তিনি যখন দুশমনদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতেন, তখন একজন ঘোষককে ঘোষণা করার আদেশ দিতেন। তখন গণীমতের সমস্ত মাল একত্রিত করা হত। গণীমত বন্টনের পূর্বে নিহত কাফেরের সালাব তথা তার কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ তার হত্যাকারীকেই দিয়ে দিতেন। অতঃপর তিনি গণীমতের মাল থেকে পাঁচ ভাগের একভাগ বের করে নিতেন। আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি তা ব্যয় করতেন এবং মুসলমানদের কল্যাণমূলক কাজে খরচ করার আদেশ দিতেন। আর যা বাকী থাকত, তা থেকে ঐ সমস্ত লোকদেরকে দান করতেন, যাদের জন্য গণীমতের মাল থেকে অংশ দেয়ার বিধান রাখা হয়নি। যেমন নারী, শিশু এবং দাস-দাসীগণ। অতঃপর বাকী সম্পদ মুজাহিদদের মাঝে সমান হারে ভাগ করে দিতেন। অশ্বারোহী যোদ্ধাকে তিন অংশ প্রদান করতেন। এক অংশ অশ্বারোহী মুজাহিদের জন্য। দুই অংশ তার ঘোড়ার জন্য। পদাতিক সৈনিককে দিতেন এক অংশ। এটিই সঠিক মত। তিনি গণীমতের মূল সম্পদ থেকে প্রয়োজন অনুপাতে মুসলমানদের কাজেও ব্যয় করতেন।

কোন এক যুদ্ধে তিনি সালামা বিন আকওয়া (রাঃ) কে পদাতিক ও অশ্বারোহীর অংশ একত্রিত করে মোট পাঁচ অংশ প্রদান করেছেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাঁর বীরত্ব এবং অন্যান্য ক্রিয়া কলাপের কারণেই তিনি এমনটি করেছিলেন। গণীমতের মাল বন্টনের ক্ষেত্রে তিনি দুর্বল ও শক্তিশালীর মধ্যে কোন পার্থক্য করতেন না। সকলকেই সমান করে প্রদান করতেন। তবে তিনি কাউকে অতিরিক্ত কিছু দিলে সে কথা ভিন্ন। শত্রুদের দেশে হামলা করার সময় তিনি প্রথমে সেনাবাহিনীর ছোট একটি দল প্রেরণ করতেন। তারা যদি গণীমত সংগ্রহ করতে পারত তাহলে তা থেকে এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকী চার অংশের এক অংশ নফল হিসাবে হামলাকারী সৈনিকদের মাঝে ভাগ করে দিতেন। যা বাকী থাকত তা প্রেরিত সৈনিক এবং অন্যান্য সৈনিকদের মাঝে ভাগ করে দিতেন। অগ্রে প্রেরিত সৈনিকরা যখন ফেরত এসে পুনরায় আক্রমণ করে গণীমত অর্জন করত তখন তিনি গণীমত অর্জনকারী সৈনিকদেরকে গণীমতের এক তৃতীয়াংশ প্রদান করতেন। কেননা একবার যুদ্ধ করে ফেরত এসে পুনরায় আক্রমণ করতে যাওয়া খুব কঠিন। কারণ তখন তারা এবং তাদের বাহনগুলো দুর্বল থাকে। তাই তিনি উৎসাহ দেয়ার জন্য এবার প্রথমবারের চেয়ে বেশী প্রদান করতেন। তা সত্ত্বেও তিনি সৈনিকদের কাউকে অতিরিক্ত দেয়াকে অপছন্দ করতেন এবং বলতেন- শক্তিশালী মুমিনগণ যেন তাদের দুর্বলদেরকে এই অংশ ফেরত দেয়।

গণীমতের মাল থেকে নাবী (ﷺ) নিজের জন্য একটি অংশ বের করে নিতেন। এই অংশকে সাফী (নির্বাচিত অংশ) বলা হত। তিনি ইচ্ছা করলে বন্টনের পূর্বেই কোন দাস বা দাসী বা ঘোড়া নিয়ে নিতেন।

আয়িশা (রাঃ) বলেন- নাবী (ﷺ)-এর স্ত্রী সাফীয়া (রাঃ) সাফীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইমাম আবু দাউদ এটি র্বণনা করেছেন। কারণ তিনি সাফীয়া (রাঃ) কে খায়বারের গণীমত ভাগ হওয়ার পূর্বেই নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর যুল-ফিকার নামক তরবারিটিও সাফীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।

যারা মুসলমানদের সেবামূলক কাজে মশগুল থাকার কারণে জিহাদে যেতে পারতেন না, তাদেরকেও তিনি গণীমতের মালের অংশ দিতেন। উছমান বিন আফ্ফান (রাঃ) বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করা সত্ত্বেও তিনি গণীমতের মাল থেকে তাঁকে অংশ দিয়েছেন। কারণ তিনি নাবী (ﷺ) এর অসুস্থ কন্যার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন- উছমান (রাঃ) আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রসূলের কাজে ব্যস্ত আছে। সুতরাং তিনি তাঁর জন্য অংশ নির্ধারণ করেছেন।

সাহাবীগণ নাবী (ﷺ) এর সাথে জিহাদ ও গাযওয়ায় থাকা অবস্থায় ক্রয়-বিক্রয়ও করতেন। নাবী (ﷺ) এই দৃশ্য দেখতেন। কিন্তু তিনি এর কোন প্রতিবাদ করতেন না। সাহাবীগণ জিহাদে দুই প্রকারের শ্রমিকও নিয়োগ করতেন। (১) কোন ব্যক্তি জিহাদে বের হওয়ার সময় স্বীয় খেদমতের জন্য কাউকে ভাড়া করে নিয়ে যেত। (২) আবার কোন কোন সাহাবী কাউকে অর্থের বিনিময়ে জিহাদের জন্যও ভাড়া করে নিতেন। এই প্রকার মুজাহিদদেরকে জায়েল বলা হত। এদের ব্যাপারে নাবী (ﷺ) বলেছেন- মুজাহিদের জন্য বিনিময় রয়েছে। জায়েলের জন্যও বিনিময় রয়েছে। এতে মুজাহিদের বিনিময়ে মোটেই কমতি হবেনা।

তারা গণীমতের মাল হতে অন্য আরও দুইভাবে অংশ গ্রহণ করতেন। (১) দুই বা ততোধিক ব্যক্তি এই শর্তে একসাথে যুদ্ধ করবে যে, গণীমতের মাল পেলে তারা উভয়ে ভাগ করে নিবে। (২) কেউ তার উট বা ঘোড়া অন্য কাউকে এই শর্তে দিত যে, সে এর উপর আরোহন করে জিহাদ করবে। গণীমতের মাল হস্তগত হলে উভয়ে সমানভাবে ভাগ করে নিবে। কখনও এমন হত যে, একটি তীর-ধনুক গণীমত হিসাবে পাওয়া গেলে একজনের ভাগে আসত তীর আর অন্যজনের ভাগে পড়ত তীরের ফলা। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ বলেন- আমি, আম্মার বিন ইয়াসির এবং সা’দ (রাঃ) এই শর্তে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলাম যে, আমরা যা পাবো, তা আমরা তিন জনে ভাগ করে নিব। সা’দ দু’টি কয়েদী নিয়ে আসল। আমি এবং আম্মার কিছুই নিয়ে আসতে পারলামনা।

নাবী (ﷺ) কখনও অশ্বারোহী বাহিনী আবার কখনও পদাতিক বাহিনী প্রেরণ করতেন। জিহাদে মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হওয়ার পর যারা ময়দানে উপস্থিত হত তিনি তাদেরকে গণীমতের কোন অংশ দিতেন না। নাবী (ﷺ) এর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য হতে বনী হাশেম ও বনী আব্দুল মুত্তালেবকেই অংশ দিতেন। বনী আবদে শামস্ ও বনী নাওফালকে কোন অংশ দিতেন না। তিনি বলতেন- বনী হাশেম এবং বনী আব্দুল মুত্তালেব পরস্পর সম্পৃক্ত। এই বলে তিনি এক হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলের মধ্যে ঢুকিয়ে জালের মত বানালেন। তিনি আরও বলতেন- তারা জাহেলীয়াতে বা ইসলামী যুগে কখনই আমাদের থেকে আলাদা হয়নি।

নাবী (ﷺ) এর সাথে যুদ্ধ করে সাহাবীগণ মধু, আঙ্গুর এবং অন্যান্য খাদ্য-দ্রব্য পেতেন। তারা এগুলো খেয়ে ফেলতেন। গণীমতের মাল হিসাবে রসূল (ﷺ) এর কাছে পেশ করতেন না।

ইবনে আবী আওফা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল, আপনারা কি যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত খাদ্য-দ্রব্যের এক পঞ্চমাংশ প্রদান করতেন? তিনি বললেন- আমরা খায়বারের দিন কিছু খাদ্য পেলাম। লোকেরা এসে তাদের প্রয়োজন অনুসারে সেখান থেকে খেয়ে যেত। কোন কোন সাহাবী বলেন- আমরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত আখরোট খেয়ে নিতাম, মুজাহিদদের মাঝে বন্টনের জন্য তা পেশ করতামনা। এগুলো আমরা এত পরিমাণ পেতাম যে, সফর থেকে ফিরে এসেও আমাদের থলিগুলো ভর্তি পেতাম।

নাবী (ﷺ) গণীমতের মাল লুটতরাজ করতে এবং শত্রুদেরকে মুছলা করতে অর্থাৎ নাক-কান কেটে অঙ্গহানি করতে নিষেধ করতেন। তিনি বলতেন- গণীমতের মাল লুটকারী আমাদের দলের অন্তর্ভুক্ত নয়।

নাবী (ﷺ) গণীমত হিসেবে প্রাপ্ত জন্তুর উপর আরোহন করে তাকে দুর্বল করে ফেরত দিতে এবং গণীমতের কাপড় পরিধান করে পুরাতন করে ফেরত দিতে নিষেধ করেছেন। তবে যুদ্ধাবস্থায় এগুলো দিয়ে উপকার গ্রহণ করতে নিষেধ করেননি।

গণীমতের মাল খেয়ানত করতে তিনি শক্তভাবে নিষেধ করতেন। তিনি বলতেন- কিয়ামতের দিন গণীমতের মাল খেয়ানতকারীর জন্য রয়েছে লজ্জা, আগুন এবং অপমান। নাবী (ﷺ) এর গোলাম (দাস) মিদআম যখন যুদ্ধে আহত হল, তখন কতক সাহাবী বলল- তার জন্য রয়েছে জান্নাতের মুবারকবাদ। এ কথা শুনে নাবী (ﷺ) বললেন- কখনই নয়, ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা। খায়বারের দিন সে যেই চাদরটি মালে গণীমত বন্টনের পূর্বেই চুরি করেছিল সেটি আগুনে পরিণত হয়ে তাকে জ্বালাতে থাকবে। এ কথা শুনে লোকদের কেউ জুতার একটি ফিতা বা কেউ দু’টি ফিতা নিয়ে এসে ফেরত দিতে লাগল। নাবী (ﷺ) তখন বলতে লাগলেন এই একটি বা দু’টি ফিতাও আগুনে পরিণত হবে।

রসূল (ﷺ) এর আসবাব-পত্র বহন ও দেখাশুনাকারী লোকটি যখন মারা গেল তখন তিনি বললেন- সে জাহান্নামে যাবে। লোকেরা তার অবস্থা তল্লাশি করে দেখতে পেল, সে গণীমতের মাল থেকে একটি চাদর চুরি করে রেখে দিয়েছিল।

লোকেরা কোন এক যুদ্ধে বলতে লাগল- অমুক শহীদ, অমুক শহীদ হয়েছে। তারা এক লোকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ও অনুরূপ বলল। নাবী (ﷺ) তখন বললেন- কখনই নয়। আমি তাকে জাহান্নামে সেই চাদর পরিহিত অবস্থায় দেখেছি, যা সে গণীমতের মাল থেকে চুরি করেছিল। অতঃপর তিনি বললেন- হে খাত্তাবের পুত্র! যাও এবং মানুষের মাঝে ঘোষণা করে দাও যে, ঈমানদার ব্যতীত অন্য কেউ জান্নাতে যেতে পারবেনা। কথাটি তিনি তিনবার বললেন।

তিনি যখন কোন জিহাদে গণীমতের মাল পেতেন তখন বিলালকে এই মর্মে ঘোষণা দেয়ার আদেশ দিতেন যে, লোকেরা যেন গণীমতের মাল নিয়ে আসে। নাবী (ﷺ) তা থেকে এক পঞ্চমাংশ নিতেন এবং বাকী অংশ ভাগ করতেন। একবার জনৈক ব্যক্তি ঘোষণা হওয়ার এবং মালে গণীমত ভাগ হয়ে যাওয়ার পর একটি লাগাম নিয়ে আসল। রসূল (ﷺ) তখন তাকে বললেন- তুমি কি বেলালের ঘোষণা শুন নি? সে বলল- হ্যাঁ, শুনেছি। তিনি বললেন- তাহলে তুমি তা আগে নিয়ে আস নি কেন? লোকটি ক্ষমা চাইল। তখন তিনি বললেন- তুমি এটি কিয়ামতের দিন নিয়ে আসবে। আজ এটি আমি তোমার কাছ থেকে গ্রহণ করবনা।

নাবী (ﷺ) গণীমতের চোরাই মাল আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলার আদেশ দিয়েছেন। তাঁর পরে আবু বকর ও উমার (রাঃ) তাই করতেন এবং চোরকে প্রহারও করা হত। এর জবাবে বলা হয় যে, পূর্বে উল্লেখিত হাদীসগুলো দ্বারা পুড়ে ফেলার আদেশ রহিত হয়ে গেছে। কেননা তাতে পুড়ে ফেলার আদেশ নেই। আবার কোন কোন আলেম বলেছেন- সাবধানতা স্বরূপ এবং ভয় দেখানোর জন্য এরূপ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আর এ জাতীয় বিষয়গুলো ইমামদের ইজতেহাদের উপর নির্ভর করে। শরীয়তে এগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোন বিধান নেই। যেমন তৃতীয় এবং চতুর্থবার মদ পানকারীকে হত্যা করার বিষয়টি ইমামদের ইজতেহাদের অধীন। এটি শরীতের নির্ধারিত শাস্তি নয়।