৯. ৭. ৭. শুধু হত্যার জন্যই হত্যা / ৯. ৭. ৭. ১. ঈশ্বরের পুত্র, খ্রিষ্ট ও নবী দাউদের অকারণ হত্যা

৯. ৭. ৭. শুধু হত্যার জন্যই হত্যা

আমরা দেখলাম যে, ঈশ্বর বা তাঁর মনোনীত প্রিয় প্রজারা যদি কোনো দেশ দখলের সিদ্ধান্ত নেন তবে কোনো কারণ, অজুহাত, উস্কানি বা অপরাধ ছাড়াই সে দেশটা দখল করা এবং নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে তথাকার সকল মানুষ হত্যা করা বাইবেলের নির্দেশনায় বৈধ ও অনুমোদিত কর্ম বা পুণ্যকর্ম। অন্যত্র আমরা দেখি যে, দখলের কোনো প্রয়োজন বা ইচ্ছা ছাড়াও গণহত্যা বাইবেল অনুমোদন করে।

৯. ৭. ৭. ১. ঈশ্বরের পুত্র, খ্রিষ্ট ও নবী দাউদের অকারণ হত্যা

বাইবেলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব দাউদ। সামগ্রিক বিচারে পবিত্র বাইবেলের তৃতীয় ব্যক্তি দাউদ। ইহুদি বাইবেলে তিনি দ্বিতীয়, মোশির পরেই তাঁর মর্যাদার জয়গান করে বাইবেল। আর খ্রিষ্টান বাইবেলে মূলত যীশুর পরেই তাঁর স্থান। নতুন নিয়মে পুরাতন নিয়মের নবীদের মধ্যে দাউদের মর্যাদার কথাই বেশি এসেছে। বাইবেলের বক্তব্যের বিচারে তিনিই প্রথম। তাঁর বিষয়ে এমন কিছু মর্যাদাময় কথা বাইবেল বলেছে যা আর কারো বিষয়ে বলেনি। এমনকি যীশুর বিষয়েও নয়। আমরা দেখেছি, বাইবেলের বক্তব্য অনুসারে যীশু ঈশ্বরের পুত্র ও মসীহ। কিন্তু দাউদ ঈশ্বরের পুত্র, ঈশ্বরের প্রথম পুত্র, ঈশ্বরের জন্মদেওয়া বা জাত পুত্র, ঈশ্বরের মসীহ এবং ঈশ্বরের রাজা। মোশি ও যীশুকে বাদ দিলে তিনিই বাইবেলের মূল চরিত্র। বাইবেল তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। দাউদের বিষয়ে বাইবেল বলছে: ‘‘এই পর্যন্ত আপনার মধ্যে কোনো খারাপী দেখা যায়নি আর যাবেও না।’’ (১ শামুয়েল ২৫/২৮)

বাইবেলে ঈশ্বর বার বার সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, দাউদ সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে তাঁর সকল বিধান পালন করতেন। ঈশ্বরের পূর্ণতম পবিত্র মানুষ হওয়ার তিনিই আদর্শ।  ‘‘দাউদ আমার হুকুম মেনে চলত এবং মনে প্রাণে আমার বাধ্য ছিল। আমার চোখে যা ঠিক সে কেবল তা-ই করত’’ (১ বাদশাহনামা ১৪/৮)। ‘‘আমার গোলাম দাউদের মত আমার নিয়ম ও হুকুম পালন করে আমার চোখে যা ঠিক তা-ই কর তবে আমি তোমার সংগে থাকব’’ (১ বাদশাহনামা ১১/৩৮)।

বাইবেল আরো নিশ্চিত করেছে যে, দাউদের সকল অভিযানে ও হত্যাকাণ্ড- স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর সাথেই থেকেছেন: ‘‘তুমি যে সব জায়গায় গিয়েছ আমি সেখানে  তোমার সামনে থেকে তোমার সমস্ত শত্রুদের শেষ করে দিয়েছি। আমি তোমার নাম দুনিয়ার মহান লোকদের নামের মত বিখ্যাত করব।’’ (২ শামুয়েল ৭/৯)

ঈশ্বরের এ মহান পুত্র (ইবনুল্লাহ), খ্রিষ্ট (মাসীহুল্লাহ) ও নবী দাউদ আজীবন যুদ্ধ করেছেন এবং যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছেন। যুদ্ধের প্রয়োজন ছাড়া এবং বোধগম্য কোনো কারণ ছাড়াও তিনি অনেক মানুষ হত্যা করেছেন বলে বাইবেল জানাচ্ছে। এরূপ একটা হত্যাকাণ্ড ছিল লুটপাটের জন্য নিম্নের হত্যাকাণ্ড।

ঈশ্বরের মসীহ ও নবী তালুত যখন ঈশ্বরের দুষ্ট আত্মা বা খারাপ রূহের প্রভাবে ঈশ্বরের দ্বিতীয় মসীহ দাউদকে হত্যার জন্য তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগলেন তখন দাউদ একজন ফিলিস্তিনিAnchor বাদশাহের কাছে যেয়ে আশ্রয় নিলেন। ফিলিস্তিনি বাদশাহ মানবতা ও সরলতার ভিত্তিতে তাকে আশ্রয় প্রদান করলেন। ফিলিস্তিনি বাদশাহ দাউদকে একটা গ্রাম প্রদান করেন বসবাসের জন্য। দাউদ সেখানে নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারতেন। কারণ ফিলিস্তিনি রাজ্যে যেয়ে তালুত তাকে আর বিরক্ত করতে পারতেন না। কিন্তু দাউদ লুটপাট শুরু করেন। তিনি গশূরীয়, গির্ষীয়, আমালেকীয় ইত্যাদি দেশে লুটপাট ও নির্বিচার গণহত্যা চালাতেন। এরপর ফিলিস্তিনি বাদশাহের প্রিয়ভাজন হওয়ার জন্য তাকে মিথ্যা বলতেন যে, তিনি বনি-ইসরাইলদের এলাকায় লুটপাট করেছেন। এ অকারণ লুটপাট, গণহত্যা ও মিথ্যাচারের কথা ঈশ্বর বাইবেলে সগৌরবে বর্ণনা করেছেন:

‘‘দাউদ মনে মনে ভাবলেন, ‘এই তালুতের হাতেই আমাকে একদিন মারা পড়তে হবে, তাই ফিলিস্তিনীদের দেশে পালিয়ে যাওয়াই আমার পক্ষে সবচেয়ে ভাল হবে। তাহলে ইসরাইল দেশের মধ্যে তিনি আর আমাকে খুঁজে বেড়াবেন না, আর আমিও তাঁর হাত থেকে রক্ষা পাব।’ এই ভেবে দাউদ তাঁর সংগের ছ’শো লোক নিয়ে সেই জায়গা ছেড়ে মায়োকের ছেলে আখীশের কাছে গেলেন। আখীশ ছিলেন গাতের বাদশাহ। দাউদ ও তাঁর লোকেরা গাতে আখীশের কাছে বাস করতে লাগলেন। তাঁর লোকদের প্রত্যেকের সংগে ছিল তাদের পরিবার, আর দাউদের সংগে ছিলেন  তাঁর দুই স্ত্রী, যিষ্রীয়েল গ্রামের অহীনোয়ম এবং কর্মিল গ্রামের অবীগল। অবীগল ছিলেন নাবলের বিধবা স্ত্রী। তালুত যখন জানতে পারলেন যে, দাউদ গাতে পালিয়ে গেছেন তখন তিনি তাঁর খোঁজ করা বন্ধ করে দিলেন । একদিন দাউদ আখীশকে বললেন, ‘আপনি যদি আমার উপর সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তবে এই দেশের কোন একটা গ্রামে আমাকে কিছু জায়গা দিন যাতে আমি সেখানে গিয়ে বাস করতে পারি। আপনার এই গোলাম কেন রাজধানীতে আপনার সাথে বাস করবে?’

তখন আখীশ সিক্লগ শহরটা দাউদকে দান করলেন। সেই থেকে আজও সিক্লগ এহুদার বাদশাহদের অধিকারে আছে। দাউদ ফিলিস্তিনীদের দেশে এক বছর চার মাস ছিলেন। সেই সময়ের মধ্যে তিনি তাঁর লোকদের নিয়ে গশূরীয়, গির্ষীয় ও আমালেকীয়দের দেশে লুটপাট করতে গিয়েছিলেন। এই সব জাতির লোকেরা অনেক কাল আগে শূর থেকে মিসর পর্যন্ত সমস্ত এলাকাটায় বাস করত। দাউদ যখন কোন এলাকায় আক্রমণ করতেন তখন সেখানকার স্ত্রী পুরুষ সবাইকে হত্যা করতেন এবং তাদের ভেড়া, গরু, গাধা, উট, আর কাপড় চোপড় নিয়ে আসতেন। যখন তিনি আখীশের কাছে ফিরে আসতেন তখন আখীশ জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আজ কোথায় লুটপাট করতে গিয়েছিলে?’ জবাবে দাউদ বলতেন যে, তিনি নেগেভে এহুদা এলাকায় কিংবা যিরহমেলীয়দের এলাকায় কিংবা কেনীয়দের এলাকায় গিয়েছিলেন।’

দাউদ কোন স্ত্রীলোক কিংবা পুরুষকে গাতে নিয়ে আসবার জন্য বাঁচিয়ে রাখতেন না, কারণ তিনি মনে করতেন, তারা তাদের বিষয় সব কথা জানিয়ে দিয়ে বলবে যে, দাউদ এই কাজ করেছে। ফিলিস্তিনীয়দের দেশে আসবার পর থেকে দাউদ বরাবরই এই রকম করতেন। কিন্তু আখীশ দাউদকে বিশ্বাস করতেন আর ভাবতেন দাউদ এই সব কাজ করে তাঁর নিজের জাতি বনি-ইসরাইলদের কাছে নিজেকে খুব ঘৃণার পাত্র করে তুলছে আর তাতে চিরকাল সে তার গোলাম হয়ে থাকবে। (১ শামুয়েল ২৭/১-১২)

পাঠক, মানবতা, সহৃদয়তা ও বিশ্বস্ততার বিচারে আপনি কাকে মহান বলবেন? ঈশ্বরের পুত্র দাউদকে? না ফিলিস্তিনি রাজা আখীশকে? নিম্নের বিষয়গুলে দেখুন:

(ক) বাইবেল দাউদের গণহত্যার কারণ উল্লেখ করেছে: (১) লুটপাট করা, (২) ফিলিস্তিনি বাদশাহকে প্রতারণাপূর্বক জানানো যে, তিনি বনি-ইসরাইলদের মধ্যে লুটপাট করেছেন, যাতে তিনি মনে করেন যে, দাউদ আর কখনো বনি-ইসরাইলদের মধ্যে ফিরে যাবেন না, (৩) লুটের কোনো সাক্ষী যেন না থাকে সেজন্য সকলকে হত্যা করা!

(খ) দাউদ নারী-পুরুষ সবাইকে হত্যা করতেন। অর্থাৎ শিশু, দুগ্ধপোষ্য, কিশোর-কিশোরী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নির্বিশেষে সকল মানুষ তিনি হত্যা করতেন।

(গ) ফিলিস্তিনি রাজার আশ্রয়ে এক বছর চার মাস ধরে এভাবে নিয়মিত লুটপাট ও নির্বিচার গণহত্যা চালিয়েছেন। ১৬ মাসে কতবার তিনি লুটতরাজ ও গণহত্যায় বেরিয়েছিলেন? কমপক্ষে ১৬ বার? ১৬টা হামলায় কত হাজার মানুষ মেরেছিলেন? প্রতিবারে ১০ হাজার হলে মোট ১,৬০,০০০? কত সম্পদ লুট করেছিলেন?

(ঘ) কেন এত নির্মম ও নির্বিচার গণহত্যা? বাইবেলের বর্ণনা থেকে আমরা নিশ্চিত যে, দাউদ নিজের গ্রামে শান্তির সাথে বসবাস করতে পারতেন। ফিলিস্তিনি বাদশাহ তাঁকে লুটপাটের দায়িত্ব দেননি, এমনকি বনি-ইসরাইলদের মধ্যে লুটপাটেরও কোনো দায়িত্ব দেননি। একটা মানুষ হত্যারও তাঁর কোনো প্রয়োজন ছিল না। শুধুই লুটপাটের জন্য তিনি বেরোতেন। তাঁর এ লুটপাট যুদ্ধের প্রয়োজনে ছিল না। তিনি তাঁর কোনো শত্রু জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেরোতেন না। শুধু লুটপাটের জন্যই লুটপাট। আর লুটপাট করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটা মানুষকে তিনি হত্যা করেছেন। মামলার সাক্ষ্য গোপনের জন্য সাক্ষীকে হত্যা করা!

দাউদ যখন ফিলিস্তিনি রাজার হেফাযতে বাস করে আমালেকীয় এলাকায় লুট ও গণহত্যা চালাতেন তখন একবার আমালেকীয়রা তাঁর এলাকায় আক্রমণ করে লুট করে এবং সকল মহিলাকে বন্দি করে নিয়ে যায়: ‘‘তারা সিক্লগ আক্রমণ করে পুড়িয়ে দিয়ে সেখানকার সমস্ত স্ত্রীলোকদের এবং ছোট-বড় সবাইকে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য কাউকেই তারা হত্যা করে নি, কেবল ফিরে যাবার সময় তাদের সংগে করে নিয়ে গিয়েছিল।’’ (১ শামুয়েল ৩০/১-২)

পাঠক, এখানে দাউদের লূটপাট ও আমালেকীয়দের লুটপাটের মধ্যে পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন। দাউদ লুটপাটের সময় সকল নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করতেন। পক্ষান্তরে আমালেকীয়রা লুটের সাথে হত্যা করত না। কেবল বন্দি করে নিয়ে যেত! দাউদ এ সকল বন্দিকে ছাড়াতে আমালেকীয়দের আক্রমণ করলেন। তবে তিনি কাউকে বন্দি করার দিকে গেলেন না। তিনি শুধু হত্যা করলেন: ‘‘দাউদ সেই দিন বিকালবেলা থেকে শুরু করে পর দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের সংগে যুদ্ধ করলেন। তাদের মধ্যে কেউই রক্ষা পেল না, কেবল চারশো যুবক উটের পিঠে করে পালিয়ে গেল।’’ (১ শামুয়েল ৩০/১৭)

আমরা দেখেছি, ঈশ্বর বার বারই বলেছেন যে, দাউদ মনে-প্রাণে ঈশ্বরের হুকুম মেনে চলতেন এবং ঈশ্বরের চোখে যা ঠিক দাউদ শুধু তা-ই করতেন। এ থেকে আমরা নিশ্চিত যে, দাউদের এ হত্যাকাণ্ড ঈশ্বরের চোখে পুরোপুরিই ঠিক ছিল।

সুপ্রিয় পাঠক, আপনি কি বাইবেলীয় ঈশ্বরের সাথে একমত হতে পারছেন?