সন্তান এক সম্পদ। নিঃস্ব হলেও সন্তানের আকাঙ্ক্ষা প্রত্যেক মা-বাপের। তাই তো নিঃসন্তান পিতা-মাতা চিকিৎসার্থে কিনা খায়, কোথা না যায়? অবশ্য বৈধভাবে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া দূষণীয় নয়। দূষণীয় হল সন্তানলোভে কোন পীর-ঠাকুর-মাযারের নিকট গেয়ে নযরাদি মেনে সন্তান-কামনা; বরং এ হল খাঁটি শির্ক। আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সন্তান দেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা রাখেন। সুতরাং মুসলিমের উচিৎ, তাঁরই নিকট এই বলে সন্তান চাওয়াঃ-

رَبِّ هَبْ لِيْ مِنَ الصَّالِحِيْنَ

অর্থাৎ, হে প্রভু! আমাকে নেক সন্তান দান কর।[1]

رَبِّ هَبْ لِيْ مِنْ لَّدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً، إِنَّكَ سَمِيْعُ الدُّعَاءِ

অর্থাৎ, হে আমার প্রতিপালক! তুমি তোমার তরফ থেকে আমাকে সৎ বংশধর দান কর, নিশ্চয় তুমি অত্যাধিক প্রার্থনা শ্রবণকারী।[2]

চিকিৎসা-বিজ্ঞানের সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে গর্ভসঞ্চারণ পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান লাভ করতে হলে যদি স্বামীরই বীর্য নিয়ে স্ত্রীর গর্ভাশয়ে কৃত্রিম উপায়ে রেখে প্রজনন সম্ভব হয়, তাহলে এমন সন্তানভাগ্য লাভ করা বৈধ। পক্ষান্তরে স্বামী ব্যতীত অন্য কারো বীর্য দ্বারা এমন প্রজনন হারাম। সে সন্তান নিজের বৈধ সন্তান হবে না; বরং সে জারজ গণ্য হবে।

সন্তান-পিপাসা দূরীকরণার্থে অপরের সন্তান নিয়ে (পালিতপুত্র হিসাবে) লালন-পালন করায় ইসলামের সমর্থন নেই।[3]

কোন পদ্ধতিতে আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কারো নিজ ইচ্ছামত পুত্র বা কন্যা জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿لِلهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثاً وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ- أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَاناً وَإِنَاثاً وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيماً إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ﴾

‘‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা, তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র-কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে বন্ধ্যা রাখেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’’[4]

﴿وَرَبُّكَ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَيَخْتَارُ مَا كَانَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ سُبْحَانَ اللهِ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾

‘‘তোমার প্রতিপালক যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। এতে ওদের কোন হাত নেই। আল্লাহ মহান এবং ওরা যাকে তাঁর অংশী করে তা হতে তিনি ঊর্ধে।[5]

সুতরাং পুত্র-কন্যা জন্মদানের ব্যাপারে স্ত্রীরও কোন হাত বা ত্রুটি নেই। তাই কেবল কন্যাসন্তান প্রসব করার ফলে যারা নিজেদের স্ত্রীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়, তারা নিছক মুর্খ বৈ কি? সবই তো আল্লাহর হাতে। তাছাড়া বীজ তো স্বামীর। স্ত্রী তো উর্বর শস্যক্ষেত্র। যেমন বীজ তেমনি ফসল। সুতরাং দোষ হলে বীজ ও বীজ-ওয়ালার দোষ হওয়া উচিৎ, জমির কেন?

পক্ষান্তরে ২/৩টি কন্যা বা বোনের যথার্থ প্রতিপালন করলে পরকালে মহানবী (ﷺ) এর পাশাপাশি বাসস্থান লাভ হবে।[6]

পরন্তু যে ছেলের আশা করা যায় তা ‘ব্যাটা না হয়ে ব্যথা, ল্যাঠা বা কাঁটা’ও তো হতে পারে। তবে সব কিছুই ভাগ্যের ব্যাপার নয় কি? তকদীরে বিশ্বাস ও সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর উপর যথার্থ ভরসা থাকলে পরম শান্তি লাভ করা যায় সংসারে।

মিলনে যার বীর্যপাত আগে হবে তার বা তার বংশের কারো মতই সন্তানের রূপ-আকৃতি হবে। স্বামীর বীর্যস্খলন আগে হলে সন্তান তার পিতৃকুলের কারো মত এবং স্ত্রীর বীর্যস্খলন আগে ঘটলে সন্তান তার মাতৃকুলের কারো মত হয়ে জন্ম নেবে।[7]

সুতরাং মাতা-পিতা গৌরবর্ণ হলেও সন্তান কৃষ্ণ বা শ্যামবর্ণ অথবা এর বিপরীতও হতে পারে।[8]

কারণ, ঐ সন্তানের পিতৃকুল বা মাতৃকুলে ঐ বর্ণের কোন পুরুষ বা নারী অবশ্যই ছিল যার আকৃতি-ছায়া নিয়ে তার জন্ম হয়েছে।

মিলনের ছয়মাস পর সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া সম্ভব। এতে স্ত্রীর প্রতি সন্দেহপোষণ বৈধ নয়। কারণ সন্তানের গর্ভাশয়ে অবস্থান এবং তার দুধপানের সর্বমোট সময় ত্রিশ মাস।[9] আর তার দুধপানের সময় হল দুই বছর (২৪ মাস)।[10] অতএব অবশিষ্ট ছয়মাস গর্ভের ন্যুনতম সময় নির্ধারণ করতে কোন সন্দেহ নেই।

২/৩ বছর পূর্বে স্বামী-মিলনে সতী-সাধবীর সন্তান অবৈধ নয়। যেহেতু বহু মহিলার গর্ভকাল স্বাভাবিক সময় হতেও অধিক হয়ে থাকে।

গর্ভের সময় সাধভাত, পাঁচভাজা ইত্যাদির উৎসব ও অনুষ্ঠান বিজাতীয় প্রথা। ইসলামে এসব বৈধ নয়। অনুরূপ পোত পাঠানো ইত্যাদি প্রথাও।

গর্ভকালে গর্ভিণী নিজের অথবা তার ভ্রূণের কোন ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে রোযা কাযা করতে পারে।[11]

দাই ও সাহায্যকারিণী ব্যতীত অন্যান্য মহিলাদের সন্তানভূমিষ্ঠ করা দেখা (গর্ভিণীর গুপ্তাঙ্গ দর্শন) বৈধ নয়।[12]

প্রসূতিগৃহে লোহা, ছেঁড়াজাল, মুড়ো ঝাঁটা প্রভৃতি রাখা শির্ক। বৈধ নয় গর্ভিণীর দেহে তাবীয বাঁধা।

প্রসবযন্ত্রণা যতই দীর্ঘ হোক না কেন (খুন না ভাঙ্গলে) নামাযের সময় নামায মাফ নেই। যেভাবে সম্ভব সেইভাবেই নামায পড়তে হবে।[13]

সন্তান-কাঙ্গালী দম্পতির বিপরীত আর এক দম্পতি রয়েছে, যারা সুখী পরিবার গড়ার স্বপ্নে পরিবার-পরিকল্পনা তথা জন্মনিয়ন্ত্রণের সাহায্য নিয়ে থাকে। তাদের শ্লোগান হল ‘আমরা দুই আমাদের দুই’ ইত্যাদি। কিন্তু এইভাবে নির্দিষ্ট-সংখ্যক সন্তান নিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা ইসলাম পরিপন্থী কর্ম। যেহেতু ইসলাম অধিক সন্তানদাত্রী নারীকে বিবাহ করতে উদ্বুদ্ধ করে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা ইসলামের কাম্য।

পরন্তু কেন এ জন্মনিয়ন্ত্রণ? খাওয়াতে-পরাতে পারবে না এই ভয়ে অথবা মানুষ করতে পারবে না এই ভয়ে? প্রথম ভয় যাদের হয়, তারা আল্লাহর প্রতি কুধারণা রাখে। আল্লাহ যাকে সৃষ্টি করেন, তাকে তার রুজীও নির্দিষ্ট করে দেন। আল্লাহ বলেন,

﴿وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللهِ رِزْقُهَا﴾

‘‘পৃথিবীর প্রত্যেক জীবের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই।’’[14]

﴿وَكَأَيِّنْ مِنْ دَابَّةٍ لاَ تَحْمِلُ رِزْقَهَا اللهُ يَرْزُقُهَا وَإِيَّاكُمْ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ﴾

‘‘এমন বহু জীব আছে যারা নিজেদের খাদ্য জমা রাখে না (সংগ্রহ করতে অক্ষম), আল্লাহই ওদেরকে এবং তোমাদেরকে জীবনোপকরণ দান করে থাকেন। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’’[15]

সুতরাং ভয় কিসের? বহু জাতক তো জনককেই যথাসময়ে সুখসামগ্রী দান করে থাকে, তবে জনকের উল্টো ভয় কেন? বরং এইভাবে আল্লাহ উভয়কেই রুজী দিয়ে থাকেন, তবে হত্যা কি জন্য?

আল্লাহ বলেন,

﴿وَلا تَقْتُلُوا أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئاً كَبِيراً﴾

‘‘তোমাদের সন্তানকে দারিদ্র্য-ভয়ে হত্যা করো না, ওদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই রুজী দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই ওদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।’’[16]

আর মানুষ করার ভয় কোন ভয় নয়। মানুষ করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করলে আল্লাহ সাহায্য করবেন।

﴿وَمَنْ يَتَّقِ اللهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْراً﴾

‘‘আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার জন্য সমাধান সহজ করে দেন।’’[17]

তাছাড়া কত সন্তান অমানুষের ঘরেও মানুষরূপে গড়ে উঠে। কোন্ অসীলায় কে মানুষ হয়ে যায়, কে বলতে পারে? আবার কত বাপের একমাত্র ছেলেও অমানুষ হয়েই থেকে যায়। বাস্তবই তার প্রমাণ।

সুতরাং টিউবেক্ট্যামি বা ভ্যাসেক্ট্যামির মাধ্যমে বা গর্ভাশয় তুলে ফেলে জন্মের পথ একেবারে বন্ধ করে দেওয়া বৈধ নয়। অবশ্য যদি মহিলার প্রসবের সময় দমবন্ধ হওয়ার (প্রাণ যাওয়ার) ভয় থাকে অথবা সীজ্যার ছাড়া তার প্রসবই না হয়, তবে এমন সঙ্কটের ক্ষেত্রে অগত্যায় জন্ম-উপায় নির্মূল করা বৈধ হবে।

কিন্তু একেবারে নির্মূল না করে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখা যায় কি না? স্ত্রী যদি প্রত্যেক বৎসর সন্তান দিয়ে দুর্বল ও রোগা হয়ে যায় বা ঘন-ঘন সন্তান দানের ফলে কোন স্ত্রীরোগ তাকে পীড়িতা করে তোলে, তাহলে ট্যাবলেট আদি ব্যবহার করে দুই সন্তানের মাঝের সময়কে কিছু লম্বা করা বৈধ। এর বৈধতা রসূল (ﷺ) এর যুগে কিছু সাহাবীর আয্ল (সঙ্গমে বীর্যস্খলনের সময় যোনীপথের বাইরে বীর্যপাত করা) থেকে প্রমাণিত হয়।[18]

গর্ভবতীর জীবন যাওয়ার আশঙ্কা না হলে গর্ভের ৪/৫ মাস পর ভ্রূণ নষ্ট করা বা গর্ভপাত করা হারাম। কারণ, তা জীবিত এক প্রাণহত্যার শামিল। ৪ মাস পূর্বে কোন রোগ বা ক্ষতির আশঙ্কায় একান্ত প্রয়োজনে বৈধ।

সীজ্যার করে সন্তান প্রসবও বৈধ। মায়ের জান বাঁচাতে মৃত ভ্রূণ অপারেশন করে বের করা ওয়াজেব। যেমন মৃতগর্ভিণীর গর্ভে যদি জীবিত ভ্রূণ থাকে এবং সীজ্যার করে বের করলে তার বাঁচার আশা থাকে, তবে মৃতার সীজ্যার বৈধ; নচেৎ নয়।[19]

ভ্রূণের বয়স ৪ মাস পূর্ণ হয়ে নষ্ট হলে বা করলে তার আকীকা করা উত্তম।[20]

পরিশেষে, আল্লাহ সকল দম্পতিকে চিরসুখী করুন। পরিবার হোক সুখের। পিতা-মাতা হোক আদর্শের। সন্তান হোক বাধ্য। সংখ্যায় শুধু নয়, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান, দ্বীন ও চরিত্রে এক কথায় সর্বকল্যাণে উম্মতের শ্রীবৃদ্ধি হোক।

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَّاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ إِمَامًا

‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং পরহেযগারদের জন্য আমাদেরকে আদর্শস্বরূপ বানাও।’’

وصلى الله على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين

[1] (সূরা আস্সফফাত (৩৭) : ১০০)

[2] (সূরা আলু ‘ইমরান (৩) : ৩৮)

[3] (সূরা আল-আহযাব (৩৩) : ৪)

[4] (সূরা আশ-শূরা (৪২) : ৪৯-৫০)

[5] (সূরা স-দ (২৮) : ৬৮)

[6] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ২৯৬ নং)

[7] (বুখারী ৩৩২৯নং, মুসলিম ৩১৫নং)

[8] (বুখারী ৬৮৪৭,মুসলিম ১৫০০)

[9] (সূরা আল-আহকাফ (৪৬) : ১৫)

[10] (সূরা লুক্বমান (৩১): ১৪)

[11] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১৪/১১০)

[12] (মুসলিম ৩৩৮নং)

[13] (ফাতাওয়াল মারআহ ৩৫পৃঃ)

[14] (সূরা হূদ (১১) : ৬)

[15] (সূরা আল-‘আনকাবূত (২৯) : ৬০)

[16] (সূরা আল-ইসরা (বানী ইসরাঈল (১৭) : ৩১)

[17] (সূরা আত-ত্বলাক (৬৫) : ৪)

[18] (আয-যিওয়াজ ৩১-৩৩পৃঃ, রিসালাতুন ফী দিমাইত ত্বাবীইয়্যাতি লিন্নিসা, ৪৪পৃঃ, ফাতাওয়াল মারআহ ৫২,৯৩পৃঃ, লিকাউল বা-বিল মাফতুহ ২৬/১৮,২১)

[19] (রিসালাতুন ফী দিমাইত ত্বাবীইয়্যাতি লিন্নিসা, ৪৬পৃঃ, তামবীহাতুল মু’মিনাত ৫৩-৫৭পৃঃ)

[20] (লিকাউল বা-বিল মাফতুহ ২৬/৩৪)