

কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফের অগণিত নির্দেশের আলোকে সাহাবীগণের যুগ থেকে সাহাবীগণ ও পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ ওহী বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষায় সদাজাগ্রত প্রহরী বা দারোগার দায়িত্ব পালন করছেন। সুক্ষ্ম নিরীক্ষা ও যাচাই ছাড়া তারা রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বলা কোনো কথা সঠিক বলে গ্রহণ করেন নি।

পক্ষান্তরে সরলপ্রাণ ‘যাহিদ’ সূফী-দরবেশগণ রাসূলুল্লাহর () নামে কোনো কথা শোনামাত্র আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। রাসূলুল্লাহর () নামে কেউ মিথ্যা বলতে পারে তা কখনো তাঁরা চিন্তা করেননি। তাঁরা যা শুনেছেন সবই ভক্তের হৃদয় দিয়ে শুনেছেন, সরল বিশ্বাসে মেনে নিয়েছেন, আমল করেছেন এবং অন্যকে আমল করতে উৎসাহ দিয়েছেন। এজন্য তাবে-তাবিয়ীদের যুগ থেকেই মুহাদ্দিসগণ এধরনের নেককার দরবেশদের হাদীস গ্রহণ করতেন না। ইমাম মালিক (১৭৯ হি.) বলতেন: মদীনায় অনেক দরবেশ আছেন, যাদের কাছে আমি লাখ টাকা আমানত রাখতে রাজি আছি, কিন্তু তাঁদের বর্ণিত একটি হাদীসও আমি গ্রহণ করতে রাজি নই।[1]

ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ আল-কাত্তান (১৯৮ হি.) বলেন : ‘‘নেককার বুযুর্গরা রাসূলুল্লাহ ()-এর হাদীসের বিষয়ে যত বেশি মিথ্যা বলেন অন্য কোনো বিষয়ে তাঁরা এমন মিথ্যা বলেন না।’’ ইমাম মুসলিম (২৬১ হি) এ কথার ব্যাখ্যায় বলেন: এ সকল নেককার মানুষেরা ইচ্ছা করে মিথ্যা বলেন না, কিন্তু বেখেয়ালে তাঁরা মিথ্যাচারে লিপ্ত হন। কারণ তাঁরা হাদীস সঠিকভাবে মুখস্থ রাখতে পারেন না, উল্টে পাল্টে ফেলেন, অধিকাংশ সময় মনের আন্দাজে হাদীস বলেন, ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যাচারে লিপ্ত হন।’’[2]

ইবনুস সালাহ (৬৪৩ হি), নাবাবী (৬৭৬ হি), ইরাকী (৮০৬) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার একটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। এ অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ্ তাঁর সুনানে সংকলন করেছেন। তিনি বলেন: আমাদেরকে ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ আত-তালহী বলেছেন, আমাদেরকে সাবিত ইবনু মূসা আবু ইয়াযিদ বলেছেন, তিনি শারীক থেকে, তিনি আ’মাশ থেকে, তিনি আবু সুফিয়ান থেকে, তিনি জাবির (রা) থেকে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ () বলেছেন:

مَنْ كَثُرَتْ صَلاَتُهُ بِاللَّيْلِ حَسُنَ وَجْهُهُ بِالنَّهَارِ

‘‘যার রাতের সালাত অধিক দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্যময় হয়।’’[3]

মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতরূপে জানতে পেরেছেন যে, এ কথা রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বানোয়াট কথা। তবে তা ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা সে বিষয়ে তাঁরা মতভেদ করেছেন।

ইবনু মাজাহর উস্তাদ ইসমাঈল ও অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস এ হাদীসটি আবু ইয়াযিদ সাবিত ইবনু মূসা ইবনু আব্দুর রাহমান (২২৯ হি) থেকে শুনেছেন ও লিখেছেন। একমাত্র তিনিই এ হাদীসটির বর্ণনাকারী। তিনি দাবী করেন যে, শারীক ইবনু আব্দুল্লাহ (১৭৮ হি) তাকে এ হাদীসটি বলেছেন।

মুহাদ্দিসগণ শারীকের সকল ছাত্রের হাদীস, শারীকের উস্তাদ সুলাইমান ইবনু মিহরান আল-আ’মাশ (১৪৭ হি)-এর সকল ছাত্রের হাদীস, আ’মাশের উস্তাদ আবু সুফিয়ান তালহা ইবনু নফি’-এর সকল ছাত্রের হাদীস এবং জাবির (রা)-এর অন্যান্য ছাত্রের হাদীস সংগ্রহ করে তুলনা করেছেন এবং নিশ্চিত হয়েছেন যে এ হাদীসটি একমাত্র সাবিত ছাড়া কেউ বর্ণনা করেন নি। তাঁরা দেখেছেন যে, ‘সাবিত’ ‘শারীক’-এর এমন কোনো ঘনিষ্ঠ ছাত্র বা দীর্ঘকালীন সহচর ছিলেন না যে, শারীক অন্য কোনো ছাত্রকে না বলে শুধুমাত্র তাঁকেই এ হাদীসটি বলবেন। এছাড়া সাবিত বর্ণিত অন্যান্য হাদীস নিরীক্ষা করে তাঁরা সেগুলোর কিছু কিছু হাদীসে মারাত্মক ভুল দেখতে পেয়েছেন। এভাবে সামগ্রিক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, সাবিত ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলেছেন।

সাবিত ইবনু মূসা তৃতীয় হিজরী শতকের একজন নেককার আবিদ ও দরবেশ ছিলেন। তাঁর ধার্মিকতার কারণে সাধারণভাবে অনেক মুহাদ্দিস তাঁর প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করতেন। তবে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা দেখেছেন যে, তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে বেশ কিছু হাদীস ভুল বা মিথ্যা বলে প্রমাণিত। তিনি যে সকল উস্তাদের সূত্রে হাদীসগুলো বলছেন, সে সকল উস্তাদের দীর্ঘদিনের বিশেষ ছাত্র বা অন্য কোনো ছাত্র সে হাদীস বলছেন না। এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলেছেন। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন (২৩৩ হি) সাবিত সম্পর্কে বলেন: ‘তিনি মিথ্যাবাদী’।[4]

পক্ষান্তরে আবু হাতিম রাযী (২৭৭ হি), ইবনু আদী (৩৬৫ হি) প্রমুখ মুহাদ্দিস সাবিতের এ মিথ্যাকে ‘অনিচ্ছাকৃত’ বলে মনে করেছেন। তাঁরা বলেন যে, সাবিত মূলত হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন না। সাধারণ আবিদ ছিলেন। তিনি ৭/৮ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে দুটি হাদীস বাদে বাকীগুলো তিনি ঠিকমতই বর্ণনা করেছেন। এতে মনে হয় তাঁর ভুল অনিচ্ছাকৃত। এজন্য তাঁরা তাকে সুস্পষ্টভাবে ‘মিথ্যাবাদী’ না বলে ‘দুর্বল’ বলেছেন।[5]

কোনো কোনো মুহাদ্দিস সাবিতের ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’র কারণ উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু নুমাইর (২৩৪ হি) বলেন, হাদীসটি বাতিল। সাবিত বুঝতে না পেরে হাদীসটি বলেছেন। শারীক ইবনু আব্দুল্লাহ হাসি-মশকরা করতে ভালবাসতেন। আর সাবিত ছিলেন নেককার আবিদ মানুষ। সম্ভবত, শারীক যখন হাদীস বলছিলেন তখন সাবিত সেখানে উপস্থিত হন। শারীক বলছিলেন: আমাদেরকে আ’মাশ, তিনি আবু সুফিয়ান থেকে, তিনি জাবির (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ থেকে। এমতাবস্থায় সাবিত সেখানে প্রবেশ করেন। সাবিতকে দেখে শারীক হাদীস বলা বন্ধ করে তার সরলতা মন্ডিত উজ্জল চেহারা লক্ষ্য করে বলেন: ‘যার রাতের সালাত অধিক হয়, দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্যময় হয়।’ শারীকের এ কথা সাবিত ভুলবশত উপরের সনদে বর্ণিত হাদীস মনে করেন। এভাবে তিনি শারীকের একটি কথাকে ভুলবশত রাসূলুল্লাহ ()-এর কথা বলে বর্ণনা করেন। এ কারণে ইবনু সালাহ, নাবাবী, ইরাকী ও অন্যান্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’-র উদাহরণ হিসাবে পেশ করেছেন।[6]

[1] ড. আমীন আবু লাবী, ইলমু উসূলিল জারহি ওয়াত তা’দীল, ১৬৬-১৬৭।

[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৭-১৮; ইবনু আদী, আল-কামিল ২/১৯২, ২১৩-২১৪, ৩০১, ৩/৩৩৫, ৪/১১৪-১২০, ১৭৪-১৭৬, ৩৫১, ৩৯৯-৪০৩, ৬/১৭৪-১৯৫, ৭/২৩০।

[3] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৪২২।

[4] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/৮৯, ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ২/১৪।

[5] ইবনু আদী, আল-কামিল ২/৯৯; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/৮৯।

[6] ইবনু আদী, আল-কামিল ২/৯৯, যাহাবী; মীযানুল ই’তিদাল ২/৮৮; ইরাকী, আত-তাকয়ীদ, পৃ: ১২৯; ফাতহুল মুগীস, পৃ: ১২৭, ১২৮; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৮৭।