নাবী (ﷺ) যখন তায়েফের যুদ্ধ হতে মদ্বীনায় ফেরত আসলেন এবং নবম হিজরী সাল শুরু হল তখন তিনি যাকাতের মাল সংগ্রহ করার জন্য কর্মচারীদেরকে বিভিন্ন আরব গোত্রের নিকট প্রেরণ করলেন। উয়াইনা বিন হিসন (রাঃ) কে পাঠালেন বনী তামীম গোত্রের নিকট, আদী বিন হাতিমকে পাঠালেন তাঈ ও বনী আসাদ গোত্রের নিকট এবং মালিক বিন নুওয়াইরাকে পাঠালেন বনী হানযালার নিকট। বনী সা’দ গোত্রের যাকাত আদায়ের দায়িত্ব দুইজন লোকের উপর ভাগ করে দিলেন। বনী সা’দ গোত্রের এক অংশের যাকাত উসুল করার জন্য পাঠালেন যাবারকান বিন বদরকে আর অন্য দিকে পাঠালেন কায়েস বিন আসেম (রাঃ) কে। বাহরাইনের যাকাত উসুল করার জন্য পাঠালেন আলা ইবনুল হাযরামী (রাঃ) কে। আর নাজরানের যাকাত আদায়ের জন্য পাঠালেন আলী বিন আবু তালেব (রাঃ) কে।

এই বছর তথা হিজরী নবম সালের রজব মাসে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মদ্বীনায় এ সময় মানুষের মধ্যে খুব অভাব বিরাজ করছিল। দেশে তখন অনাবৃষ্টিও দেখা দিয়েছিল। ঐ দিকে আবার মৌসুমের ফল পাকারও সময় হয়ে গিয়েছিল। নাবী (ﷺ) যখন কোন অভিযানে বের হওয়ার ইচ্ছা করতেন, তখন কোন দিকে যাচ্ছেন, তা সুস্পষ্ট করে বলতেন না। কিন্তু তাবুক যুদ্ধে বের হওয়ার পূর্বে সুস্পষ্ট করেই বলে দিলেন। কারণ তাবুক মদ্বীনা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এবং তখন সময়টিও ছিল অভাবের।

একদিন তিনি জুদ্ বিন কায়েসকে লক্ষ্য করে বললেন- এ বছর বনুল আসফার (রোমানদের) মুকাবেলা করার জন্য বের হবে কি? সে বলল- হে আল্লাহর রসূল! আমাকে মদ্বীনায় থাকার অনুমতি দিন এবং আমাকে ফিতনায় নিপতিত করবেন না। সকলেই জানে যে, আমি নারীদের প্রতি সর্বাধিক আশক্ত। আমার আশঙ্কা আমি যদি রোমানদের মেয়েদেরকে দেখি, তাহলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবনা। তার এই কথা শুনে রসূল (ﷺ) মুখ ফিরিয়ে নিলেন। রসূল (ﷺ) তাকে না যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তার এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কুরআনের এই আয়াত নাযিল হয়-


وَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ ائْذَنْ لِي وَلا تَفْتِنِّي أَلا فِي الْفِتْنَةِ سَقَطُوا وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمُحِيطَةٌ بِالْكَافِرِينَ


‘‘আর তাদের কেউ বলে, আমাকে (যুদ্ধে যাওয়া হতে) অব্যাহতি দিন এবং ফিতনায় নিপতিত করবেন না। শুনে রাখ, তারা তো পূর্ব থেকেই ফিতনায় নিপতিত এবং নিঃসন্দেহে জাহান্নাম এই কাফেরদের পরিবেষ্টন করে রয়েছে’’।[1] মুনাফেকদের একদল পরস্পর বলাবলি করতে লাগল- তোমরা এই প্রচন্ড গরমের মধ্যে যুদ্ধের জন্য বের হয়োনা। তখন আল্লাহ্ তা‘আলা এই আয়াত নাযিল করেনঃ


فَرِحَ الْمُخَلَّفُونَ بِمَقْعَدِهِمْ خِلافَ رَسُولِ اللهِ وَكَرِهُوا أَنْ يُجَاهِدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللهِ وَقَالُوا لا تَنْفِرُوا فِي الْحَرِّ قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ


‘‘পেছনে থেকে যাওয়া লোকেরা আল্লাহর রসূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে থাকতে পেরে আনন্দ লাভ করেছে; আর জান ও মালের দ্বারা আল্লাহর রাহে জিহাদ করতে অপছন্দ করেছে এবং বলেছে, এই গরমের মধ্যে অভিযানে বের হয়োনা। বলে দাও, উত্তাপে জাহান্নামের আগুন প্রচ-তম। যদি তাদের বিবেচনা শক্তি থাকত’’।[2]

নাবী (ﷺ) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের আদেশ দিলেন। ধনী সাহাবীদেরকে এই পথে খরচ করার উৎসাহ দিলেন। উছমান (রাঃ) সাজ ও সামানসহ তিনশত উট এবং এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা আল্লাহর রাস্তায় দান করলেন। এই সময় কিছু লোক কাঁদতে কাঁদতে রসূল (ﷺ)-এর খেদমতে হাজির হলেন। তারা ছিলেন সংখ্যায় সাতজন। তারা রসূল (ﷺ)-এর কাছে বাহনের আবেদন করছিলেন। তিনি বলেছিলেন-


لا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلا يَجِدُوا مَا يُنْفِقُونَ


‘‘আমার কাছে এমন কোন বস্ত্ত নেই যে, তার উপর তোমাদের সওয়ার করাব। তখন তারা ফিরে গেছে অথচ তখন তাদের চোখ দিয়ে অশ্রম্ন বইছিল, এ দুঃখে যে, তারা এমন কোন বস্ত্ত পাচ্ছে না যা ব্যয় করবে’’।[3]

এই সময় আবু মুসা আশআরীর সাথীগণ আবু মুসা (রাঃ) কে রসূল (ﷺ)-এর নিকট পাঠালেন, যাতে তিনি তাদের বাহনের ব্যবস্থা করেন। ঐ সময় তিনি রসূান্বিত ছিলেন। তাই তিনি রসূান্বিত অবস্থায় শপথ করে বললেন যে, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের সওয়ারীর ব্যবস্থা করবনা। তা ছাড়া আমার কাছে সওয়ারীর কোন ব্যবস্থাও নেই। এরপরই কিছু উট নাবী (ﷺ)-এর কাছে এসে গেল। এবার তার রসূ থেমে গেল। তাই তাদেরকে ডেকে পাঠালেন এবং তাদের বাহনের ব্যবস্থা করলেন। অতঃপর তিনি বললেন- আমি তোমাদেরকে বাহন দেইনি; বরং আল্লাহই তোমাদের বাহনের ব্যবস্থা

করেছেন। আর আমি যখন কোন বিষয়ে কসম করি, তখন যদি এর বিপরীত করার মধ্যেই কল্যাণ দেখতে পাই, তাহলে আমি শপথের কাফ্ফারা আদায় করি এবং ভাল কাজটিই করি।

রসূল (ﷺ) তাবুক যুদ্ধে বের হওয়ার পূর্বে উলবাহ বিন যায়েদ রাতে দাঁড়িয়ে সলাত পড়লেন এবং কেঁদে কেঁদে বললেন- হে আল্লাহ্! তুমি জিহাদের আদেশ দিয়েছ। আর তোমার রসূলকে এমন সামর্থ দাওনি যে, তিনি আমাকে সাথে নিয়ে যাবেন। এরপর তিনি বললেন- হে আল্লাহ্! আমি যেহেতু জিহাদে বের হওয়ার অযোগ্য, তাই আমি তোমার রাস্তায় প্রত্যেক ঐ মুসলিমের জুলুমের বদলা নেওয়া সাদকা করে দিচ্ছি, (প্রতিশোধ নেওয়া ছেড়ে দিচ্ছি) যা তার হাত দ্বারা আমার উপর করা হয়েছে। চাই সেই জুলুম আমার মালের মধ্যে হোক কিংবা জানের মধ্যে কিংবা ইজ্জত-আবরুর মধ্যে হোক। সকাল হলে রসূল (ﷺ) বললেন- আজ রাতে সাদকাকারী কোথায়? কেউ উঠে দাঁড়ালো না। তিনি পুনরায় একই কথা বললেন। এবার উলবাহ বিন যায়েদ দাঁড়ালেন এবং রসূল (ﷺ) কে স্বীয় ঘটনা খুলে বললেন। তিনি তখন উলবাহ (রাঃ) কে বললেন- সুসংবাদ গ্রহণ কর। ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ রয়েছে, আজ রাতে তোমার দু’আকে সাদকায়ে মাকবুলা হিসাবে লিখা হয়েছে।

তাবুক যুদ্ধের প্রাক্কালে গ্রাম্য মুনাফেকরা রসূল (ﷺ) এর কাছে আগমণ করে যুদ্ধে না যাওয়ার অনুমতি চাইল। কিন্তু তিনি তাদেরকে অনুমতি দেন নি। সে সময় মুনাফেক সরদার আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই একদল মুনাফিক ও ইহুদীসহ ছানিয়াতুল ওয়াদায় অবস্থান করছিল। বলা হয় যে, তার বাহিনী দুই বাহিনীর চেয়ে কম ছিলনা। বের হওয়ার পূর্বে রসূল (ﷺ) মুহাম্মাদ বিন মাসলামাকে মদ্বীনার খলীফা নিযুক্ত করলেন। মুসলিম বাহিনী যখন রওয়ানা হল, তখন আব্দুল্লাহ্ ইবনে উবাই পিঠ টান দিল। আলী ইবনে আবু তালেবকে রেখে গেলেন আহলে বাইতের নারী ও শিশুদের দেখা-শুনার দায়িত্বে। আলী (রাঃ) তখন বললেন- হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে নারী ও শিশুদের সাথে রেখে যাচ্ছেন? তিনি তখন আলী (রাঃ) কে বললেন- তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, আমার নিকট তোমার মর্যাদা ঠিক সে রকমই, যেমন ছিল হারুন (আঃ) এর মর্যাদা মুসার নিকট। তবে আমার পর আর কোন নাবী নেই।[4]


এই যুদ্ধে কতিপয় মুসলমানও পিছনে রয়ে গিয়েছিল। তবে তাদের পিছিয়ে থাকা ঈমানের ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের কারণে ছিলনা। যারা পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন কা’ব বিন মালেক, হিলাল বিন উমাইয়াহ, মুরারা বিন রবীআ, আবু খাইছামাহ এবং আবু যার্ (রাঃ) । তবে আবু খাইছামা এবং আবু যার্ গিফারী (রাঃ) পরে রসূল (ﷺ)-এর সাথে মিলিত হয়েছিল।

এই যুদ্ধে নাবী (ﷺ)-এর সাথে ত্রিশ হাজার মুজাহিদের এক বিশাল বাহিনী ছিল। তার মধ্যে অশ্বারোহী বাহিনী ছিল দশ হাজার। তাবুকে পৌঁছে তিনি বিশ দিন অবস্থান করেন। এ সময় তিনি সলাত কসর করতেন। রোমের বাদশা হিরাক্লিয়াস তখন হিমস নগরীতে অবস্থানরত ছিল।

তাবুক যুদ্ধে আবু খায়ছামার অংশগ্রহণের ঘটনা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নাবী (ﷺ) মদ্বীনা হতে বের হওয়ার কয়েক দিন পর আবু খায়ছামা স্বীয় ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন ছিল প্রচন্ড গরম। তিনি দেখলেন, তার স্ত্রীদ্বয় তার বাগানে তাঁবু স্থাপন করে তাতে অবস্থান করছে। তাদের প্রত্যেকেই তাঁবুতে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে তাঁবুকে ঠান্ডা করে রেখেছে এবং তাঁর জন্য ঠান্ডা পানি প্রস্ত্তত করে রেখেছে। তারা তাঁর জন্য সুন্দর খানাও তৈরী করে রেখেছে। তিনি যখন ঘরে প্রবেশ করে সুন্দরী স্ত্রীদের প্রতি এবং তার জন্য প্রস্ত্তত কৃত খাদ্যসামগ্রীর দিকে তাকালেন, তখন মনে মনে বলতে লাগলেনঃ রসূল (ﷺ) দ্বিপ্রহরে পথ চলছেন ও গরম সহ্য করছেন। আর আবু খায়ছামা ঠান্ডা ছায়া, সুস্বাদু খাদ্য এবং সুন্দরী নারী উপভোগ করছে। এটি ইনসাফের বিষয় হতে পারেনা। অতঃপর তিনি বললেন- আল্লাহর শপথ! রসূল (ﷺ) এর সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমাদের কারও তাঁবুতে প্রবেশ করবনা।

সুতরাং তোমরা আমার জন্য সফর সামগ্রী তৈরী কর। তারা তাই করল। তিনি বাহনে আরোহন করে বেরিয়ে পড়লেন। তাবুকে পৌঁছে তিনি রসূল (ﷺ) এর সাথে মিলিত হলেন।

রাস্তায় তার সাথে উমায়ের বিন ওয়াহাবের সাক্ষাৎ হল। তিনিও রসূল (ﷺ) এর সন্ধানে ছিলেন। তারা পরস্পর সফরসঙ্গী হয়ে গেল। তারা যখন তাবুকের নিকটে পৌঁছলেন তখন আবু খায়ছামা উমায়ের বিন ওয়াহাবকে বললেন- আমি রসূল (ﷺ) থেকে পিছিয়ে থেকে বিরাট একটি ভুল (পাপ) করেছি। সুতরাং এখন থেকে রসূল (ﷺ) এর সাথে সাক্ষাত না করা পর্যন্ত আমার থেকে তুমি আলাদা হওয়াতে দোষের কিছু নেই। তাই উমায়ের সরে পড়ল। তাবুকের নিকটবর্তী হলে লোকেরা বলতে লাগল- এই তো রাস্তায় একজন আরোহীকে আগমণ করতে দেখা যাচ্ছে। রসূল (ﷺ) তখন বললেন- সম্ভবতঃ এই লোক আবু খায়ছামাই হবে। লোকেরা তখন বলল- আল্লাহর শপথ! এ তো দেখছি আবু খায়ছামা। বাহন থেকে নেমে তিনি রসূল (ﷺ)-এর দিকে এগিয়ে সালাম দিলেন এবং তাঁর ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনালেন। অতঃপর নাবী (ﷺ) তাঁর ব্যাপারে ভাল কথা বললেন এবং তার জন্য দু’আ করলেন।


তাবুকের পথে তিনি যখন ছামুদ জাতির ঘরবাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি বললেন- তোমরা এখানকার পানি পান করোনা এবং এর দ্বারা সলাতের ওযূ করোনা। এখানকার পানি দিয়ে তোমরা যেই আটা গুলেছ, তা তোমরা উটকে খাইয়ে দাও। এ থেকে তোমরা নিজেরা কিছুই খেয়োনা। আর তোমাদের কেউ যেন সাথে কাউকে না নিয়ে বাইরে না যায়। বনী সায়েদা গোত্রের দুই লোক ব্যতীত বাকী সকলেই তাঁর কথা তামিল করল। ঐ দুই জনের একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য বাইরে গেল, অন্যজন তার উটের সন্ধানে বের হল। যে ব্যক্তি পায়খানা করার জন্য একা বের হয়েছিল, সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পায়খানার স্থানে পড়ে রইল আর যে ব্যক্তি উটের সন্ধানে বের হয়েছিল, বাতাস তাকে উঠিয়ে নিয়ে তাইয়ের পাহাড়ে নিক্ষেপ করল। রসূল (ﷺ) যখন এই খবর শুনলেন তখন বললেন- আমি কি তোমাদেরকে একাকী বের হতে নিষেধ করিনি? অতঃপর যে ব্যক্তি পায়খানা করতে গিয়ে শ্বাসরূদ্ধ হয়ে আটকা পড়ে ছিল, তিনি তার জন্য দু’আ করলে সে ভাল হয়ে গেল। আর দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বনী তাইয়ের লোকেরা নাবী (ﷺ)-এর কাছে মদ্বীনায় ফেরত পাঠাল।

ইমাম জুহরী (রহঃ) বলেন- নাবী (ﷺ) যখন ছামুদ গোত্রের হিজর অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তখন তিনি স্বীয় কাপড় দিয়ে চেহারা মুবারক ঢেকে নিলেন এবং বাহনকে দ্রুত চালালেন। অতঃপর তিনি বললেন- জালেমদের অঞ্চলের উপর দিয়ে চলার সময় তোমরা ক্রন্দন অবস্থায় চল। কেননা তারা যেই আযাবে আক্রান্ত হয়েছিল, তোমাদেরও সেই আযাবে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, সেই স্থানের পানি দিয়ে যারা আটা গুলেছিল, তাদেরকে তিনি সেই আটা উটকে খাওয়াতে বলেছিলেন এবং পানি ঢেলে দিতে বলেছিলেন। তিনি সাহাবীদেরকে সেই কুঁপ থেকে পানি সংগ্রহ করার আদেশ দিলেন, যাতে সালেহ (আঃ) এর উটনী অবতরণ করত।


ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক (রহঃ) বলেন- সে দিন সকাল বেলা মানুষের কাছে কোন পানি ছিলনা। রসূল (ﷺ) এর কাছে পানি না থাকার অভিযোগ করা হলে তিনি বারগাহে ইলাহীতে পানির জন্য দু’আ করলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা এক খন্ড মেঘ পাঠিয়ে দিলেন। মেঘ খন্ডটি হতে এত বৃষ্টি বর্ষিত হল যে, লোকেরা পরিতৃপ্ত হল। প্রয়োজন অনুসারে তারা পানি সঞ্চয়ও করে রাখল।

অতঃপর নাবী (ﷺ) চলতে লাগলেন। কোন কোন সাহাবী তাঁর পিছনে রয়ে গেল। লোকেরা তখন বলতঃ উমুক পিছনে রয়ে গেছে। বলা হল- আবু যারও পিছনে রয়ে গেছে। তিনি যুদ্ধে বের হন নি। তিনি তখন বলতেন- তাকে ছাড়, তার মধ্যে কোন কল্যাণ থাকলে অচিরেই আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে তোমাদের সাথে মিলিয়ে দিবেন। আর অন্য কিছু থাকলে আল্লাহ্ তা‘আলা তার থেকে তোমাদেরকে মুক্তি দিবেন।

আসল কথা হল আবু যার্ গিফারী (রাঃ) এর উট খুব ধীর গতিতে চলছিল। যার কারণে তিনি সাথীদের সাথে চলতে পারেন নি। তাই তিনি উটের পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে নিজের পিঠে বহন করতে লাগলেন এবং একাই তাবুকের পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এটিই ছিল তার পিছনে পড়ার একমাত্র কারণ। রাস্তার কোন এক স্থানে যখন রসূল (ﷺ) অবতরণ করলেন, তখন এক ব্যক্তি বলল- হে আল্লাহর রসূল! ঐ দেখুন! একজন লোক রাস্তায় একা চলছে এবং আমাদের দিকেই আগমণ করছে। রসূল (ﷺ) বললেন- ঐ লোকটি আবু যার্ ছাড়া আর কে হবে? তারা গভীরভাবে দৃষ্টি দিয়ে তাকে চিনে ফেলল এবং বলল- হে আল্লাহর রসূল! এ তো দেখছি আসলেই আবু যার্। রসূল (ﷺ) তখন বললেন- আল্লাহ্ তা‘আলা আবু যারের উপর রহম করুন! সে একাকীই চলবে, একাকীই মৃত্যু বরণ করবে এবং কিয়ামতের দিন একাই কবর থেকে পুনরুত্থিত হবে।[5]


সহীহ ইবনে হিববানে বর্ণিত হয়েছে, আবু যার্ (রাঃ) এর যখন মৃত্যুর সময় হল, তখন তাঁর স্ত্রী খুব কাঁদছিলেন। তখন তিনি তার স্ত্রীকে বললেন- তুমি কাঁদছ কেন? স্ত্রী বললেন- আমি কাঁদব না? আপনি একটি নির্জন ভূমিতে মৃত্যু বরণ করছেন! আর আমার কাছে এমন কোন কাপড় নেই, যা আপনার কাফনের জন্য যথেষ্ট হবে। আপনাকে দাফন করার মত শক্তিও আমার নেই এবং সহযোগীতা করার মত কোন লোকও এখানে নেই। আবু যার্ তখন বললেন- তুমি কেঁদ না। কেননা আমি রসূল (ﷺ) কে এমন একদল লোককে লক্ষ্য করে বলতে শুনেছি, যাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। তিনি বলেছেন- তোমাদের মধ্যে হতে একজন লোক নির্জন ভূমিতে মৃত্যু বরণ করবে। তথাপি তার জানাযার সলাতে মুসলিমদের একটি জামআত শরীক হবে। আবু যার্ বলেন- ঐ দলের সকলেই মৃত্যু বরণ করেছে। তাদের কেউ এখন জীবিত নেই। একমাত্র আমিই জীবিত আছি। সুতরাং নির্জন ভূমিতে একাকী মৃত্যু বরণকারী আমি ছাড়া আর কেউ বাকী নেই। আল্লাহর শপথ! আমি ভুল বলছিনা, আমার কথা মিথ্যাও নয়। তুমি রাস্তার দিকে খেয়াল রাখ। দেখ! কোন মানুষ দেখা যায় কি না। তাঁর স্ত্রী উম্মে যার্ বললেন- হজ্জের মৌসুম শেষ হয়ে গেছে। হাজীগণ চলে গেছেন, রাস্তা খালী হয়ে গেছে। সুতরাং লোকের সন্ধান পাব কোথায়? আবু যার্ (রাঃ) পুনরায় বললেন- যাও এবং খুঁজে দেখ। তাঁর স্ত্রী বলেন- আমি টিলার উপর দাঁড়িয়ে ধু-ধু মরুভূমির উপর গভীর দৃষ্টি দিতাম, কোন লোকের সন্ধান পাওয়া যায় কি না। কোন মানুষের আভাস না পেয়ে আমি আবু যারের কাছে ফেরত আসতাম এবং তার সেবায় মশগুল হতাম। আমার এবং আবু যারের সময় এভাবেই পার হতে থাকল। হঠাৎ দেখলামঃ কিছু লোক তাদের বাহনসমূহে আরোহন করে পথ চলছে। তাদের বাহনগুলো তাদেরকে নিয়ে কদমতালে চলছে।


উম্মে যার্ (রাঃ) বলেন- তাদের দিকে ইঙ্গিত করতেই তারা আমার দিকে দ্রুত চলে আসল এবং আমার কাছে দাঁড়িয়ে গেল। তারা বলল- হে আল্লাহর বান্দী! তোমার এই দশা কেন? আমি বললাম একজন মুসলিম মৃত্যুর পথে যাত্রা করছে। দয়া করে তার কাফন ও দাফনের কাজে সহায়তা করবেন কি? তারা জিজ্ঞেস করলেন কে সেই ব্যক্তি? উম্মে যার্ বলেন- আমি বললামঃ তিনি হচ্ছেন আবু যার্। অশ্বারোহীগণ বললেন- আল্লাহর রসূলের সাথী আবু যার্? উম্মে যার্ বলেন আমি বললামঃ হ্যাঁ, রসূল (ﷺ) এর সাথী আবু যার্। তারা বললেন- আবু যারের জন্য আমাদের মা-বাপ কোরবান হোক! অতঃপর তারা দ্রুত তাঁর কাছে প্রবেশ করলেন। আবু যার্ তখন বললেন- তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর! আমি রসূল (ﷺ) কে এমন একদল লোককে লক্ষ্য করে বলতে শুনেছি, যাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। তিনি বলেছেন- তোমাদের মধ্য হতে একজন লোক নির্জন ভূমিতে মৃত্যু বরণ করবে। তথাপি তার জানাযার সলাতে মুসলিমদের একটি জামআত শরীক হবে। ঐ দলের সকলেই মৃত্যু বরণ করেছে। তাদের কেউ এখন জীবিত নেই। একমাত্র আমিই জীবিত আছি। সুতরাং নির্জন ভূমিতে একাকী মৃত্যু বরণকারী আমি ছাড়া আর কেউ বাকী নেই। আল্লাহর শপথ! আমি ভুল বলছিনা, আমার কথা মিথ্যাও নয়। আমার কাছে যদি এমন একটি কাপড় থাকত, যা আমার কাফনের জন্য যথেষ্ট কিংবা আমার স্ত্রীর কাছেও যদি আমাকে কাফন দেয়ার মত কোন কাপড় থাকত, তাহলে আমার অথবা আমার স্ত্রীর কাপড় ব্যতীত অন্য কোন কাপড়ে কাফন দেয়া হতনা। আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর উসীলা (দোহাই) দিয়ে আবেদন করছি যে, তোমাদের মধ্য হতে ঐ ব্যক্তি যেন আমার কাফন না দেয়, যে কোন অঞ্চলের আমীর ছিল অথবা গভর্ণর ছিল অথবা বিচারক ছিল অথবা অন্য কোন সরকারি দায়িত্ব পালন করেছিল। তারা সকলেই চিন্তা করে দেখল, এই অশ্বারোহী দলের মধ্যে এমন কোন লোক নেই, যে উপরোক্ত কোন না কোন পদে অধিষ্ঠিত হয়নি। আনসারদের একজন কম বয়সী যুবকই আবু যারের মূল্যায়নে টিকে ছিল। কারণ সে কোন সরকারী দায়িত্ব পালন করেনি। সে বলল- হে চাচা! আমি আপনাকে আমার এই চাদরে এবং সেই দু’টি কাপড়ে কাফন পড়াব, যা আমার মা বুনিয়েছেন। কাপড় দু’টি আমার এই থলেতে রয়েছে। আবু যার্ (রাঃ) বললেন- তাহলে তুমিই আমাকে কাফন পড়াবে। কিছুক্ষণ পর আবু যার্ (রাঃ) সেখানে মৃত্যু বরণ করলেন। সেই আনসারী যুবকই কাফন পরিধান করাল। তখন সকলে মিলে তাঁর জানাযার সলাত আদায় করলেন এবং তাকে দাফন করলেন। এই যুবকের সাথের লোকদের সকলেই ছিল ইয়ামানের অধিবাসী।[6]

সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী (ﷺ) তাবুকে পৌঁছার পূর্বে বলেছিলেন- ইনশা-আল্লাহ্ আগামীকাল তোমরা তাবুকের জলাশয়ে গিয়ে পৌঁছবে। তবে তোমরা সেখানে চাশতের সময় না হওয়ার আগে কোনক্রমেই পৌঁছতে পারবেনা। আমি সেখানে উপস্থিত না হওয়ার আগেই কেউ যদি সেখানে পৌঁছে যায়, তাহলে সে যেন সেখানকার পানিতে হাত না ডুবায়। অর্থাৎ তার কাছেও যেন না যায়। বর্ণনাকারী বলেন- আমরা তাবুকে পৌঁছে দেখি, আমাদের আগেই সেখানে গিয়ে দু’জন উপস্থিত হয়েছে। আর দেখলামঃ সেখানকার ঝর্না থেকে অল্প অল্প পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

রসূল (ﷺ) ঐ দু’জন লোককে জিজ্ঞেস করলেন- তোমরা কি এই পানি স্পর্শ করেছ? তারা বলল- হ্যাঁ, স্পর্শ করেছি। তিনি তখন তাদেরকে গালি দিলেন (দোষারোপ করলেন) এবং আরও অনেক কথা বললেন। অতঃপর লোকেরা সেই ঝর্ণা থেকে অঞ্জলি ভর্তি করে অল্প অল্প পানি উঠিয়ে একত্রিত করল। এতে সামান্য পানি এক সাথে জমা হয়ে গেল। নাবী (ﷺ) সেই পানি দিয়ে স্বীয় মুখ ও উভয় হাত ধৌত করলেন। তারপর সেই পানি ঝর্ণায় ঢেলে দিলেন। এবার ঝর্ণা থেকে প্রচুর পানি প্রবাহিত হতে লাগল। লোকেরা পানি পান করল।

অতঃপর নাবী (ﷺ) মুআয (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বললেন- হে মুআয! তোমার হায়াত যদি দীর্ঘ হয়, তাহলে তুমি দেখবে যে, এখানকার পানির আশ-পাশ গাছপালা ও বাগবাগিচায় ভর্তি হয়ে যাবে।[7]

নাবী (ﷺ) যখন তাবুকে গিয়ে পৌঁছলেন তখন আয়লার সম্রাট আগমণ করে তাঁর সাথে সন্ধি করতে এবং জিযিয়া-কর প্রদান করতে রাজী হল। এ সময় জারবা এবং আযরুহ-এর অধিবাসীরা এসেও জিযিয়া দিতে সম্মত হল। আয়লার শাসকের সাথে নাবী (ﷺ) লিখিত চুক্তি করলেন। তার বিষয়বস্ত্ত ছিল এইঃ


(بسم الله الرحمن الرحيم هذا أَمَنَةٌ مِن الله ومحمد النبى رسول الله لِيُحَنَّةَ بن رُؤْبَةَ وأهلِ أَيْلَة، سُفنهم وسيارتهم فى البرِّ والبحرِ لهم ذِمةُ اللهِ ومحمد النبى ومَنْ كان معهم مِن أهل الشام وأهل اليمن وأهل البحر فمَن أحدث منهم حَدَثاً فإنه لا يَحولُ مالُه دونَ نفسه وإنَّه لمن أخذه مِن الناس وإنه لا يحِلُّ أن يُمنعوا ماءً يردونه ولا طريقاً يردونه من بَحْرٍ أو بَرٍّ)


‘‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহ্ তা‘আলা এবং আল্লাহর নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এর পক্ষ হতে ইউহান্না বিন রুবা এবং আয়লার অধিবাসীদের নিরাপত্তার জন্য এই চুক্তিপত্র লিখা হচ্ছে। জলে ও স্থলে চলাচলকারী তাদের যানবাহন ও নৌকাগুলো আল্লাহ এবং নাবী মুহাম্মাদের হেফাজতে ও যিম্মায় থাকবে। সিরিয়া, ইয়ামান ও বাহরাইনের যে সমস্ত লোক তাদের সাথে থাকবে, তাদের কাফেলাতেও এই নিরাপত্তার চুক্তি কার্যকর হবে। তাদের কেউ যদি চুক্তিবিরোধী কোন কাজ করে বা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে তার মাল তার জান বাঁচাতে পারবো; বরং যে কোন মুসলিমের জন্যই তাদের জান-মাল হালাল হয়ে যাবে। মুসলমানদের জন্য বৈধ নয় যে, কোন পানির ঘাটে অবতরণ করতে তাদেরকে বাধা দিবে, জল বা স্থল পথে চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে।

[1]. সূরা তাওবা-৯:৫০

[2]. সূরা তাওবা-৯:৮১

[3]. সূরা তাওবা-৯:৯২

[4]. সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ গাযওয়ায়ে তাবুক।

[5]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, (৪/১৪)

[6]. সহীহ ইবনে হিববান, হা/ ২২৬০, ইমাম আলবানী রহঃ) বলেন, হাদীসের সনদ হাসান।

[7]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুজেযা।