১১. ঋতুমতী নারীর পবিত্র হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত করণীয় ও বর্জনীয়:

ঋতুমতী নারী হজের সকল কর্ম আঞ্জাম দিবে, যেমন ইহরাম, আরাফায় অবস্থান করা, মুযদালিফায় রাত যাপন করা, পাথর নিক্ষেপ করা, তবে পবিত্র হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কা‘বার তাওয়াফ করবে না। কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ঋতুমতী হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন:

»افعلي ما يفعل الحاج، غير أن لا تطوفي بالبيت حتى تطهري«

“হাজীগণ যা করে তুমি তাই কর, তবে পাক হওয়ার আগ পর্যন্ত কা‘বা তাওয়াফ করো না”।[1]

মুসলিমের বর্ণনা এসেছে:

»فاقضي ما يقضي الحاج، غير أن لا تطوفي بالبيت حتى تغتسلي«

“হাজীগণ যা করে তুমিও তাই কর, তবে গোসল করার আগ পর্যন্ত তাওয়াফ করো না”।[2]

শাওকানী  রহ. ‘নাইলুল আওতার’: (৫/৪৯) গ্রন্থে বলেন: হাদীস স্পষ্ট বলছে যে, ঋতুমতী নারীর রক্ত বন্ধ হওয়া ও গোসল করার আগ পর্যন্ত তাওয়াফ করবে না, আর নিষেধাজ্ঞার দাবি হচ্ছে বাতিল হওয়া, অর্থাৎ ঋতুমতী নারীর তাওয়াফ বাতিল, শুদ্ধই হবে না। এটিই আলেমদের ঐকমত্য। সমাপ্ত।

ঋতুমতী নারী সাফা-মারওয়ায় সা‘ঈও করবে না। কারণ সা‘ঈ করতে হয় তাওয়াফের তাওয়াফের পর, তাওয়াফ ব্যতীত সা‘ঈ শুদ্ধ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফ করে পরে সা‘ঈ করেছেন।

ইমাম নাওয়াওয়ী রহ. ‘আল-মাজমু’: (৮/৮২) গ্রন্থে বলেন: যদি হাজী তাওয়াফের পূর্বে সা‘ঈ করে আমাদের নিকট তার সা‘ঈ শুদ্ধ হবে না -এটিই বলেছেন জমহুর আলেমগণ। আমরা পূর্বে বলেছি যে, মাওয়ারদী এ মাস’আলায় ইজমা‘ নকল করেছেন। এটিই মালিক, আবু হানিফা ও আহমদ রহ. প্রমুখ ইমামদের মাযহাব। ইবনুল মুনযির রহ. আতা ও কতক আহলে হাদীসের কথা বলেন: সা‘ঈ বিশুদ্ধ হবে। আমাদের সাথীগণ আতা ও দাউদ থেকে এ মত বর্ণনা করেছেন।

আমাদের দলীল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফের পর সা‘ঈ করেন এবং তিনি বলেন:

»لتأخذوا عني مناسكم«

“তোমরা আমার থেকে তোমাদের হজ গ্রহণ কর”।[3]

পক্ষান্তরে ইবন শারিক সাহাবীর হাদীস, যেখানে তিনি বলেছেন:

»خرجت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم حاجا، فكان الناس يأتونه، فمن قائل: يا رسول الله سعيت قبل أن أطوف أو أخرت شيئا، أو قدمت شيئا، فكان يقول: لا حرج إلا على رجل اقترض من عرض رجل مسلم وهو ظالم، فذلك الذي هلك وحرج«

“আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথী হয়ে হজের জন্য বের হয়েছি। তখন লোকেরা তার নিকট আসছিল: কেউ বলছে: হে আল্লাহর রাসূল, আমি তাওয়াফের পূর্বে সা‘ঈ করেছি অথবা আমি কিছু পরে করেছি অথবা আমি কিছু আগে করেছি, আর তিনি বলতে ছিলেন: কোনো সমস্যা নেই, তবে তার সম্পর্কে এ কথা বলেন নি, যে অন্যায়ভাবে কোনো মুসলিম ব্যক্তির সম্পদ ঋণ নিয়েছে, সে ধ্বংস ও সমস্যায় পড়েছে”।[4]

হাদীসটি আবু দাউদ সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। হাদীসের সকল রাবী সহীহ গ্রন্থের রাবী, তবে উসামাহ ইবন শারীক সাহাবী ব্যতীত। এ হাদীসের যে অর্থ খাত্তাবী প্রমুখ বর্ণনা করেছেন সেটিই যথাযথ, অর্থাৎ তাওয়াফের পূর্বে সা‘ঈ করেছি অর্থ, তাওয়াফে কুদুমের পর ও তাওয়াফে ইফাদার পূর্বে। সমাপ্ত।

আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ আমীন শানকিতি রহ. তার তাফসীর ‘আদওয়াউল বায়ান’: (৫/২৫২) গ্রন্থে বলেন: জেনে রাখ যে, জমহুর আলেমদের নিকট তাওয়াফ ব্যতীত সা‘ঈ শুদ্ধ নয়, তাওয়াফের পূর্বে সা‘ঈ করলে জমহুর আলেমদের নিকট বিশুদ্ধ হবে না, তাদের মধ্যে রয়েছেন চার ইমাম। মাওয়ারদি ও অন্যান্য আহলে-ইলম এ ক্ষেত্রে উম্মতের ঐকমত্য বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি ইমাম নাওয়াওয়ীর কথা বর্ণনা করেন, যা আমরা ইতোপূর্বে বর্ণনা করেছি। শারীকের হাদীস সম্পর্কে কথা হচ্ছে: “তাওয়াফের পূর্বে” অর্থ তাওয়াফে তাওয়াফে ইফাদার পূর্বে সা‘ঈ করেছি, যা হজের একটি রুকন। এ কথার অর্থ তাওয়াফে কুদুমের পর সা‘ঈ করেছি যা রুকন নয়”। সমাপ্ত।

ইবন কুদামাহ ‘আল-মুগনি’: (৫/২৪৫) গ্রন্থে বলেন: সা‘ঈ তাওয়াফের অনুগামী, তাওয়াফ ব্যতীত সা‘ঈ শুদ্ধ নয়, তাওয়াফের পূর্বে সা‘ঈ করলে শুদ্ধ হবে না। এ কথাই বলেছেন ইমাম মালিক, শাফে‘ঈ ও আসহাবে রায়গণ। আতা বলেছেন: যথেষ্ট হবে। আহমদ থেকে বর্ণিত, ভুলে তাওয়াফের আগে সা‘ঈ করলে যথেষ্ট হবে, ইচ্ছাকৃতভাবে হলে যথেষ্ট হবে না। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন ভুল ও অজ্ঞতায় হজ-কর্ম অগ্র-পশ্চাৎ করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি বলেন: কোনো সমস্যা নেই। প্রথম কথার দলীল হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফের পর সা‘ঈ করেছেন এবং বলেছেন:

»لتأخذوا عني مناسككم«

“তোমরা আমার কাছ থেকে তোমাদের হজ গ্রহণ কর”।[5] সমাপ্ত।

পূর্বের আলোচনা থেকে জানা গেল যে, যারা বলেন তাওয়াফের পূর্বে সা‘ঈ বিশুদ্ধ, হাদীসে তাদের কথার সমর্থন নেই। কারণ, হাদীসের অর্থ দু’টির একটি:

(ক) তাওয়াফে ইফাদার পূর্বে সা‘ঈ করেছি, তবে তাওয়াফে তাওয়াফে কুদুমের পর, অতএব তার সা‘ঈ তাওয়াফের পর সংঘটিত হয়েছে।

(খ) হাদীসটি হজের বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ বা ভুলে হজ-কর্ম অগ্র-পশ্চাতকারী হাজী সম্পর্কে বর্ণিত, ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্র-পশ্চাতকারী সম্পর্কে নয়। এ মাসআলাটি একটু বেশিই বিস্তারিত বললাম। কারণ, বর্তমান এমন কতক লোকের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা সাধারণ অবস্থায় তাওয়াফের পূর্বে সা‘ঈ বৈধ ফতোয়া প্রদান করে। ‘আল্লাহ সহায়।’

জ্ঞাতব্য:

যদি নারী তাওয়াফ করে এবং তাওয়াফ শেষে দেখে যে, তার ঋতু শুরু হয়েছে, তাহলে সে এ অবস্থায় সা‘ঈ করে যাবে। কারণ সা‘ঈর জন্য পবিত্রতা শর্ত নয়। ইবন কুদামাহ ‘আল-মুগনি’: (৫/২৪৬) গ্রন্থে বলেন: অধিকাংশ আহলে ইলম বলেন সাফা ও মারওয়ার মাঝে সা‘ঈ করার জন্য পবিত্রতা শর্ত নয়, যেমন আতা, মালিক, শাফে‘ঈ, আবু সাউর ও আসহাবে রায়গণ... অতঃপর তিনি বলেন: আবু দাউদ বলেন: আমি আহমদকে বলতে শুনেছি: যদি নারী কা‘বা তাওয়াফ করে অতঃপর ঋতুমতী হয়, তাহলে সে সাফা ও মারওয়ার মাঝে সা‘ঈ করবে, অতঃপর বাড়ি রওয়ানা করবে। আয়েশা ও উম্মে সালামাহ থেকে বর্ণিত, তারা উভয়ে বলেছেন: নারী যদি কা‘বা তাওয়াফ ও দু’রাকা‘আত সালাত আদায় করে, অতঃপর ঋতুমতী হয়, তাহলে সে যেন সাফা ও মারওয়ার সা‘ঈ করে নেয়। আসরাম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সমাপ্ত।

[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১১; নাসাঈ, হাদীস নং ২৭৬৩; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭৭৮; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০০০; আহমদ (৬/২৭৩); মালিক, হাদীস নং ৯৪১; দারেমী, হাদীস নং ১৮৪৬
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১১; নাসাঈ, হাদীস নং ২৯০; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭৮২; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৯৬৩; আহমদ (৬/২৭৩)
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৯৭; নাসাঈ, হাদীস নং ৩০৬২; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৯৭০; আহমদ (৩/৩৩৭)
[4] আবু দাউদ, হাদীস নং ২০১৫
[5] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯১২৯৭; নাসাঈ, হাদীস নং ৩০৬২; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৯৭০; আহমদ (৩/৩৩৭)