হাদীসের নামে জালিয়াতি ৪. জালিয়াতি প্রতিরোধে মুসলিম উম্মাহ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

মুহাদ্দিসগণ কোনো রাবীর কাছ থেকে হাদীস সংগ্রহের পরে চেষ্টা করতেন তিনি যে উস্তাদের সূত্রে হাদীসটি বলেছেন তাঁর কাছে যেয়ে সরাসরি তাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে বর্ণনাটি যাচাই করার। এজন্য প্রয়োজনে তাঁরা হাজার মাইল পরিভ্রমণের কষ্ট স্বীকার করতেন। উক্ত শিক্ষকের মৃত্যুর কারণে তার কাছে প্রশ্ন করা সম্ভব না হলে তাঁরা তার অন্যান্য ছাত্রের বর্ণনা সংগ্রহ করে তুলনা করতেন। এ জাতীয় একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।

দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন তাবিয়ী হাদীস বর্ণনা কারী ‘রাবী’ হাসান ইবনু উমারাহ আল-বাজালী (১৫৩ হি) তিনি বড় আলিম ও ফকীহ ছিলেন এবং কিছুদিন বাগদাদের বিচারপতি ছিলেন। কিন্তু হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি খুবই দুর্বল ছিলেন। সমকালীন নাকিদ বা সমালোচক হাদীসের ইমামগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে তার দুর্বলতা প্রমাণিত করেন। এ বিষয়ে দ্বিতীয় হিজরীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, নাকিদ ও ইমাম আল্লামা শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ (১৬০ হি) বলেন: ‘‘হাসান ইবনু উমারাহ আমাকে ৭ টি হাদীস বলেন। তিনি বলেন যে, তিনি হাদীসগুলো হাকাম ইবনু উতাইবাহ (১১৩ হি) এর কাছ থেকে শুনেছেন, তিনি ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার থেকে শুনেছেন। আমি হাকাম ইবনু উতাইবাহ-এর সাথে সাক্ষাত করে সেগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন: এগুলো মধ্যে একটি হাদীসও আমি বলি নি।’’[1]

আবু দাউদ তায়ালিসী সুলাইমান ইবনু দাউদ (২০৪ হি) বলেন: শু’বা আমাকে বলেন: আমাকে হাসান ইবনু উমারাহ বলেন, আমাকে হাকাম ইবনু উতাইবাহ বলেছেন, আব্দুর রাহমান ইবনু আবী লাইলা বলেছেন, আলী (রা) বলেছেন: ‘‘উহদের শহীদগণকে গোসল দেয়া হয়, কাফন পরানো হয় এবং জানাযার সালাত আদায় করা হয়।’’ এরপর আমি হাকামের কাছে গমন করে উহদের শহীদগণের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন: তাঁদের গোসল করানো হয় নি এবং কাফন পরানো হয় নি। আমি বললাম: তাহলে হাসান ইবনু উমারাহ যে আপনার সূত্রে এ সব কথা বর্ণনা করছে? তিনি বলেন: আমি কখনোই তাকে এ হাদীস বলি নি।’’[2]

আবু দাউদ তায়ালিসী আরো বলেন: আমাকে শু’বা বললেন: তুমি জারীর ইবনু হাযিম (১৭০ হি) এর নিকট গমন করে তাকে বল: আপনার জন্য হাসান ইবনু উমারাহ থেকে হাদীস বর্ণনা করা জায়েয নয়; কারণ সে মিথ্যা বলে। তায়ালিসী বলেন: আমি প্রশ্ন করলাম: কিভাবে তা জানলেন? তিনি বলেন: তিনি আমাকে হাকাম ইবনু উতাইবাহর সূত্রে অনেক হাদীস শুনিয়েছেন যেগুলোর কোনো ভিত্তি আমি পাই নি।

তায়ালিসী বলেন: আমি বললাম: সেগুলো কি? শু’বা বলেন: আমি হাকামকে বললাম: রাসূলুল্লাহ () কি উহদ যুদ্ধের শহীদগণের সালাতুল জানাযা আদায় করেছিলেন? তিনি বলেন: না, তিনি তাঁদের সালাতুল জানাযা আদায় করেন নি। আর হাসান ইবনু উমারাহ বলছেন, তাকে হাকাম বলেছেন, তাকে মুকসিম বলেছেন, তাকে ইবনু আববাস বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উহদের শহীদগণের সালাতুল জানাযা আদায় করেন এবং দাফন করেন। আমি হাকামকে বললাম: জারজ সন্তানের বিষয়ে আপনার মত কি? তিনি বলেন: তাদের জানাযা পড়া হবে। আমি বললাম: এ হাদীস কার থেকে বর্ণিত? হাকাম বলেন: হাসান বসরী থেকে বর্ণিত। অথচ হাসান ইবনু উমারাহ বলছেন: তাকে হাকাম হাদীসটি ইয়াহইয়া ইবনুল জাযযার থেকে আলীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।’’[3]

এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শু’বা হাসান ইবনু উমারাহ-এর বর্ণিত হাদীসগুলো তার উস্তাদের কাছে পেশ করে হাসানের বর্ণনার অযথার্থতা ও তার ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত করলেন। এইরূপ অগণিত ঘটনা আমরা রিজাল গ্রন্থসমূহে দেখতে পাই। মূলত মুহাদ্দিসগণের সফরের একটি বড় অংশ ব্যয় করতেন সংকলিত হাদীস সমূহ ‘রাবী’র উস্তাদের কাছে পেশ করে সেগুলোর যথার্থতা যাচাইয়ের কাজে।

[1] ইবনু আদী, আল-কামিল ফী দুআফাইর রিজাল ২/২৮৩।

[2] প্রাগুক্ত ২/২৮৪।

[3] মুসলিম, আস-সহীহ ১/২৩-৩৪।