রসূল (ﷺ) মক্কা হতে মদ্বীনার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছেন, এ কথা আনসারগণ যথা সময়েই জানতে পেরেছেন। তারা প্রতিদিন সকালে মদ্বীনার বাইরে হাররায় তথা কালো কালো পাথর বিশিষ্ট ভূমিতে এসে দুপুর পর্যন্ত রসূল (ﷺ) এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। সূর্যের তাপ বেড়ে গেলে তারা ঘরবাড়িতে চলে যেত।

নবুওয়াতের ১৩তম বর্ষে রবীউল আওয়াল মাসের সোমবারের দিন প্রতিদিনের অভ্যাস মোতাবেক আল্লাহর রসূলকে সম্মানিত মেহমানের ন্যায় সাদরে গ্রহণ করে নেওয়ার জন্য তারা মদ্বীনার বাইরে বের হলেন। এ দিনও রসূলের আগমণের অপেক্ষায় থেকে সূর্যের তাপ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই তারা ফেরত গেলেন।

ঐদিকে একজন ইহুদী তার কোন প্রয়োজনে মদ্বীনার কোন একটি টিলার উপর উঠল। টিলার উপর উঠেই সে আল্লাহর রসূল এবং তাঁর সাথীদেরকে আগমণ করতে দেখল। তাদের আলোকময় চেহারাগুলো চমকাচ্ছিল্ল এবং মরিচিকা তাদের সামনে থেকে সরে যাচ্ছিল। সেই ইহুদী উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করলঃ হে বনী কায়লা (আওস ও খাজরায গোত্রের লোকেরা)! এই তো তোমাদের নেতা চলে এসেছেন, যার জন্য তোমরা অপেক্ষা করছ। আনসারগণ দ্রুত অস্ত্র হাতে নিয়ে তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য অগ্রসর হলেন। বনী আমর বিন আওফ গোত্রের দিক থেকে তাকবীর ধ্বনি শুনা গেল। রসূলের আগমণে মুসলিমগণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকবীর পাঠ করলেন। তারা তাঁর সাথে সাক্ষাত করার জন্য বের হয়ে পড়লেন, নবুওয়াতের মহা সম্মানের প্রতি খেয়াল রেখে সুন্দর সুন্দর বাক্যের মাধ্যমে তারা আল্লাহর নাবীকে স্বাগত জানালেন। আনসারগণ চতুর্দিক থেকে তাঁকে পাহারা দিচ্ছিলেন এবং তাঁর প্রতি স্বজাগ দৃষ্টি রাখছিলেন। এ সময় প্রশান্তি ও স্বস্তির এক ছায়াঘন পরিবেশ তাঁকে ঢেকে রাখছিল। এ সময় তাঁর উপর কুরআনের এই আয়াত নাযিল হল-

فَإِنَّ اللهَ هُوَ مَوْلاهُ وجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ وَالمَلائِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيرٌ

‘‘(আর যদি নাবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে জেনে রেখো) আল্লাহ্, জিবরাঈল এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণ তাঁর সহায়। উপরন্তু ফিরিস্তাগণও তাঁর সাহায্যকারী’’। (সূরা তাহরীম-৬৬:৪)

অতঃপর রসূল (ﷺ) চলতে লাগলেন। কুবায় পৌঁছে তিনি বনী আমর বিন আওফ গোত্রে এসে কুলছুম বিন হাদমের নিকট অবতরণ করলেন। কেউ বলেছেন- তিনি সা’দ বিন খাইছামার বাড়িতে অবতরণ করেছিলেন। তিনি কুবাতে ১৪ দিন অবস্থান করলেন। তিনি সেখানে কুবা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করলেন। নবুওয়াতের পর এটিই ছিল প্রথম মসজিদ। জুমআর দিন আল্লাহর অনুমতিক্রমে মদ্বীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। বনী সালেম গোত্রের নিকট পৌঁছলে জুমআর সলাতের সময় হয়ে গেল। বনী সালেমের উপত্যকায় তিনি সাহাবীদের নিয়ে জুমআর সলাত আদায় করলেন। সলাতের পর তিনি আবার আরোহন করলেন। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে লোকেরা উটের লাগাম ধরে ধরে বলতে লাগল- আপনি আমাদের কাছে অবতরণ করুন। আমাদের কাছে রয়েছে সকল প্রকার প্রস্ত্ততি, রয়েছে অস্ত্র ও প্রতিরোধ ক্ষমতা। তিনি বললেন- উটনীকে যেতে দাও। কারণ সে আল্লাহর পক্ষ হতে আদেশ প্রাপ্ত, তাকে ছেড়ে দাও, সে যেখানে ইচ্ছা সেখানেই অবতরণ করবে।

উটনীটি তাঁকে নিয়ে চলতেই থাকল। যখনই কোন আনসারীর বাড়ির পাশ দিয়ে অতিক্রম করত তখনই তারা এই কামনা করত যে, আল্লাহর রসূল তাদের কাছেই অবস্থান করুক। আর তিনি একই কথা বলতেন- উটনীকে যেতে দাও। কারণ সে আল্লাহর পক্ষ হতে আদেশ প্রাপ্ত। সে যেখানে ইচ্ছা সেখানেই অবতরণ করবে।

উটনী চলতেই থাকল। অতঃপর আজ যেখানে রসূলের মসজিদ রয়েছে সেখানে এসে উটনী বসে পড়ল। নাবী (ﷺ) উটনীর উপরেই বসে রইলেন। উটনী পুনরায় দাঁড়াল এবং একটু অগ্রসর হল। অতঃপর আগের জায়গায় এসে পুনরায় বসে পড়ল। তিনি এবার উটনীর পিঠ থেকে অবতরণ করলেন। এই স্থানেই ছিল রসূল (ﷺ) এর মামাদের বাসস্থান। আল্লাহ্ তা‘আলা উটনীকে সঠিক স্থান নির্ধারণের তাওফীক দিয়েছিলেন। কারণ আল্লাহ্ তা‘আলা চেয়েছিলেন যে, তাঁর রসূলের মেহমানদারীর সম্মানটি তাঁর মামাদের জন্যই অর্জিত হোক। সুতরাং তারা রসূল (ﷺ) কে তাদের বাসস্থানে অবতরণ করার আবেদন করতে লাগলেন। আবু আইয়্যুব আনসারী (রাঃ) দ্রুত সামনে এগিয়ে রসূল (ﷺ) এর ভ্রমণ সামগ্রী ও মালপত্র নিজের ঘরে ঢুকিয়ে ফেললেন। রসূল (ﷺ) তখন বলতে লাগলেন- কোন লোক তাঁর সফর সামগ্রীর সাথেই চলে থাকে। ঐ দিকে আসআদ বিন যুরারা রসূল (ﷺ) এর উটনীকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলেন। পরে সেটি তাঁর কাছেই ছিল।

মদ্বীনায় প্রিয় নাবীর আগমনে আনন্দের স্রোত বইতে লাগল। কবিতা ও ছন্দের মাধ্যমে তারা আনন্দ প্রকাশ করছিলেন। এ মর্মে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। আবু কাইস সিরমাহ আনসারী (রাঃ) এর কবিতায় সেই আনন্দের কিছু অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) তাঁর কাছে গিয়ে কবিতাংশটি মুখস্ত করে নিয়েছিলেন। সেই কবিতার কয়েকটি লাইন হচ্ছে,

1- ثَوَى فى قُرَيْشٍ بِضْعَ عَشْـرَةَ حِجَّةً + يُذَكَّرُ لَوْ يَلْقَى حَبِيباً مُوَاتِــيَا

2- وَيَعْـرِضُ فى أهْلِ المَوَاسِـمِ نَفْسَهُ + فَلَمْ يَرَ مَنْ يُؤوِي وَلَمْ يَرَ دَاعِـيَا

3- فَلَمَّا أَتَانَا وَاسْتَقَرَتْ بِهِ النَّــوَى + وأَصْبَـحَ مَسْرُورَاً بِطَيْببَةَ رَاضِيَا

4- وَأصْبَحَ لاَ يَخْشَى ظُلاَمَةَ ظَـالمٍ + بَعِيدٍ وَلاَ يَخْشَى مِنَ النَّاسِ بَاغِيَا

5- بَذَلْنَا لَهُ الأَمْـوَالَ مِنْ حِلِّ مَالِنـا + وَأَنْفُسَنَا عِنْدَ الوَغَى والتآسِـيَا

6- نُعَادِى الَّذِى عَادَى مِنَ النَّاس كُلِّهِمْ + جَمِيعاً وَإِنْ كَانَ الحَبِيبَ المُصَافِيَا

7- وَنَعْلَـمُ أَنَّ اللهَ لاَ رَبَّ غَيْــرُهُ + وَأَنَّ كِتَابَ اللهِ أَصْبَــحَ هَادِيَا

(১) তিনি (রসূল (ﷺ) মক্কার কুরাইশদের মাঝে ১৩ বছর অবস্থান করে লোকদের নসীহত করেছেন। এই আশায় হয়ত কোন সাহায্যকারী বা বন্ধু পাবেন।

(২) হাজ্জ কিংবা অন্যান্য মৌসুমে মানুষের কাছে নিজেকে পেশ করেছেন, কিন্তু কোন আশ্রয়দাতা পেলেন না এবং তাঁকে কেউ আহবানও করল না।

(৩) তিনি যখন আমাদের নিকট চলে আসলেন তখন থেকে মদ্বীনায় খুশী মনে ও সন্তুষ্ট চিত্তে বসবাস করতে থাকলেন।

(৪) কোন জালেমের জুলুম এবং মানুষের মধ্যে কোন সীমালংঘন কারীরও ভয় রইলনা।

(৫) আমরা তাঁর জন্য জান ও হালাল সম্পদ উৎসর্গ করলাম। বিশেষ করে লড়াইয়ের ময়দানে এবং অন্যান্য স্থানে যখন তা ব্যয় করার প্রয়োজন হয়েছিল।

(৬) সকল মানুষের মধ্য হতে আমাদের যে ব্যক্তি তাঁর সাথে দুশমনী করে আমরা তাঁকে শত্রু মনে করি। যদিও সে আমাদের বন্ধু হয়ে থাকে।

(৭) আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহই আমাদের প্রভু, তিনি ছাড়া আমাদের অন্য কোন রব নেই। আর আল্লাহর কিতাবই আমাদের পথ প্রদর্শক।

আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন- নাবী (ﷺ) মক্কায় ১৩ বছর অবস্থান করেছেন। অতঃপর তাঁকে হিজরত করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তখন তাঁর উপর কুরআনের এই আয়াত অবতীর্ণ হয়-

وَقُلْ رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا

‘‘বলঃ হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দাখিল কর সঠিক স্থানে এবং আমাকে বের কর সঠিক রূপে এবং দান কর আমাকে নিজের কাছ থেকে রাজকীয় সাহায্য’’। (সূরা ইসরা-১৭:৮০)

বিশিষ্ট তাবেয়ী কাতাদাহ (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন- আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে মক্কা থেকে মদ্বীনায় উত্তম স্থানে বের করলেন। আল্লাহর নাবী জানতেন যে, শক্তি ও সাহায্য ছাড়া এই পৃথিবীতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহর কাছে শক্তি ও সাহায্যকারী প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ্ তাঁকে মক্কাতে অবস্থান কালেই দারুল হিজরত দেখালেন। তখন তিনি সাহাবীদেরকে বললেন- আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান দেখানো হয়েছে। তা হচ্ছে লবণাক্ত ভূমি, তাতে রয়েছে খেজুর গাছ, এবং কালো পাথর দিয়ে ঢাকা দু’টি ভূখন্ডের মাঝখানে তা অবস্থিত।

বারা বিন আযিব (রাঃ) বলেন- রসূল (ﷺ) এর সাহাবীদের মধ্য হতে সর্বপ্রথম আমাদের কাছে মুসআব বিন উমাইর এবং আব্দুল্লাহ্ ইবনে উম্মে মাকতুম আগমণ করলেন। তারা উভয়েই লোকদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতে লাগলেন। অতঃপর আম্মার বিন ইয়াসির, বিলাল বিন রাবাহ এবং সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) আসলেন। তাদের পথ ধরেই ২০ জনের একটি কাফেলা নিয়ে উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) আগমন করলেন। সকলের শেষে হিজরত করলেন রসূল (ﷺ)।

বারা বিন আযিব (রাঃ) বলেন- রসূলের আগমণে মদ্বীনাবাসীগণ যে রকম খুশী হয়েছিলেন অন্য কোন সময় তাদেরকে এত খুশী হতে দেখিনি। এমনকি নারী, শিশু এবং দাস-দাসীদেরকেও বলতে শুনেছি, এই তো আল্লাহর রসূল আমাদের কাছে চলে এসেছেন।

আনাস (রাঃ) বলেন- রসূল (ﷺ) যেদিন মদ্বীনায় এসে পৌঁছলেন সেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম। তিনি যেদিন আমাদের কাছে মদ্বীনায় প্রবেশ করলেন সেদিনের চেয়ে অধিক আলোকিত ও সুন্দর দিন আর কখনও দেখিনি। আর আমি রসূল (ﷺ) এর মৃত্যুর দিনও উপস্থিত ছিলাম। ঐদিনের চেয়ে অধিক অন্ধকারাচ্ছন্ন ও দুঃখের দিন আর কখনও দেখিনি।

অতঃপর তাঁর মসজিদ এবং বাসগৃহ নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি আবু আইয়্যুব আনসারী (রাঃ) এর বাড়ীতেই অবস্থান করতে থাকলেন। আবু আইয়্যুব আনসারী (রাঃ) এর বাড়িতে অবস্থান কালেই তিনি যায়েদ বিন হারেছা এবং আবু রাফে (রাঃ) কে দু’টি উটসহ এবং পাঁচশ দিরহাম দিয়ে মক্কায় পাঠালেন। তারা মক্কায় গিয়ে তাঁর কন্যা ফাতেমা, উম্মে কুলছুম, তাঁর স্ত্রী সাওদা, উসামা বিন যায়েদ এবং উসামার মাতা উম্মে আয়মান (রাঃ) কে মদ্বীনায় নিয়ে আসলেন। কিন্তু রসূল (ﷺ) এর আরেক কন্যা যায়নাব (রাঃ) আবুল আসের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। সে তাঁকে আটকিয়ে রেখেছিল। ঐদিকে আবু বকর (রাঃ) এর ছেলে আব্দুল্লাহ্ আবু বকরের পরিবারের সকলকে নিয়ে বের হল। তাদের মধ্যে উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রাঃ) ও ছিলেন। তারা এসে হারেছা বিন নু’মানের বাড়িতে অবতরণ করলেন।