হাদীসের নামে জালিয়াতি ৩. মিথ্যা প্রতিরোধে সাহাবীগণ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

‘ওহী’র জ্ঞান সাধারণ মানবীয় জ্ঞানের অতিরিক্ত, কিন্তু কখনোই মানবীয় জ্ঞানের বিপরীত বা বিরুদ্ধ নয়। অনুরূপভাবে হাদীসের মাধ্যমে প্রাপ্ত ‘ওহী’ কুরআনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ‘ওহী’র ব্যাখ্যা, সম্পূরণ বা অতিরিক্ত সংযোজন হতে পারে, কিন্তু কখনোই তা কুরআনের বিপরীত বা বিরুদ্ধ হতে পারে না।

সাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি থেকে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা এ সব মূলনীতির ভিত্তিতে বর্ণিত হাদীসের অর্থগত নিরীক্ষা করতেন। আমরা দেখেছি যে, সাধারণভাবে তাঁরা কুরআনের অতিরিক্ত ও সম্পূরক অর্থের জন্যই হাদীসের সন্ধান করতেন। কুরআন কারীমে যে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই তা হাদীসে আছে কিনা তা জানতে চাইতেন। পাশাপাশি তাঁরা প্রদত্ত তথ্যের অর্থগত নিরীক্ষা করতেন। তাঁদের অর্থ নিরীক্ষা পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপ:

(১) হাদীসের ক্ষেত্রে প্রথম বিবেচ্য হলো, তা রাসূলুল্লাহ ()-এর কথা বলে প্রমাণিত কিনা। যদি বর্ণনাকারীর বর্ণনা, শপথ বা অন্যান্য সাক্ষ্যের মাধ্যমে নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয় যে, কথাটি রাসূলুল্লাহ () বলেছেন, তবে সেক্ষেত্রে তাঁদের নীতি ছিল তাকে কুরআনের সম্পূরক নির্দেশনা হিসাবে গ্রহণ করা এবং তারই আলোকে কুরআনের ব্যাখ্যা করা। ইতোপূর্বে দাদীর উত্তরাধিকার ও গৃহে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার বিষয়ে আমরা তা দেখতে পেয়েছি। দাদীর বিষয়ে কুরআনে কিছু বলা হয় নি। এক্ষেত্রে হাদীসের বিবরণটি অতিরিক্ত সংযোজন। অনুমতি প্রার্থনার ক্ষেত্রে কুরআনে বলা হয়েছে যে, অনুমতি চাওয়ার পরে ‘‘যদি তোমাদেরকে বলা হয় যে, ‘তোমরা ফিরে যাও’ তবে তোমরা ফিরে যাবে।’’[1] এক্ষেত্রে হাদীসের নির্দেশনাটি বাহ্যত এ কুরআনী নির্দেশনার ‘বিরুদ্ধ’। কারণ তা কুরআনী নির্দেশনাকে আংশিক পরিবর্তন করে বলছে যে, তিন বার অনুমতি প্রার্থনার পরে ‘তোমরা ফিরে যাও’ বলা না হলেও ফিরে যেতে হবে।

সাহাবীগণ উভয় হাদীসকে কুরআনের ব্যাখ্যা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা কখনোই চিন্তা করেন নি যে, এগুলো কুরআনের নির্দেশের বিপরীত, বিরুদ্ধ বা অতিরিক্ত কাজেই তা গ্রহণ করা যাবে না।

(২) কোনো কথা রাসূলুল্লাহ () বলেন নি বলে প্রমাণিত হলে বা গভীর সন্দেহ হলে, কোনোরূপ অর্থ বিবেচনা না করেই তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমরা দেখেছি যে, বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততায় ও নির্ভরযোগ্যতায় সন্দেহ হলে তাঁরা কোনোরূপ অর্থ বিবেচনা ছাড়াই সে বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করতেন।

(৩) কখনো দেখা গিয়েছে যে, বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততার কারণে বর্ণিত হাদীস বাহ্যত গ্রহণযোগ্য। তবে বর্ণনাকারীর অনিচ্ছাকৃত ভুলের জোরালো সম্ভাবনা বিদ্যমান রয়েছে। সেক্ষেত্রে তাঁরা সে হাদীসের অর্থ কুরআন কারীম ও তাঁদের জানা হাদীসের আলোকে পর্যালোচনা করেছেন এবং হাদীসটির অর্থ কুরআন ও প্রসিদ্ধ সুন্নাতের সুস্পষ্ট বিপরীত হলে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এরূপ অর্থ বিচার ও নিরীক্ষার কয়েকটি উদাহরণ দেখুন:

১. আবু হাস্সান আল-আ’রাজ নামক তাবিয়ী বলেন:

إنَّ رَجُلَيْنِ دَخَلا عَلَى عَائِشَةَ فَقَالا: إِنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ يُحَدِّثُ أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ ﷺ كَانَ يَقُولُ: إِنَّمَا الطِّيَرَةُ فِي الْمَرْأَةِ وَالدَّابَّةِ وَالدَّارِ. قَالَ: فَطَارَتْ شِقَّةٌ مِنْهَا فِي السَّمَاءِ وَشِقَّةٌ فِي الأَرْضِ!- وفي رواية: فَغَضِبَتْ غَضَبًا شَدِيدًا فَطَارَتْ شُقَّةٌ مِنْهَا فِي السَّمَاءِ وَشُقَّةٌ فِي الأَرْضِ!- فَقَالَتْ: وَالَّذِي أَنْزَلَ الْقُرْآنَ عَلَى أَبِي الْقَاسِمِ ﷺ مَا هَكَذَا كَانَ يَقُولُ، وَلَكِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ ﷺ كانَ يَقُولُ: "كَانَ أَهْلُ الْجَاهِلِيَّةِ يَقُولُونَ الطِّيَرَةُ فِي الْمَرْأَةِ وَالدَّارِ وَالدَّابَّةِ"، ثُمَّ قَرَأَتْ عَائِشَةُ: مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الأَرْضِ وَلا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلا فِي كِتَابٍ.

‘‘দুই ব্যক্তি আয়েশা (রা) -এর কাছে গমন করে বলেন: আবু হুরাইরা (রা) বলছেন যে, নাবীউল্লাহ () বলেছেন: নারী, পশু বা বাহন ও বাড়ি-ঘরের মধ্যে অযাত্রা ও অশুভত্ব আছে। একথা শুনে আয়েশা (রা) এত বেশি রাগন্বিত হন যে, মনে হলো তাঁর দেহ ক্রোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি বলেন: আবুল কাসিম ()-এর উপর যিনি কুরআন নাযিল করেছেন তাঁর কসম, তিনি এভাবে বলতেন না। নাবীউল্লাহ () বলতেন: ‘‘জাহিলিয়্যাতের যুগের মানুষেরা বলত: নারী, বাড়ি ও পশু বা বাহনে অশুভত্ব আছে। এরপর আয়েশা (রা) কুরআন কারীমের আয়াত তিলাওয়াত করেন:[2] ‘‘পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদিগের উপর যে বিপর্যয় আসে আমি তা সংঘটিত করবার পূর্বেই তা লিপিবদ্ধ থাকে।’’[3]

এখানে আয়েশা (রা) আবু হুরাইরা (রা) এর বর্ণনা গ্রহণ করেন নি। তিনি রাসূলুল্লাহ () থেকে যা শুনেছেন এবং কুরআনের যে আয়াত পাঠ করেছেন তার আলোকে এ বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

২. আমরাহ বিনতু আব্দুর রাহমান বলেন:

أَنَّهَا سَمِعَتْ عَائِشَةَ وَذُكِرَ لَهَا أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ يَقُولُ: (سمعت رسول الله ﷺ يقول) إِنَّ الْمَيِّتَ لَيُعَذَّبُ بِبُكَاءِ الْحَيِّ فَقَالَتْ عَائِشَةُ: يَغْفِرُ اللَّهُ لأَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَمَا إِنَّهُ لَمْ يَكْذِبْ وَلَكِنَّهُ نَسِيَ أَوْ أَخْطَأَ (وَلَكِنَّ السَّمْعَ يُخْطِئُ) (وَلَكِنَّهُ وَهِمَ)؛ إِنَّمَا مَرَّ رَسُولُ اللَّهِ عَلَى يَهُودِيَّةٍ يُبْكَى عَلَيْهَا فَقَالَ: "إِنَّهُمْ لَيَبْكُونَ عَلَيْهَا وَإِنَّهَا لَتُعَذَّبُ فِي قَبْرِهَا" (لا تزر وازرة وزر أخرى).

আয়েশা (রা)-এর কাছে উল্লেখ করা হয় যে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) রাসূলুল্লাহ থেকে বর্ণনা করছেন যে, ‘জীবিতের ক্রন্দনে মৃতব্যক্তি শাস্তি পায়।’ তখন আয়েশা (রা) বলেন: আল্লাহ ইবনু উমারকে ক্ষমা করুন। তিনি মিথ্যা বলেন নি। তবে তিনি বিস্মৃত হয়েছেন বা ভুল করেছেন (দ্বিতীয় বর্ণনায়: শুনতে অনেক সময় ভুল হয়)। প্রকৃত কথা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ইহুদী মহিলার (কবরের) কাছ দিয়ে গমন করেন, যার জন্য তার পরিজনেরা ক্রন্দন করছিল। তিনি তখন বলেন: ‘এরা তার জন্য ক্রন্দন করছে এবং সে তার কবরে শাস্তি পাচ্ছে।’ আল্লাহ বলেছেন[4]: ‘এক আত্মা অন্য আত্মার পাপের বোঝা বহন করবে না।’’’[5]

৩. ফাতিমা বিনতু কাইস (রা) নামক একজন মহিলা সাহাবী বলেন, তাঁর স্বামী তাঁকে তিন তালাক প্রদান করেন। তখন রাসূলুল্লাহ () বলেন যে, তিনি (সে মহিলা) ইদ্দত-কালীন আবাসন ও ভরণপোষণের খরচ পাবেন না। তাঁর এ কথা শুনে খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন:

لا نَتْرُكُ كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّنَا لِقَوْلِ امْرَأَةٍ لا نَدْرِي لَعَلَّهَا حَفِظَتْ أَوْ نَسِيَتْ (لا نَدْرِي أَحَفِظَتْ أَمْ نَسِيَتْ)، لَهَا السُّكْنَى وَالنَّفَقَةُ قَالَ اللَّهُ: لا تُخْرِجُوهُنَّ مِنْ بُيُوتِهِنَّ وَلا يَخْرُجْنَ إِلا أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ

‘‘আমরা আল্লাহর গ্রন্থ ও আমাদের নবী ()-এর সুন্নাত একজন মহিলার কথায় ছেড়ে দিতে পারি না; আমরা বুঝতে পারছি না যে, তিনি বিষয়টি মুখস্থ রেখেছেন না ভুলে গিয়েছেন। তিন-তালাক প্রাপ্ত মহিলাও ইদ্দত-কালীন আবাসন ও খোরপোশ পাবেন। আল্লাহ বলেছেন[6]: ‘‘তোমরা তাদেরকে তাদের বাসগৃহ থেকে বহিষ্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয়, যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়।’’[7]

৪. অর্থগত নিরীক্ষার আরেকটি উদাহরণে আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস যখন তাবিয়ী ইবনু আবী মুলাইকার জন্য ‘আলীর বিচার’ পুস্তিকা থেকে কিছু বিবরণ নির্বাচন করেন, তখন তিনি কিছু কিছু বিচারের বিষয়ে বলেন: ‘‘আল্লাহর কসম, আলী এ বিচার কখনোই করতে পারেন না। বিভ্রান্ত না হলে কেউ এ বিচার করতে পারে না।’’

এখানেও আমরা দেখছি যে, ইবনু আববাস অর্থ বিচার করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, এগুলো আলী (রা)-এর নামে বানোয়াট কথা; কারণ কোনো বিভ্রান্ত মানুষ ছাড়া এরূপ বিচার কেউ করতে পারে না।

[1] সূরা (২৪) নূর: ২৮ আয়াত।

[2] সূরা (৫৭) আল-হাদীদ, আয়াত ২২।

[3] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৬/১৫০, ২৪৬।

[4] সূরা (৬) আন‘আম: ১৬৪; সূরা (১৭) ইসরা (বানী ইসরাঈল): ১৫; সূরা (৩৫) ফাতির: ১৮; সূরা (৩৯) যুমার: ৭: সূরা (৫৩) নাজম: ৩৮ আয়াত।

[5] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৪০-৬৪৩, তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৩৩৭।

[6] সূরা (৬৫) তালাক: আয়াত ১।

[7] মুসলিম, আস-সহীহ ২/১১১৮, আবু দাউদ, আস-সুনান ২/২৯৭।