ব্যাংকের সুদ কি হালাল সূচি ও বিবরন শাইখ মুশ্তাক আহমাদ কারীমী ১ টি
৩- টাকা জমাকর্তাদের সহিত ব্যাংকের সম্পর্ক

ব্যাংকে যারা টাকা জমা রাখে, সে টাকা তারা ব্যাংকে ঋণস্বরূপ প্রদান করে, নাকি আমানতস্বরূপ গচ্ছিত রাখে তা প্রথমে নির্ধারণ হওয়া উচিত। এবারে আমানতস্বরূপ যে জিনিস রাখা হয়, তা চুরি হয়ে গেলে, পুড়ে গেলে বা কোন প্রকার নষ্ট হয়ে গেলে আমানতদার (যার কাছে আমানত রাখা হয় সে) এ জিনিসের জমানত বা দায়িত্ব নেয় না। তার জন্য সে গচ্ছিত (বিনিমেয়) জিনিস ফিরিয়ে দেওয়াও জরুরী নয়। তবে হ্যাঁ, সে যদি আমানতে খেয়ানত করে (নষ্ট করে) বা রক্ষণা-বেক্ষণে অবহেলা ও ত্রুটি প্রদর্শন করে, তাহলে কিন্তু সে এ জিনিসের যামিন হবে এবং তাকে তার খেসারত আদায় করতে হবে। আর এতে কোন দ্বিমত নেই যে, ব্যাংক জমাকর্তাদের টাকার যামিন থাকে। সুতরাং বুঝা গেল কোন অবস্থাতেই সে টাকা ব্যাংকের নিটক আমানতস্বরূপ নয়। আর যে ব্যক্তি যে জিনিসের যামিন হয়, সে তার লাভনোকসানের অধিকারীও হয়। কেননা নবী করীম (ﷺ) বলেন, الخراج بالضمان অর্থাৎ, যমানত নেওয়ার কারণেই ক্ষতিপুরণ (যামিনদারের দায়িত্ব)।[1]

পক্ষান্তরে যদি ব্যাংকের নিকট অলঙ্কার, সোনারূপা মণিমুক্তা বা জমি ইত্যাদির কাগজ-পত্র (লকে) রাখা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে উক্ত জিনিসগুলো আমানত গণ্য হবে এবং সে গুলোকে ঠিক যেরূপে রাখা হয়েছিল সেরূপেই আমানতকারীকে ফেরৎ দেওয়া ব্যাংকের জন্য জরুরী।

এতদ্ব্যতীত এ কথাও বলা যথার্থ নয় যে, ‘ব্যাংকে টাকা জমাকর্তা যে ব্যাংককে ঋণ দিচ্ছে---সে কথা ঘুণাক্ষরে আদৌ কল্পনা করে না। তাছাড়া ব্যাংক তো কোটি কোটি টাকার মালিক। অতএব তাকে ঋণ দেওয়ার কথা ধারণা বহির্ভূত। (আর ব্যাংক কারো নিকট ঋণ চাইতেও যায় না।)’ এরূপ বলা যথার্থ নয় এই জন্য যে, ঋণ দেওয়া-নেওয়ার শর্তাবলীতে কেবল ধনীরাই গরীবদেরকে ঋণ দেবে---এ কথা নেই। গরীব মানুষও ধনীকে ঋণ দিতে পারে। যেমন মুখাপেক্ষী মানুষ চির অমুখাপেক্ষী প্রতিপালক আল্লাহকে ঋণ দিয়ে থাকে।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

﴿مَنْ ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللهَ قَرْضاً حَسَناً﴾

অর্থাৎ, কে আছে যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে?[2]

এ ছাড়া ঋণ দেওয়া-নেওয়ার শর্তাবলীর পর্যায়ভুক্ত এ কথাও নয় যে, উভয় পক্ষকে ঋণ মনে করে অর্থ দিতে অথবা নিতে হবে। কারণ কখনো কখনো আমানতের মাল ঋণের রূপ পরিগ্রহ করে---যদিও মালের মালিকের ঋণ দেওয়ার নিয়ত থাকে না। যেমন, আমানতদার যখন আমানতের মালে তার নিজস্ব অধিকার প্রয়োগ (তাসার্রুফ) করবে---যেমন ব্যাংক করে থাকে, তখন এ আমানত ঋণরূপে পরিগণিত হয়ে যাবে এবং আমানতদারকে আমানতকারী (জমাকর্তার মালের ক্ষতি হলে) ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। অর্থাৎ আমানতের মাল তার ঘাড়ে ঋণের বোঝাস্বরূপ চেপে যাবে।

এ ক্ষেত্রে এ কথা বিবেচ্য নয় যে, আমানতদার আমানতকারীর অনুমতিক্রমে তার মালে নিজের অধিকার প্রয়োগ করেছে অথবা তার অনুমতি ছাড়াই কোন প্রকার ‘তাসার্রুফ’ করেছে? দৃষ্টান্ত স্বরূপ, যুবাইর (রাঃ) এর লেন-দেন-পদ্ধতি লক্ষণীয়; লোকেরা যখন তাঁর নিকট নিজেদের মাল আমানত রাখতে আসত, তখন তিনি সে মাল আমানত হিসাবে না নিয়ে ঋণ হিসাবে গ্রহণ করতেন। কারণ তিনি এই আশঙ্কা করতেন যে, যদি কোন প্রকারে সে মাল নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে আমানতের অবস্থায় আমানতকারীরই নোকসান যাবে। পক্ষান্তরে ঋণ হিসাবে গ্রহণ করলে তাঁকে সে মাল অবশ্যই ফেরৎ দিতে হবে।

তাছাড়া এ কথাও সকলের বিদিত যে, ব্যাংকের সাথে লেনদেনকারীদের যে সম্পর্ক তা হল ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার সম্পর্ক। অর্থাৎ উভয়ের আদানপ্রদান ঋণদাতা ও গ্রহীতার মতই হয়ে থাকে। আর এ কথার সত্যতা ব্যাংকের সেই হিসাব-বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠে যা ব্যাংকের তরফ থেকে তার আমানতকারীদের নামে প্রত্যেক বছর প্রকাশ করা হয়। অথবা ব্যাংক সরকারের নিকট যে বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করে তাতেও এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায়।

[1] (আবু দাঊদ ৩৫১০নং, নাসাঈ ২/২১৫, ইবনে মাজাহ ২২৪৩নং, হাকেম ২/১৫, আহমদ ৬/৪৯, দারাকুত্বনী ৩১১নং, ইবনে হিববান ১১২৫ নং)

[2] (সূরা বাকারাহ ২৪৫ আয়াত)