ইতেকাফের ক্ষেত্রে নাবী (সাঃ) এর সুন্নাত

আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা এবং তাঁর দিকে সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তন ব্যতীত অন্তরের সংশোধন এবং আল্লাহর পছন্দনীয় পথে চলা সম্ভব নয়। আর আল্লাহর দিকে সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তন ব্যতীত অন্তরের প্রশান্তি লাভ করা যায়না।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানাহার, মানুষের সাথে অধিক মেলামেশা, অতিরিক্ত ঘুম এবং বেশী কথা বলা মানুষের অন্তরে অশান্তি সৃষ্টি করে, তাতে পেরেশানী বৃদ্ধি করে, আল্লাহর পথ থেকে দূরে রাখে এবং আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের পথে চলতে ব্যঘাত সৃষ্টি করে অথবা তার সামনে সেই পথকে বন্ধ করে দেয়। তাই মহা পরাক্রমশালী দয়াময় আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য সিয়ামর মাধ্যমে এমন বিধান শরীয়ত ভুক্ত করেছেন যা তাদেরকে অতিরিক্ত পানাহার থেকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী অতিরিক্ত শাহ্ওয়াত (যৌন চাহিদা) থেকে মন ও মগজকে পবিত্র রাখবে। সিয়াম থেকে তিনি (আল্লাহ্) সেই পরিমাণ ফরয ও নির্ধারণ করেছেন, যা কাঙ্খিত লক্ষ-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য যথেষ্ট এবং বান্দা তার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে উপকৃত হবে এবং তা পালন করলে তাদের কোন ক্ষতিও হবেনা। রমযান মাসের শেষের দিকে ইতেকাফ করাকে শরীয়তভুক্ত করেছেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মাখলুক (সৃষ্টি) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অন্তরকে আল্লাহর আনুগত্যের উপর আটকিয়ে রাখা এবং একমাত্র তাঁর দিকেই একাকী মনোনিবেশ করা।

এই একাকিত্বের মাধ্যমে বানদা সৃষ্টির সাথে সখ্যতা ও সম্পর্ক গড়ে তোলার পরিবর্তে মহান আল্লাহর সাথে একান্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলবে। এই সম্পর্ক তাকে কবরে একা থাকার জন্য প্রস্ত্তত করে তুলবে।

সিয়াম রাখার মাধ্যমে যেহেতু উপরোক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়, তাই সিয়ামের শ্রেষ্ঠতম দিনসমূহে তথা রামাযানের শেষ দশকে ইতেকাফ করা ইসলামী শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা কেবল সিয়ামর সাথেই ইতেকাফের কথা উল্লেখ করেছেন। রসূল (ﷺ) সিয়াম ব্যতীত কখনও ইতেকাফ করেন নি।

অতিরিক্ত কথা বলা সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা হল আখিরাতে যে সমস্ত কথা কোন উপকারে আসবেনা, তা থেকে জবানকে হেফাজত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ঘুম সম্পর্কে কথা হচ্ছে রাতে অযথা জেগে থাকার চেয়ে তাহাজ্জুদ সলাত পড়াকে উত্তম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিণামের দিক থেকে এটিই উত্তম। রাতে সেই পরিমাণ তাহাজ্জুদ পড়ার কথা বলা হয়েছে, যা শরীর ও ‘রূহের জন্য উপকারী এবং বান্দার দুনিয়াবী স্বাভাবিক কাজ কর্মের পথেও ব্যঘাত সৃষ্টি করেনা।

এই চারটি তথা কম খাওয়া, মানুষের সাথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মেলামেশা না করা, কম ঘুমানো এবং কম কথা বলা সালফে সালেহীন তথা পূর্ব যামানার সৎকর্মশীল লোকদের আমল ছিল। যারা নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এর পথ অনুসরণ করেছেন তারাই এই কাজগুলো করার মাধ্যমে সৌভাগ্যবান হয়েছেন। তারা বাড়াবাড়ি কারীদের ন্যায় গোমরাহ হয়ে যান নি এবং অলসতাকারীদের ন্যায় ত্রুটিও করেন নি।

সিয়াম, কিয়ামুল্লাইল এবং কথা বলার ক্ষেত্রে রসূল (ﷺ) এর হিদায়াতের বিবরণ পেশ করলাম। এবার ইতেকাফ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

নাবী (ﷺ) মৃত্যু পর্যন্ত রামাযানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করেছেন। একবার তিনি তা ছেড়ে দিয়ে শাওয়াল মাসে কাযা করেছেন। লাইলাতুল কদর অর্জন করার জন্য তিনি একবার প্রথম দশকে, একবার মাঝের দশকে, আরেকবার শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। অতঃপর যখন সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, লাইলাতুল কদর রামাযানের শেষ দশকেই তখন থেকে তিনি তাঁর প্রভুর সান্নিধ্যে পৌঁছা পর্যন্ত শেষ দশকেই ইতেকাফ করেছেন এবং তাতে লাইলাতুল কদর তালাশ করেছেন। তাঁর আদেশক্রমে মসজিদে ছোট একটি তাঁবু টানানো হত। তাতে তিনি তাঁর মহান প্রভুর জন্য নির্জনে ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তিনি ইতেকাফের ইচ্ছা করলে ফজরের সলাতের পর ইতেকাফের স্থলে প্রবেশ করতেন। একবার তাঁর জন্য তাঁবু টানানোর আদেশ করা হলে তা টানানো হল। তাঁর অনুসরণ করে তাঁর স্ত্রীগণও নিজ নিজ তাঁবু টানিয়ে ফেলল। তিনি ফজরের সলাত পড়ে সেই তাঁবুগুলো দেখে (ক্রোধান্বিত হয়ে) তাঁর তাঁবু উঠিয়ে ফেলার আদেশ দিলেন। সেই বছর রমযান মাসে তিনি ইতেকাফ করা বাদ দিলেন এবং শাওয়াল মাসের প্রথম দশকে ইতেকাফ করলেন।

তিনি প্রত্যেক বছর দশ দিন ইতেকাফ করতেন। যে বছর তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন সেই বছর তিনি বিশ দিন ইতেকাফ করেছেন। প্রত্যেক বছর জিবরীল ফিরিস্তা তাঁকে সম্পূর্ণ কুরআন একবার পাঠ করে শুনাতেন। যে বছর তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন সেই বছর দুইবার পাঠ করে শুনিয়েছেন। এমনিভাবে তাঁর উপর প্রত্যেক বছর একবার কুরআন পেশ করা হত। মৃত্যুর বছর তাঁর উপর দুইবার পেশ করা হয়েছিল।

তিনি একাকী ইতেকাফের স্থানে প্রবেশ করতেন এবং বিনা প্রয়োজনে নিজ ঘরে প্রবেশ করতেন না। মসজিদের জানালা দিয়ে তিনি আয়িশা (রাঃ) এর ঘরে মাথা প্রবেশ করিয়ে দিতেন। আয়িশা (রাঃ) তাঁর মাথায় চিরুনী করে দিতেন। অথচ তিনি ছিলেন ঋতুবতী।

ইতেকাফের স্থানে তাঁর কতক স্ত্রী তাঁকে দেখতে আসতেন। চলে যাওয়ার জন্য তাঁর সেই স্ত্রী যখন দাঁড়াতেন তখন তিনিও বিদায় দেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন। আর এমনটি হত রাত্রিতে। ইতেকাফে থাকা অবস্থায় তিনি স্ত্রীদের সাথে সহবাস করতেন না, তাদেরকে চুম্বনও করতেন না এবং এ ধরণের অন্য কিছুই করতেন না। তাঁর ইতেকাফের স্থলে চাদর ও খাট-চৌকি স্থাপন করা হত। কোন প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় রাস্তায় কোন রোগীর দেখা মিললে রোগীর হাল-হাকীকতও জিজ্ঞেস করতেন। একবার তিনি তুরস্কে প্রস্ত্ততকৃত একটি তাঁবুতে ইতেকাফ করেছেন এবং তাঁবুর ভিতরে একটি পাটিও বিছানো হয়েছিল।

ইতেকাফের এত বিশদ আলোচনা ও হুকুম-আহকাম এ জন্যই বর্ণনা করা হল, যাতে এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়। আফসোসের বিষয় হল বর্তমানে লোকেরা ইতেকাফের স্থানকে গল্পের আসর এবং যিয়ারতের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করেছে। এই যামানার (ইবনুল কাইয়্যিমের যামানার) লোকদের ইতেকাফ ইতেকাফে মুহাম্মাদী থেকে বহু দূরে সরে এসেছে।