হাদীসের নামে জালিয়াতি ৪. জালিয়াতি প্রতিরোধে মুসলিম উম্মাহ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৪. ৩. ১ হাদীস শিক্ষা, সংগ্রহ ও সনদ বর্ণনায় পান্ডুলিপি

সাহাবীগণ সাধারণত হাদীস মুখস্থ করতেন ও কখনো কখনো লিখেও রাখতেন। সাহাবীগণের হাদীস লিখে রাখার প্রয়োজনও তেমন ছিল না। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, অধিকাংশ সাহাবী থেকে বর্ণিত হাদীস ২০/৩০ টির অধিক নয়। রাসূলুল্লাহ ()-এর সাহচর্যে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি থেকে ২০/৩০ টি বা ১০০ টি, এমনকি হাজারটি ঘটনা বা কথা বলার জন্য লিখে রাখার প্রয়োজন হতো না। তাছাড়া তাঁদের জীবনে আর কোনো বড় বিষয় ছিল না। রাসূলুল্লাহর () স্মৃতি আলোচনা, তাঁর নির্দেশাবলি হুবহু পালন, তাঁর হুবহু অনুকরণ ও তাঁর কথা মানুষদের শোনানোই ছিল তাঁদের জীবনের অন্যতম কাজ। অন্য কোনো জাগতিক ব্যস্ততা তাঁদের মন-মগজকে ব্যস্ত করতে পারত না। আর যে স্মৃতি ও যে কথা সর্বদা মনে জাগরুক এবং কর্মে বিদ্যমান তা তো আর পৃথক কাগজে লিখার দরকার হয় না। তা সত্ত্বেও অনেক সাহাবী তাঁদের মুখস্থ হাদীস লিখে রাখতেন এবং লিখিত পান্ডুলিপির সংরক্ষণ করতেন।[1]

সাহাবীগণের ছাত্রগণ বা তাবিয়ীগণের যুগ থেকে হাদীস শিক্ষা প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল লিখিত পান্ডুলিপি সংরক্ষণ করা। অধিকাংশ তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ হাদীস শুনতেন, লিখতেন ও মুখস্থ করতেন। পান্ডুলিপি সামনে রেখে বা পান্ডুলিপি থেকে মুখস্থ করে তা তাঁদের ছাত্রদের শোনাতেন। তাঁদের ছাত্ররা শোনার সাথে সাথে তা তাদের নিজেদের পান্ডুলিপিতে লিখে নিতেন এবং শিক্ষকের পান্ডুলিপির সাথে মেলাতেন। তাবিয়ীগণের যুগ, অর্থাৎ প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষাংশ থেকে এভাবে সকল পঠিত হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখা হাদীস শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এ বিষয়ক অগণিত বিবরণ হাদীস বিষয়ক গ্রন্থ সমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। দুএকটি উদাহরণ দেখুন।

তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু আকীল (১৪০ হি) বলেন:

كُنْتُ أَذْهَبُ أَنَا وَأَبُوْ جَعْفَرٍ اِلَى جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ وَمَعَنَا أَلْوَاحٌ صِغَارٌ نَكْتُبُ فِيْهَا الْحَدِيْثَ

‘‘আমি এবং আবু জা’ফর মুহাম্মাদ আল-বাকির (১১৪হি) সাহাবী জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (৭০ হি) এর নিকট গমন করতাম। আমরা সাথে ছোট ছোট বোর্ড বা স্লেট নিয়ে যেতাম যেগুলোতে আমরা হাদীস লিপিবদ্ধ করতাম।’’[2]

তাবিয়ী সাঈদ ইবনু জুবাইর (৯৫ হি) বলেন:

كُنْتُ أَكْتُبُ عِنْدَ ابْنِ عَبَّاسٍ فَاِذَا امْتَلأَتِ الصَّحِيْفَةُ أَخَذْتُ نَعْلِيْ فَكَتَبْتُ فِيْهَا حَتَّى تَمْتَلِئَ

‘‘আমি সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (৬৮ হি) এর কাছে বসে হাদীস লিপিবদ্ধ করতাম। যখন লিখতে লিখতে পৃষ্ঠা ভরে যেত তখন আমি আমার সেন্ডেল নিয়ে তাতে লিখতাম। লিখতে লিখতে তাও ভরে যেত।’’[3]

তাবিয়ী আমির ইবনু শারাহীল শা’বী (১০২ হি) বলেন:

اُكْتُبُوْا مَا سَمِعْتُمْ مِنِّيْ وَلَوْ عَلَى جِدَارٍ

‘‘তোমরা যা কিছু আমার কাছ থেকে শুনবে সব লিপিবদ্ধ করবে। প্রয়োজনে দেওয়ালের গায়ে লিখতে হলেও তা লিখে রাখবে।’’[4]

তাবিয়ী আবু কিলাবাহ আব্দুল্লাহ ইবনু যাইদ (১০৪ হি) বলেন:

اَلْكِـتَابَةُ أَحَبُّ إِلَـيَّ مِنَ النِّسْيَـانِ

‘‘ভুলে যাওয়ার চেয়ে লিখে রাখা আমার কাছে অনেক প্রিয়।’’[5]

তাবিয়ী হাসান বসরী (১১০ হি) বলেন:

إِنَّ لَنَا كُـتُـباً نَـتَعَاهَدُهَا

‘‘আমাদের কাছে পান্ডুলিপি সমূহ রয়েছে, যেগুলো আমরা নিয়মিত দেখি এবং সংরক্ষণ করি।’’[6]

প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১৮১ হি) বলেন:

لَوْلاَ الْكِـتَابُ لَمَا حَفِظْـنَا

‘‘হাদীস শিক্ষার সময় পান্ডুলিপি আকারে লিখে না রাখলে আমরা মুখস্থই করতে পারতাম না।’’[7]

এ বিষয়ক অগণিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করতে পৃথক গ্রন্থের প্রয়োজন।[8]

এভাবে আমরা দেখছি যে, তাবিয়ীগণের যুগ থেকে মুহাদ্দিসগণ হাদীস শিক্ষার সাথে সাথে তা লিখে রাখতেন। হাদীস শিক্ষা দানের সময় তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণ সাধারণত পান্ডুলিপি দেখে হাদীস পড়ে শেখাতেন। কখনো বা মুখস্থ পড়ে হাদীস শেখাতেন তবে পান্ডুলিপি নিজের হেফাজতে রাখতেন যেন প্রয়োজনের সময় তা দেখে নেয়া যায়।

তাবিয়ীগণের যুগে বা তৎপরবর্তী যুগে কতিপয় মুহাদ্দিস ছিলেন যাঁরা পান্ডুলিপি ছাড়াই হাদীস মুখস্থ রাখতেন এবং বর্ণনা করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা হাদীস বর্ণনায় দুর্বল বলে প্রমাণিত হয়েছেন। পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, এরা পান্ডুলিপির উপর নির্ভর না করায় মাঝে মাঝে বর্ণনায় ভুল করতেন। বস্ত্তত মৌখিক শ্রবণ ও পান্ডুলিপির সংরক্ষণের মাধ্যমেই নির্ভরযোগ্য বর্ণনা করা সম্ভব। এজন্য যে সকল ‘রাবী’ শুধুমাত্র পান্ডুলিপির উপর নির্ভর করে বা শুধুমাত্র মুখস্থশক্তির উপর নির্ভর করে হাদীস বর্ণনা করতেন তাঁদের হাদীস মুহাদ্দিসগণ দুর্বল বা অনির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। কারণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে এদের বর্ণনায় ভুল ও বিক্ষিপ্ততা ধরা পড়ে। এ জাতীয় অগণিত বিবরণ আমরা রিজাল ও জারহু ওয়াত তা’দীল বিষয়ক গ্রন্থগুলোতে দেখতে পাই। দুইএকটি উদাহরণ দেখুন:

আবু আম্মার ইকরিমাহ ইবনু আম্মার আল-ইজলী (১৬০ হি) দ্বিতীয় শতকের একজন প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি হাদীস মুখস্থকারী (حافظ) হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর মুখস্থ হাদীসগুলো লিপিবদ্ধ করে পান্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত রাখতেন না, ফলে প্রয়োজনে তা দেখতে পারতেন না। এজন্য তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু ভুল পাওয়া যেত। ইমাম বুখারী (১৫৬ হি) বলেন:

لَمْ يَكُـنْ لَهُ كِـتَابٌ فَاضْطَرَبَ حَدِيْـثُهُ

‘‘তাঁর কোনো পান্ডুলিপি ছিল না; এজন্য তাঁর হাদীসে বিক্ষিপ্ততা পাওয়া যায়।’’[9]

দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন প্রসিদ্ধ হাদীস বর্ণনাকারী মুহাদ্দিস জারীর ইবনু হাযিম ইবনু যাইদ (১৭০ হি)। তাঁর বিষয়ে ইবনু হাজার বলেন:

ثِقَـةٌ ... وَلَهُ أَوْهَامٌ إِذَا حَـدَّثَ مِنْ حِفْظِهِ

তিনি নির্ভরযোগ্য।...তবে তিনি যখন পান্ডুলিপি না দেখে শুধুমাত্র মুখস্থ স্মৃতির উপর নির্ভর করে হাদীস বলতেন তখন তার ভুল হতো।[10]

দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী আব্দুল আযীয ইবনু ইমরান ইবনু আব্দুল আযীয (১৭০হি)। তিনি মদীনার অধিবাসী ছিলেন এবং সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনু আউফের বংশধর ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁকে দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। কারণ তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে ভুলভ্রান্তি ব্যাপক। আর এ ভুল ভ্রান্তির কারণ হলো পান্ডুলিপি ব্যতিরেকে মুখস্থ বর্ণনা করা। তৃতীয় হিজরী শতকের মদীনার মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক উমার ইবনু শাববাহ (২৬২ হি) তাঁর ‘মদীনার ইতিহাস’ গ্রন্থে এ ব্যক্তির সম্পর্কে বলেন:

كَانَ كَثِيْرَ الْغَلَطِ فِيْ حَدِيْثِهِ لأَنَّهُ احْتَرَقَتْ كُتُبُهُ فَكَانَ يُحَدِّثُ مِنْ حِفُظِهِ

‘‘তিনি হাদীস বর্ণনায় অনেক ভুল করতেন; কারণ তাঁর পান্ডুলিপিগুলি পুড়ে যাওয়ার ফলে তিনি স্মৃতির উপর নির্ভর করে মুখস্থ হাদীস বলতেন।’’[11]

ইবনু হাজার আসকালানীর ভাষায়:

مَتْرُوْكٌ، احْتَرَقَتْ كُتُبُهُ فَحَدَّثَ مِنْ حِفْظِهِ فَاشْتَدَّ غَلَطُهُ

‘‘তিনি পরিত্যক্ত রাবী। তাঁর পান্ডুলিপিগুলি পুড়ে যায়। এজন্য তিনি স্মৃতির উপর নির্ভর করে হাদীস বলতেন। এতে তাঁর ভুল হতো খুব বেশি।’’[12]

তৃতীয় শতকের একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাজিব ইবনু সুলাইমান আল-মানবিজী (২৬৫ হি)। তিনি ইমাম নাসাঈর উস্তাদ ছিলেন। তিনি হাদীস বর্ণনায় নির্ভরযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও পান্ডুলিপি না থাকার কারণে তার ভুল হতো। ইমাম দারাকুতনী (৩৮৫ হি) বলেন:

كَانَ يُحَدِّثُ مِنْ حِفْظِهِ وَلَمْ يَكُـنْ لَهُ كِـتَابٌ، وَهِمَ فِيْ حَدِيْثِـهِ

‘‘তিনি হাদীস মুখস্থ বলতেন এবং স্মৃতিশক্তির উপরেই নির্ভর করতেন। তাঁর কোনো পান্ডুলিপি ছিল না। এজন্য তার হাদীসে ভুল দেখা দেয়।’’[13]

তৃতীয় শতকের একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম ইবনু মুসলিম, আবু উমাইয়া (২৭৩ হি)। তাঁর সম্পর্কে তাঁর ছাত্র মুহাম্মাদ ইবনু হিববান (৩৫৪ হি) বলেন:

...وَكَانَ مِنَ الثِّقَاتِ دَخَلَ مِصْرَ فَحَدَّثَهُمْ مِنْ حِفْظِهِ مِنْ غَيْرِ كِتَابٍ بِأَشْيَاءَ أَخْطَأَ فِيْهَا فَلاَ يُعْجِبُنِيْ الاِحْتِجَاجُ بِخَبَرِهِ إِلاَّ مَا حَدَّثَ مِنْ كِتَابِهِ

‘‘... তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন। তিনি মিশরে আগমন করেন এবং তথায় কোনো পান্ডুলিপি ছাড়া মুখস্থ কিছু হাদীস বর্ণনা করেন; যে সকল হাদীস বর্ণনায় তিনি ভুল করেন। এজন্য তাঁর বর্ণিত কোনো হাদীস আমি দলীল হিসাবে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নই। শুধুমাত্র যে হাদীসগুলো তিনি পান্ডুলিপি দেখে বর্ণনা করেছেন সেগুলোই গ্রহণ করা যায়।[14]

ইমাম শাফিয়ী (২০৪ হি) দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম আলিম। তিনি লিখেছেন: যে মুহাদ্দিসের ভুল বেশি হয় এবং তার কোনো বিশুদ্ধ লিখিত পান্ডুলিপি নেই তার হাদীস গ্রহণ করা যাবে না।[15]

এভাবে আমরা দেখছি যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে হাদীস শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য শিক্ষকের কাছ থেকে মৌখিক শ্রবণ ও লিখিত পান্ডুলিপি সংরক্ষণ উভয়ের সমন্বয়ের উপর নির্ভর করা হতো। সুপ্রসিদ্ধ ‘হাফিয-হাদীসগণ’, যাঁরা আজীবন হাদীস শিক্ষা করেছেন ও শিক্ষা দিয়েছেন এবং লক্ষ লক্ষ হাদীস মুখস্থ রেখেছেন, তাঁরাও পান্ডুলিপি না দেখে হাদীস শিক্ষা দিতেন না বা বর্ণনা করতেন না।

৩য় শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস আলী ইবনুল মাদীনী (২৩৪ হি) বলেন:

لَيْسَ فِيْ أَصْحَابِنَا أَحْفَظُ مِنْ أَبِيْ عَبْدِاللهِ أَحْمَدَ بْنِ حَنْبَلٍ إِنَّهُ لاَ يُحَدِّثُ إِلاَّ مِنْ كِتَابِهِ وَلَنَا فِيْهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ

‘‘হাদীস মুখস্থ করার ক্ষেত্রে আমাদের সাথীদের মধ্যে আহমাদ ইবনু হাম্বাল (২৪১ হি) -এর চেয়ে বড় বা বেশি যোগ্য কেউই ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি কখনো পান্ডুলিপি সামনে না রেখে হাদীস বর্ণনা করতেন না। আর তাঁর মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।’’[16]

অপরদিকে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (২৪১ হি) বলেন: ‘‘অনেকে আমাদেরকে স্মৃতি থেকে হাদীস শুনিয়েছেন এবং অনেকে আমাদেরকে পান্ডুলিপি দেখে হাদীস শুনিয়েছেন। যাঁরা পান্ডুলিপি দেখে হাদীস শুনিয়েছেন তাঁদের বর্ণনা ছিল বেশি নির্ভুল।’’[17]

এভাবে আমরা দেখছি যে, দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মুহাদ্দিসগণ হাদীস শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের সমন্বয়কে অত্যন্ত জরুরী মনে করতেন: প্রথমত হাদীসটি উস্তাদের মুখ থেকে শাব্দিকভাবে শোনা বা তাকে মুখে পড়ে শোনানো ও দ্বিতীয়ত পঠিত হাদীসটি নিজে হাতে লিখে নেয়া ও তৃতীয়ত উস্তাদের পান্ডুলিপির সাথে নিজের লেখা পান্ডুলিপি মিলিয়ে সংশোধন করে নেয়া। কোনো মুহাদ্দিস স্বকর্ণে শ্রবণ ব্যতীত শুধু পান্ডুলিপি দেখে হাদীস শেখালে বা পান্ডুলিপি ছাড়া শুধু মুখস্থ হাদীস শেখালে তা গ্রহণ করতে তাঁরা আপত্তি করতেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ (২৯০ হি) বলেন,

قَالَ يَحْيَى بْنُ مَعِينٍ: قَالَ لِي عَبْدُ الرَّزَّاقِ: اكْتُبْ عَنِّي وَلَوْ حَدِيثًا وَاحِدًا مِنْ غَيْرِ كِتَابٍ، فَقُلْتُ: لا، وَلا حَرْفًا.

‘‘ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মা‘ঈন (২৩৩ হি) বলেন: ইমাম আব্দুর রাযযাক সান‘আনী (২১১ হি) আমাকে বলেন : তুমি আমার কাছ থেকে অন্তত একটি হাদীস লিখিত পান্ডুলিপি ছাড়া গ্রহণ কর। আমি বললাম: কখনোই না, আমি লিখিত পান্ডুলিপির প্রমাণ ছাড়া মৌখিক বর্ণনার উপর নির্ভর করে একটি অক্ষরও গ্রহণ করতে রাজী নই।[18]

আব্দুর রাযযাক সান‘আনীর মত সুপ্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনাকারী মুহাদ্দিসের কাছ থেকেও লিখিত ও সংরক্ষিত পান্ডুলিপির সমন্বয় ব্যতিরেকে একটি হাদীস গ্রহণ করতেও রাজী হন নি ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন!

এ বিষয়ে তাঁদের মূলনীতি দেখুন। তৃতীয় শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন (২৩৩হি) বলেন: যদি কোনো ‘রাবী’র হাদীস তিনি সঠিকভাবে মুখস্থ ও বর্ণনা করতে পেরেছেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ হয় তাহলে তার কাছে তার পুরাতন পান্ডুলিপি চাইতে হবে। তিনি যদি পুরাতন পান্ডুলিপি দেখাতে পারেন তাহলে তাকে ইচ্ছাকৃত ভুলকারী বলে গণ্য করা যাবে না। আর যদি তিনি বলেন যে, আমার মূল প্রাচীন পান্ডুলিপি নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আমার কাছে তার একটি অনুলিপি আছে তাহলে তার কথা গ্রহণ করা যাবে না। অথবা যদি বলেন যে, আমার পান্ডুলিপিটি আমি পাচ্ছি না তাহলেও তাঁর কথা গ্রহণ করা যাবে না। বরং তাকে মিথ্যাবাদী বলে বুঝতে হবে।[19]

[1] মুহাম্মাদ আজ্জাজ আল-খতীব, আস-সুন্নাতু কাবলাত তাদবীন, পৃ: ৩০৩-৩২১।

[2] রামহুরমুযী, হাসান ইবনু আব্দুর রাহমান (৩৬০ হি), আল-মুহাদ্দিস আল-ফাসিল পৃ: ৩৭০-৩৭১।

[3] প্রাগুক্ত, পৃ: ৩৭১।

[4] প্রাগুক্ত, পৃ: ৩৭৬।

[5] ইবনু রাজাব, শারহু ইলালিত তিরমিযী , পৃ: ৫৭।

[6] রামহুরমুযী, আল-মুহাদ্দিস আল-ফাসিল, ৩৭০-৩৭১।

[7] ইবনু রাজাব, শারহু ইলালিত তিরমিযী, পৃ: ৫৭।

[8] বিস্তারিত দেখুন, রামহুরমুযী, আল-মুহাদ্দিস আল-ফাসিল, পৃ: ৩৭০-৩৭৭।

[9] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/১১৪।

[10] ইবনু হাজার, তাকরীবুত তাহযীব, পৃ: ১৩৮।

[11] ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ৬/৩১২; তাকরীবুত তাহযীব, পৃ ৩৫৮।

[12] ইবনু হাজার, তাকরীবুত তাহযীব, পৃ. ৩৫৮।

[13] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/১৬৪; ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ২/১১৪।

[14] ইবনু হিববান, মুহাম্মাদ (৩৫৪ হি), আস-সিকাত ৯/১৩৭।

[15] শাফিয়ী, মুহাম্মাদ ইবনু ইদরীস (২০৪ হি), আর-রিসালাহ, পৃ: ৩৮২।

[16] আবু নু‘আইম আল-ইসপাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া ৯/১৬৫; খতীব বাগদাদী, আল-জামিয় লি-আখলাকির রাবী ২/১৩; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১১/২১৩।

[17] ইবনু রাজাব, শারহু ইলালিত তিরমিযী, পৃ: ৫৭।

[18] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/২৯৭, খতীব বাগদাদী, আল-জামিয় লি-আখলাকির রাবী ২/১২।

[19] খতীব বাগদাদী, আল-কিফাইয়াতু ফী ইলমির রিওয়াইয়া পৃ: ১১৭।