আরফার দিনে নাবী (সাঃ) এর পবিত্র হিদায়াত

মিনায় গিয়ে তিনি যোহর ও আসর সলাত পড়েছেন এবং তথায় রাত্রি যাপন করেছেন। পরের দিন সূর্য উঠার পর ডান পাশের রাস্তা দিয়ে আরাফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তখন সাহাবীদের কেউ তালবীয়া পাঠ করছিল আবার কেউ তাকবীর পড়ছিল। তিনি শুনতেন এবং কোন প্রতিবাদ করতেন না। আরাফার পূর্ব প্রান্তে নামেরায় পৌঁছে দেখেন তাঁর আদেশ মোতাবেক তাঁর জন্য তাঁবু টানানো হয়েছে। বর্তমানে সেই জায়গাটি খালী অবস্থায় পড়ে আছে। সুতরাং তিনি নামেরায় অবতরণ করলেন। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে যাওয়ার পর কাসওয়া নামক উটনীর উপর আরোহন করে উরানার নিম্নভূমিতে পৌঁছলেন।

সেখানে তিনি উটের উপর আরোহী অবস্থায় এক মহান ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করলেন। এই ভাষনে তিনি ইসলামের মূল বুনিয়াদগুলো পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করলেন এবং শিরক ও অন্ধকার যুগের সকল প্রথা বাতিল করলেন। পূর্বের যে সমস্ত বিষয়কে সকল শরীয়ত হারাম করেছে ইসলামী শরীয়তে সে বিষয়গুলো হারাম হওয়ার কথা তিনি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন মানুষের রক্তপাত করা হারাম এবং তাদের ধন-সম্পদও অনুরূপ হারাম। জাহেলী সমাজের রীতি-নীতিকে তিনি তাঁর পায়ের নীচে দাফন করলেন এবং ঐ সময়ের সকল সুদকে তিনি বাতিল বলে ঘোষণা দিলেন। তিনি নারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার উপদেশ দিলেন, স্বামীদের উপর তাদের হক এবং তাদের উপর তাদের স্বামীদের হকের কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি বললেন- স্ত্রীদের জন্য ন্যায়ভাবে ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। তবে তিনি তাদের জন্য ভরণপোষণের নির্ধারিত কোন পরিমাণ উল্লেখ করেন নি। স্বামীদের অপছন্দনীয় লোককে ঘরে প্রবেশ করালে তিনি তাদেরকে প্রহার করার অনুমতি দিয়েছেন। এই ভাষণে তিনি আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে ধারণ করার জন্য উম্মাতকে আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- তারা যদি এটিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে তাহলে তাদের পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নেই। অতঃপর তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, তাদেরকে কিয়ামতের দিন তাঁর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে। তাঁর ব্যাপারে তারা কি বলবেন এবং কি সাক্ষী দিবেন, সেই স্বীকৃতি তিনি তাদের থেকে আদায় করেছেন। মুসলিমগণ সেদিন এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আমাদের নিকট আল্লাহর পয়গাম পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছেন এবং উম্মাতকে নসীহত করেছেন। এক পর্যায়ে তিনি আকাশের দিকে আঙ্গুল উঠালেন এবং তাদের কথার উপর তিনবার আল্লাহকে সাক্ষী রাখলেন। তিনি উপস্থিত মুসলিমদেরকে আদেশ করলেন, তারা যেন অনুপস্থিত লোকদেরকে তাঁর এই ভাষণটি পৌঁছিয়ে দেয়। তিনি আরাফায় মাত্র একটি খুতবা (ভাষণ) দিলেন। মাঝখানে বৈঠক দিয়ে এটিকে জুমআর খুতবার ন্যায় দুই খুতবায় বিভক্ত করেন নি।

খুতবা শেষে তিনি বিলালকে আযান দেয়ার আদেশ দিলেন। বিলাল (রাঃ) আযান দিলেন। অতঃপর ইকামত দিলেন। তিনি নিঃরবে কিরাআত পাঠ করে দুই রাকআত সলাত পড়লেন। সেই দিন ছিল জুমআর দিন। এতে প্রমাণিত হয় যে, মুসাফিরের উপর জুমআর সলাত নেই। অতঃপর বিলাল (রাঃ) আসরের ইকামত দিলেন। নাবী (ﷺ) আসরের সলাতও দুই রাকআত আদায় করলেন। এ সময় মক্কাবাসীগণও তাঁর সাথে ছিলেন। তারাও নাবী (ﷺ) এর সাথে যোহর ও আসর সলাত কসর ও একত্রিত করে আদায় করলেন। এতে প্রমাণিত হল যে, কত দূর সফর করলে সলাত কসর করা যাবে তার সঠিক কোন সীমা নির্ধারিত হয়নি।

সলাত শেষে তিনি বাহনে আরোহন করে আরাফার সীমানায় ঢুকলেন এবং আরাফার পাহাড়ের নীচের অংশে কংকরময় ভূমিতে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ালেন। এ সময় তিনি হাবলে মুশাত তথা বালুময় রাস্তাকে সামনে রাখলেন। তিনি উটের উপর ছিলেন। সেখানে থেকেই তিনি দু’আ শুরু করলেন। তিনি সূর্য ডুবা পর্যন্ত আল্লাহর দরবারে দু’আয় কাকুতি-মিনতি করতে থাকলেন। এ সময় তিনি লোকদেরকে উরানা উপত্যকা থেকে সরে আসতে বললেন। তিনি আরও বললেন যে, আরাফার সকল স্থানই অবস্থানের জায়গা। তিনি লোক পাঠিয়ে উপস্থিত জনগণকে বলে দিলেন, তারা যেন এই পবিত্র স্থানেই অবস্থান করে এবং এখানেই উকুফে আরাফা করে। এটিই হচ্ছে তাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর অবস্থানের জায়গা।

নাবী (ﷺ) তখন দু’আয় বুক পর্যন্ত হাত উঠিয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল কোন ভিক্ষুক যেন খাবার চাচ্ছে। তিনি বলেছেন-

خير الدعاء دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَة

আরাফা দিবসের দু’আ হচ্ছে, সর্বোত্তম দু’আ। তিনি আরাফায় অবস্থানকালে যে সমস্ত দু’আ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে-

اللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ كَالَّذِى نَقُولُ وَخَيْرًا مِمَّا نَقُولُ اللّٰهُمَّ لَكَ صَلاَتِى وَنُسُكِى وَمَحْيَاىَ وَمَمَاتِى وَإِلَيْكَ مَآبِى وَلَكَ رَبِّ تُرَاثِى اللّٰهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَوَسْوَسَةِ الصَّدْرِ وَشَتَاتِ الأَمْرِ اللّٰهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا تَجِىءُ بِهِ الرِّيحُ

‘‘হে আল্লাহ্! আমরা যে রকম প্রশংসা করি তা কেবল তোমার জন্যই। আর আমরা যে সকল প্রশংসা করি তার চেয়েও উত্তম প্রশংসার তুমি হকদার। হে আল্লাহ্! তোমার জন্যই আমার সলাত, আমার কুরবানী, তোমার জন্যই আমার বেঁচে থাকা, তোমার জন্যই আমার মরণ এবং তোমার দিকেই আমি ফিরে আসব। হে আমার রব্! আমি যা কিছু অর্জন করেছি, তার সবই তোমার জন্য। হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে কবরের আযাব থেকে, অন্তরের ওয়াস্ওয়াসা (কুমন্ত্রনা) থেকে এবং কাজের এলোমেলো থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে সেই অকল্যাণ থেকে আশ্রয় চাই, যা বাতাস বয়ে নিয়ে আসে’’।[1] সেখানে তিনি এই দু’আটিও করেছেন-

اللّٰهُمَّ إنكَ تَسْمَعُ كَلَامِي وَتَرَى مَكَانِي وَتَعْلَمُ سِرِّي وَعَلَانِيَتِي ولا يَخْفَى عَلَيْكَ شَيْءٌ مِنْ أَمْرِي أَنَا الْبَائِسُ الفقير، المستغيث المستجير الوجل المشفق المقر المعترف بذنوبه أَسْأَلُكَ مَسْأَلَةَ الْمِسْكِينِ وَأَبْتَهِلُ إِلَيْكَ ابْتِهَالَ الْمُذْنِبِ الذَّلِيلِ وَأَدْعُوكَ دُعَاءَ الْخَائِفِ الضَّرِيرِ مَنْ خَضَعَتْ لَكَ رَقَبَتُهُ وَفَاضَتْ لَكَ عَيْنَاهُ وَذَلَّ جَسَدُهُ وَرَغِمَ أَنْفُهُ لَكَ اللّٰهُمَّ لَا تَجْعَلْنِي بِدُعَائِكَ رَبِّ شَقِيَّا وَكُنْ بِي رَءُوفًا رَحِيمًا يَا خَيْرَ الْمَسْئُولِينَ وَيَا خَيْرَ الْمُعْطِينَ

‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কথা শুনছ, আমার অবস্থান দেখছ, আমার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবই অবগত আছ। আমার কোন কিছুই তোমার কাছে গোপন নয়। আমি দুর্দশাগ্রস্ত-ফকীর, ফরিয়াদকারী-আশ্রয় প্রার্থী, ভীত-সন্ত্রস্ত এবং স্বীয় অপরাধের স্বীকৃতি প্রদানকারী। মিসকীনের ন্যায় তোমার কাছে যাচনা করছি এবং অপদস্ত অপরাধীর ন্যায় তোমার কাছে কাকুতি-মিনতি করছি। হে আল্লাহ্! আমি তোমাকে ঐ ভীত অন্ধের ন্যায় আহবান করছি, যার গর্দান তোমার জন্য অবনত, যার উভয় চোখ তোমার জন্য অশ্রম্ন প্রবাহিত করছে, যার শরীর তোমার অধীন হয়েছে এবং যার নাক তোমার জন্য ধূলোমলিন হয়েছে। হে আল্লাহ্! হে আমার রব্! আশা করি, তোমার কাছে দু’আ করার পর আমাকে বঞ্চিত করবে না। হে সর্বোত্তম প্রার্থনার স্থল! হে সর্বোত্তম দাতা! তুমি আমার প্রতি ক্ষমাশীল ও মেহেরবান হয়ে যাও’’।[2]

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) আমর বিন শুআইব হতে তিনি তার পিতা হতে, তার পিতা তার দাদা হতে বর্ণনা করেন যে, নাবী (ﷺ) আরাফার দিন যে দু’আটি খুব বেশী করেছেন, সেটি হচ্ছে-

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ

‘‘এক মাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরীক নেই। মালিকানা তাঁরই। সমুদয় প্রশংসা তাঁরই জন্য। তাঁর হাতেই সমস্ত কল্যাণ। তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান। এ পর্যন্ত যত দু’আ বর্ণনা করা হল সেগুলোর সনদে দুর্বলতা রয়েছে।[3]

আরাফার ময়দানে অবস্থানকালে তাঁর উপর কুরআনের এই আয়াতটি নাযিল হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمْ الْإِسْلَامَ دِينًا

‘‘আজকের দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নিয়ামাতকে পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম।[4]

[1]. তিরমিযী ও ইবনে খুযায়মা। তবে ইমাম আলবানী এই হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুন যঈফা, হা/২৯১৮।

[2]. ইমাম তাবারানী রহঃ) আল-মু’জামুল কাবীরে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলবানী এই হাদীসটিকেও যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ যঈফুল জামে, হা/১১৮৬।

[3]. কিন্তু সর্বশেষ দুআর হাদীছ বিশুদ্ধ।

[4]. সূরা মায়েদা-৫:৩