নবী-রসূলগণের দা'ওয়াতের পদ্ধতি দা'ওয়াত ও তাবলীগ আবু আহমাদ সাইফুদ্দীন বেলাল ১ টি
তৃতীয় প্রকার উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে দা'ওয়াত ও তাবলীগ

মানুষকে ইসলামের দিকে দাওয়াতের এক গুরুত্বপূর্ণ উত্তম মাধ্যম হলো দায়ীর সুন্দর ব্যবহার, তাঁর প্রশংসনীয় কাজ, উঁচু মানের গুণাবলী ও পূত-পবিত্র চরিত্র যা অন্যের জন্য উত্তম আদর্শরূপে কাজ করবে। ইহা যেন এক খোলা বই যা প্রতিটি মানুষ পড়তে পারে। স্মরণ রাখতে হবে যে, কথার চেয়ে কাজের ও চরিত্রের মাধ্যমে মানুষ অধিক প্রভাবিত হয়ে থাকে। ইসলাম উত্তম চরিত্র ও সুমহান আদর্শের মাধ্যমে সারা বিশ্বে পৌঁছেছে। দায়ীর মধুর ব্যবহার মানুষকে ইসলামের প্রতি প্রবল আগ্রহী করে তোলে। রসূলুল্লাহ ﷺ অহি নাজিল হওয়ার পর খাদীজা (রাঃ) কে বলেন: “আমার জীবনের উপর ভয় হয়।" খাদীজা (রাঃ) নবী ﷺ এর উত্তম চরিত্র ও আদর্শের কথা উল্লেখ করে বলেন: না, এমন চরিত্রবান মানুষকে আল্লাহ তা'য়ালা কখনো ধ্বংস করতে পারেন না।

একজন গ্রাম্য মানুষ এসে রসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞাসা করল আপনি কে? তিনি উত্তরে বললেন, আমি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ। আবার ঐ লোকটি বলল, আচ্ছা আপনি কি সেই ব্যক্তি যাকে মিথ্যুক বলা হয়? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, হ্যাঁ আমার ব্যাপারে কিছু মানুষ এমন ধারণা করে থাকে। তখন ঐ লোকটি বলল, এ চেহারাটি কখনো মিথ্যাবাদীর চেহারা নয়। এরপর লোকটি ইসলাম গ্রহণ করে।

উত্তম আদর্শের মূল দু'টি জিনিস: প্রথমটি উত্তম চরিত্র আর দ্বিতীয়টি কথার সঙ্গে কাজের মিল। অতএব, একজন দায়ীকে আদর্শবান হওয়ার জন্য তাঁর চরিত্র উত্তম করার জন্য সর্বদা প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে এবং কথার সাথে কাজের মিল রাখার জন্য সব সময় মনোযোগী হতে হবে।

দাওয়াতের কিছু উত্তম মাধ্যম:

১. কুরআনের শিক্ষা ও প্রচার।

আবু হুরাইরা [রাঃ] থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী ﷺ বলেছেন:

مَا مِنَ الْأَنْبِيَاءِ نَبِيٌّ إِلَّا أُعْطِيَ مِنَ الْآيَاتِ مَا مِثْلُهُ آمَنَ عَلَيْهِ الْبَشَرُ، وَإِنَّمَا كَانَ الَّذِيْ أُوْتِيْتُ وَحْيًا أَوْحَاهُ اللهُ إِلَيَّ فَأَرْجُوْ أَنْ أَكُوْنَ أَكْثَرَهُمْ تَابِعًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ

“আমার পূর্বে প্রতিটি নবীকে মু'জিজা দান করা হয়েছিল। যার প্রতি মানুষ ঈমান এনেছিল। আর আল্লাহ আমাকে এমন অহী (কুরআন) দান করেছেন যার অনুসারীদের সংখ্যা রোজ কিয়ামতে সবচেয়ে বেশি হবে বলে আমি আশাবাদী।” [বুখারী ও মুসলিম]

وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوْحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِيْ مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيْمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُوْرًا نَهْدِيْ بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِيْ إِلىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيْمٍ

" এমনিভাবে আমি আপনার কাছে ফেরেশতা প্রেরণ করেছি আমার আদেশক্রমে। আপনি জানতেন না, কিতাব কি এবং ঈমান কি। কিন্তু আমি একে করেছি নূর, যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা পথপ্রদর্শন করি। নিশ্চয় আপনি সরল পথপ্রদর্শন করেন।" [সূরা শূরা: ৫২]

২. উম্মতের মাঝে নবী ﷺ এর মর্যাদাকে উঁচু করে তুলে ধরা এবং হাদীসের কিতাবগুলোর প্রচার-প্রসার করা। প্রতিটি বাড়িতে হাদীসের গ্রন্থগুলোর কপি অবশ্যই থাকতে হবে। বিশেষ করে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফ।

৩. মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানকে আল্লাহর দায়ী হওয়া।

الَّذِيْنَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلهِ عَاقِبَةُ الْأُمُوْرِ

"তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত।" [সূরা হাজ্ব: ৪১]

উসমান ইবনে আফফান [রাঃ] বলেন:

إِنَّ اللهَ لَيَزَعُ بِالسُّلْطَانِ مَا لَا يَزَعُ بِالْقُرْآنِ

নিশ্চয় আল্লাহ তা'য়ালা বাদশাহর দ্বারা এমন কিছু কায়েম করেন যা কুরআন দ্বারা করেন না। (বাদারিউসসুলুক কী ত্ববাইল মুলুক : ১/৬)

৪. দা'ওয়াত ইলাল্লাহ করার জন্য উম্মতের সকলকে শক্তিশালী করা।

আল্লাহ তা'য়ালার বাণী:

وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْnَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ

“আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম।” [সূরা আল-ইমরান: ১০৪]

আল্লাহ তা'য়ালার বাণী:

كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ

“তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।” [সূরা আল-ইমরান: ১১০]

নবী ﷺ এর বাণীঃ

بَلِّغُوا عَنِّيْ وَلَوْ آيَةً

"একটি আয়াত হলেও তা আমার থেকে প্রচার কর।” [বুখারী]

নবী ﷺ এর আরো বাণী:

نَصَرَ اللهُ امْرَأً سَمِعَ مَقَالَتِيْ فَبَلَّغَهَا فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ غَيْرِ فَقِيْهٍ وَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ

"আল্লাহ ঐ ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল করবেন যে আমার বাণী শুনে এবং তা প্রচার করে। কিছু ফিকাহ বহণকারী ফকীহ নয়। আর কিছু ফিকাহ বহণকারী এমন ব্যক্তির নিকট পৌঁছে দেয় যে তার চেয়ে অধিক ফকীহ বুঝমান।” [সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ : ১/৪৫ সহীহুল জামে'-আলবানী হা: নং ৬৭৬৪]

৫. তরবিয়তকারী আলেমগণ।

৬. মসজিদের কর্মতৎপরতাকে পুনর্জীবিত করা।

৭. জাকাত ও সাধারণ দান-খয়রাত জমা করে জনকল্যাণ মূলক কাজগুলোর গুরুত্বারোপ দেওয়া।

৮. রমজান মাস দা'ওয়াত ও হেদায়েতের মাস।

৯. হজ্জ দাওয়াতের এক উপযুক্ত সময়।

১০. সঠিক আকিদার দাওয়াতের জামাতসমূহ।

১১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ।

১২. সর্বপ্রকার উপকারী আধুনিক মিডিয়া তথা প্রচার মাধ্যমসমূহ।

১৩. ব্যক্তিগত সম্পর্ক এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

উপসংহার

এর মাধ্যমেই একমাত্র আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পায় কিতাবটি সম্পূর্ণ ও সমাপ্ত হল।

فَالْحَمْدُ لِلهِ الَّذِيْ بِنِعْمَتِهِ تَتِمُّ الصَّالِحَاتُ، وَلَهُ الْحَمْدُ وَالشُّكْرُ أَهْلُ الثَّنَاءِ وَالْمَجْدِ، أَحَقُّ مَا قَالَ الْعَبْدُ، وَكُلُّنَا لَكَ عَبْدٌ، لَا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلَا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ، وَلَا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ

সুতরাং, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যার অনুগ্রহে সৎকর্মসমূহ পূর্ণতা লাভ করে। তাঁরই জন্য সকল গুণগান ও শুকরিয়া, তিনি প্রশংসা ও মর্যাদার অধিকারী। বান্দা যা বলে তিনি তার বেশি হকদার।

হে আল্লাহ! আমরা সবাই আপনার বান্দা। যাকে আপনি প্রদান করেন তাতে বাঁধা দানকারী কেউ নেই। পক্ষান্তরে যাকে আপনি বঞ্চিত করেন তাকে প্রদানকারী কেউ নেই। কোন মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিকে তার মর্যাদা কোনই উপকার করবে না।

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

"হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ দান করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি দান করুন।" [সূরা বাকারা : ২০১]

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ إِمَامًا

"হে আমাদের রব! আমাদেরকে চক্ষু শীতলকারী স্ত্রী-সন্তান দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বা শাসক বানান।” [ফুরকান: ৭৪]

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ

"হে পরওয়ারদেগার! হেদায়েত দানের পর আমাদের হৃদয়কে বক্র করে দিবেন না। আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য রহমত প্রদান করুন। নিশ্চয়ই আপনি অধিক প্রদানকারী।” [সূরা আল- ইমরান:৮]

قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُوْنَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ

“হে আমাদের লালনকারী। আমরা আমাদের আত্মার উপর জুলুম করেছি। যদি আপনি ক্ষমা ও দয়া না করেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।" [সূরা আ'রাফ: ২৩]

رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِيْنَا أَوْ أَخْطَأْنَا رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِنَا رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا أَنْتَ مَوْلَانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِيْنَ

“হে আমাদের রব! যদি আমরা ভুলে যাই বা ভুল করি তাহলে আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। আমাদের উপর এমন বোঝা চাপিয়ে দিবেন না যেমন বোঝা চাপিয়ে ছিলেন আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর। হে আমাদের প্রতিপালনকারী। আমাদের উপর এমন বোঝা চাপাবেন না যা বহন করার সাধ্য আমাদের নেই। (হে আমাদের রব!) আমাদেরকে মার্জনা করুন, ক্ষমা করুন এবং দয়া করুন। কেননা, আপনিই একমাত্র আমাদের মাওলা- অভিভাবক। সুতরাং, কাফের জাতির উপর আমাদেরকে বিজয় দান করুন।” [সূরা বাকারা : ২৮৬]

سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ

সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি, সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়াবিহামদিকা আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আনতা, আস্তাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইকা।”

وَالْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ

"সমস্ত প্রশংসা একমাত্র বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।"

হে আল্লাহ! আমাদের সকলকে তোমার নবীর উত্তম চরিত্র ও মহান আদর্শ দান করুন এবং অন্যকে বলার আগে নিজে আমল করার তওফিক দান করুন। আমীন।

وَصَلَّى اللهُ وَسَلَّمَ عَلَى نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّيْن