নবী-রসূলগণের দা'ওয়াতের পদ্ধতি দা'ওয়াত ও তাবলীগ আবু আহমাদ সাইফুদ্দীন বেলাল ১ টি
মানুষের অন্তরে সুপ্রভাব বিস্তারের জন্য নবী রসূলগণের কিছু মাধ্যম ও পদ্ধতি

নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম মানুষের অন্তরের তালা খোলা প্রয়োজন। এরপর সে পথ ধরে তার মাঝে প্রবেশ করা। আর এই পদ্ধতি মানুষের অন্তরকে শিকার করার জন্য একটি তাঁর স্বরূপ। এর দ্বারা অন্তরকে নরম করা, দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখা এবং আছাড় খেয়ে পড়া থেকে অব্যহতি পাওয়া যায়। ইহা এমন একটি গুণ যা দ্বারা দ্রুত অন্তরে প্রভাব বিস্তার ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা যায়। ইহা অর্জন করার জন্য একজন দায়ীকে সর্বদা সচেষ্ট হতে হবে; কারণ এর দ্বারা অন্তরে ঢুকতে পারবেন এবং সুউচ্চ ও মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন। এর জন্য নবী-রসূলদের কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন

১. মুচকি ও মৃদু হাসি

   খাদ্যের মজা ও স্বাদ যেমন লবণ ছাড়া সম্ভব না তেমনি মুচকি হাসি ব্যতীত অন্তরে প্রভাব বিস্তার করাও অসম্ভব।

   عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ قَالَ لِي النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَحْقِرَنَّ   مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ. رواه مسلم

   আবু যার [রাঃ] থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী ﷺ আমাকে বলেছেন: "ভাল জিনিস অল্প হলেও তুচ্ছ মনে কর না; যদিও মৃদু হাসি দ্বারা তোমার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করাও হোক না কেন।"[মুসলিম]

   আর আব্দুল্লাহ ইবনে হারেছ [রাঃ] বলেন:

   مَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَكْثَرَ تَبَسُّمًا مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. رواه الترمذي

   আমি রসূলুল্লাহ ﷺ এর চেয়ে অধিক মুচকি হাসি আর কারো মুখে দেখিনি। [সহীহ তিরমিযী, হা: নং ৩৬৪১]

২. প্রথমে সালাম দেওয়া:

   ইহা এমন একটি তাঁর যা দ্বারা অন্তরের গভীরে পৌঁছা এবং শিকার নিজের হাতের সামনে এসে যায়। চেহারাকে হাসা উজ্জ্বল ও প্রফুল্লতা রাখার চেষ্টা করবেন। আর উষ্ণ সাক্ষাৎ ও মহব্বতের সাথে করমর্দন করবেন। উমার আননাদী বলেন: আমি একবার আব্দুল্লাহ ইবনে উমার [রাঃ]-এর সঙ্গে বের হই। তিনি ছোট-বড় যার সাথে সাক্ষাৎ করেন তাকেই সালাম দেন।

   নবী ﷺ বলেছেন:

   لَا تَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَوَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوهُ تَحَابَبْتُمْ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ. رواه مسلم

   "তোমরা মুমিন না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর আপোসে একে অপরকে ভালোবাসা না পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি জিনিসের কথা বলে দিব না যা করলে তোমরা আপোসে ভালোবাসতে পারবে। নিজেদের মাঝে বেশি বেশি সালাম প্রচার করবে।” [মুসলিম]

৩. উপহার ও উপঢৌকন দেওয়া:

   উপহারের আশ্চর্য ধরনের প্রভাব পড়ে। ইহা দ্বারা মানুষের কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর অতি সহজে জয় করা যায়। এর দ্বারা ভালোবাসা সৃষ্টি হয়।

   নবী ﷺ বলেছেন:

   تَصَافَحُوا يَذْهَبِ الْغِلُّ وَتَهَادَوْا تَحَابُّوا وَتَذْهَبِ الشَّحْنَاءُ. رواه مالك في الموطأ

   “তোমরা আপোসে সালামে করমর্দন কর: ইহা হিংসাকে দূর করে দেয়। আর উপঢৌকন দেওয়া নেওয়া কর এতে ভালোবাসা সৃষ্টি হয় এবং বিদ্বেষ চলে যায়।

   [মুওয়াত্তা মালেক, ইবনে আব্দুল বার বলেন: হাদীসটি অনেকগুলো হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে, শাইখ আলবানী (রহ:) হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন, যঈফুল জামে' হা: নং ২৯৪১]

৪. নিরবতা পালন এবং অল্প কথা বলা:

   প্রয়োজন ও উপকার ছাড়া কথা না বলা এবং বেশি বেশি না হাসা। জাবের ইবনে সামুরা [রাঃ] বলেন:

   كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَوِيلَ الصَّمْتِ قَلِيلَ الضَّحِكِ. رواه أحمد

   "নবী ﷺ দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকতেন এবং খুবই কম হাসতেন।” [হাদীসটি সহীহ, সহীহুল জামে' হা: নং ৪৮২২]

   নবী ﷺ বলেছেন:

   وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ. متفق عليه

   “আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা চুপ থাকে।” [বুখারী ও মুসলিম]

৫. অন্যের কথা সুন্দরভাবে শুনা ও চুপ থাকা:

   নবী ﷺ কখনো কারো কথা না শুনে মধ্যখানে কেটে দিতেন না। বরং যতক্ষণ পর্যন্ত কথকের কথা বলা বন্ধ না হত ততক্ষণ তিনি কথা বলতেন না। অন্যের কথা পূর্ণভাবে শ্রবণ করা এক প্রকার জাদু। আতা (রহ:) বলেন: মানুষ আমার সঙ্গে কথা বললে আমি চুপ করে শ্রবণ করি যেন আমি উহা শুনি নাই। অথচ আমি উহা তার জন্মের পূর্বেই শুনেছি।

৬. বাহ্যিক দৃশ্য ও পোশাক-পরিচ্ছেদ সুন্দর হওয়া:

   নবী ﷺ বলেছেন:

   إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ. رواه مسلم

   “আল্লাহ তা'য়ালা সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন।"[মুসলিম]

   উমার ফারুক [রাঃ] বলেন: আমার নিকট ঐ এবাদতকারী যুবক পছন্দ যার পোশাক-পরিচ্ছেদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধ-সুরভিত।

   ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ:)-এর ছেলে আব্দুল্লাহ (রহ:) বলেন: আমি আহমাদ ইবনে হাম্বলের চেয়ে বেশি পরিস্কার-পরিছন্ন পোশাক ও চকচকে এবং ধবধবে সাদা কাপড় কারো দেখেনি। তিনি নিজের শরীর ও মোচ, মাথার চুল ও শরীরের অন্যান্য স্থানের চরমভাবে যত্ন নিতেন।

৭. সামাজিক কল্যাণকর কাজের আঞ্জাম দেওয়া ও মানুষের প্রয়োজন মেটানো:

   আল্লাহর বাণী:

   وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

   “তোমরা অনুগ্রহ কর নিশ্চয় আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের পছন্দ করেন।" [সূরা বাকারা: ১৯৫]

   নবী ﷺ বলেছেন:

   أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ.

   "আল্লাহর নিকট সবচয়ে প্রিয় মানুষ হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে মানুষের সর্বাধিক উপকার করে।" [হাদীসটি হাসান, সহীহুল জামে' হা: নং ১৭৬]

   এ ব্যাপারে নবী ﷺ এর বহু ঘটনা ও প্রমাণ।

৮. সম্পদ ব্যয় করা:

   অনেক মানুষের অন্তরের চাবি হলো সম্পদ। নবী ﷺ বলেছেন।

   إِنِّي لَأُعْطِي الرَّجُلَ وَغَيْرُهُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْهُ خَشْيَةَ أَنْ يَكُبَّهُ اللَّهُ فِي النَّارِ. متفق عليه

   "আমি একজন মানুষকে দেই কিন্তু অন্যরা তার চেয়ে আমার নিকট বেশি প্রিয়। এ ভয়ে যে, তাকে আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)

   আর এ জন্যেই জাকাতের অর্থ ব্যয়ের একটি বিশেষ খাত চিত্ত আকর্ষণ যা এরই অন্তর্ভুক্ত।

৯. অন্যদের ব্যাপারে ভাল ধারণা রাখা এবং তাদের জন্য অজুহাত পেশ করা:

   মানুষের অন্তরে প্রবেশের জন্য এরচেয়ে সহজ ও উত্তম পন্থা আর নেই। দায়ীর আশে পাশে যারা আছে তাদের ব্যাপারে ভাল ধারণা রাখবেন এবং খারাপ ধারণা থেকে দূরে থাকবেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ:) বলেন: মুমিন ব্যক্তি তার ভাইদের ওজর তালাশ করেন আর মুনাফেক তালাশ করে ভুল-ত্রুটি।

১০. অন্যদের জন্য ভালবাসা ও বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা প্রকাশ করা:

   ভালবাসার খবর প্রদান করা এমন একটি তাঁর যার দ্বারা অন্তরে প্রবেশ করা ও মানুষকে আয়ত্ব করা সহজ হয়ে যায়।

   عَنْ أَنَسٍ قَالَ مَرَّ رَجُلٌ بِالنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ جَالِسٌ فَقَالَ الرَّجُلُ وَاللَّهِ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي لَأُحِبُّ هَذَا لِلَّهِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَخْبَرْتَهُ بِذَلِكَ قَالَ قَالَ قُمْ فَأَخْبِرْهُ تُثْبِتِ الْمَوَدَّةَ بَيْنَكُمَا. فَقَامَ إِلَيْهِ فَأَخْبَرَهُ فَقَالَ إِنِّي أُحِبُّكَ فِي اللَّهِ أَوْ قَالَ أُحِبُّكَ لِلَّهِ فَقَالَ الرَّجُلُ أَحَبَّكَ الَّذِي أَحْبَبْتَنِي فِيهِ. رواه أبو داود

  আনাস [রাঃ] থেকে বর্ণিত একজন মানুষ নবী ﷺ এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করতেছিল। আর নবী ﷺ এর নিকট একজন মানুষ বসে ছিল। লোকটি বলল: হে আল্লাহর রসূল। আমি এ লোকটিকে ভালোবাসি। রসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: “তাকে কি এ খবর দিয়েছ?” লোকটি বলল: না, তিনি ﷺ বললেন: "যাও তাকে খবর দাও; ইহা তোমাদের দুইজনের মাঝে মহব্বত দৃঢ় করবে।” তখন সে ব্যক্তি লোকটির কাছে গিয়ে খবর দিয়ে বলল: আমি তোমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসি। লোকটি বলল: তুমি যে জন্য আমাকে ভালবাস আল্লাহ যেন সে জন্য তোমাকে ভালবাসেন। [হাদীসটি হাসান, সহীহ সুনানে আবু দাউদ হা: নং ৫১২৫]

   অন্য এক মুরসাল বর্ণনায় মুজাহিদ থেকে উল্লেখ হয়েছে:

   إِذَا أَحَبَّ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ فِي اللَّهِ فَلْيُعْلِمْهُ فَإِنَّهُ أَبْقَى فِي الْأُلْفَةِ وَأَثْبَتُ فِي الْمَوَدَّةِ

   “যখন তোমাদের কেউ তার ভাইকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসে সে যেন তাকে তা জানিয়ে দেয়; কারণ ইহা অন্তরঙ্গতায় গভীরতা সৃষ্টি করে এবং বন্ধুত্বকে সুদৃঢ় করে।” [হাসান, সহীহুল জামে' হা: নং ২৮০]

   তবে শর্ত হলো আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা হতে হবে, কোন মাজহাব বা দল কিংবা বিশেষ কোন তরীকার ভিত্তিতে যেন না হয়। আর বেশি বেশি সালাম দেওয়া ভালবাসা সৃষ্টির একটি উত্তম পন্থা যা পূর্বে উল্লেখ হয়েছে।

১১. কোমল আচরণ:

   তোষামোদ ও মোসাহেবি নয়। নবী ﷺ একজন খারাপ মানুষ দেখে বললেন: লোকটি খারাপ। কিন্তু যখন লোকটি তাঁর ﷺ এর নিকটে আসল তখন তার সাথে কোমল আচারণ করলেন --" [বুখারী]

   ইমাম কুরতুবী (রহ:) বলেন: কোমল আচরণ ও খোশামোদ - মোসাহেবির মাঝে পার্থক্য হলো: কোমল আচরণ হচ্ছে: দ্বীন অথবা দুনিয়া কিংবা উভয়টা ঠিক করার জন্য দুনিয়ার কিছু ব্যয় করা যা জায়েজ বরং কখনো উত্তম হতে পারে। আর খোশামোদ- মোসাহেবি হচ্ছে: দুনিয়া ঠিক করার জন্য দ্বীনকে ত্যাগ করা যা শরিয়তে হারাম।