৯. ৬. মনোনীত প্রজাদের পারস্পরিক যুদ্ধের আদর্শ / ৯. ৬. ১. মন্দিরে আগুন ধরিয়ে সহস্রাধিক নারী-পুরুষ হত্যা

৯. ৬. মনোনীত প্রজাদের পারস্পরিক যুদ্ধের আদর্শ

বাইবেলীয় যুদ্ধগুলো আমরা দুভাগে ভাগ করতে পারি: (ক) বাইবেল অনুসারীদের বা ঈশ্বরের মনোনীত প্রজা বনি-ইসরাইলদের পরস্পর যুদ্ধ এবং (খ) বিধর্মীদের বা পরজাতিদের সাথে বনি-ইসরাইলদের যুদ্ধ। প্রথমে আমরা ঈশ্বরের মনোনীত প্রজাদের পারস্পরিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে বাইবেলীয় আদর্শ আলোচনা করব।

৯. ৬. ১. মন্দিরে আগুন ধরিয়ে সহস্রাধিক নারী-পুরুষ হত্যা

বাইবেলীয় ঈশ্বরের একজন প্রিয় বীর, বনি-ইসরাইলের শাসনকর্তা ও সাধু গিদিয়োন (Gideon/ Gedeon), যার উপাধি যিরুববাল (Jerubbaal)। বাইবেলে তাঁকে মহান নবীদের তালিকায় রাখা হয়েছে (কাজীগণ/ বিচারকর্তৃগণ ৬ থেকে ৮ অধ্যায় এবং ইব্রীয়/ইবরানী ১১/৩২)। তিনি মনঃশি/মানশা (Manasseh) গোষ্ঠীর ছিলেন। (বিচারকর্তৃগণ ৬/১৫) খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা গিদিয়োনকে খ্রিষ্টধর্ম ও ধার্মিকতার ‘আদর্শ’ হিসেবে গণ্য করেন। এজন্য তাঁরা গিদিয়োনের নামে আন্তর্জাতিক ধর্মপ্রচার সংস্থা স্থাপন করেছেন। পাঠক ইন্টারনেটে ‘The Gideon Society’ বা ‘Gideons International’ অনুসন্ধান করলেই বিষয়টা জানতে পারবেন। এ মহান ধার্মিক ও সাধুপুরুষ বিষয়ে পবিত্র বাইবেলের বিচারকর্তৃগণ বা কাজীগণ পুস্তকের ৬, ৭, ৮ ও ৯ অধ্যায়ে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এ সকল বিবরণ থেকে তাঁর যে মহান আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য আমরা জানতে পারি তা নিম্নরূপ:

(ক) তিনি যুদ্ধের নামে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ হত্যা করেন।

(খ) তিনি বিধর্মী হওয়ার কারণে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেন।

(গ) তাঁকে সহযোগিতা না করার কারণে তিনি অযোদ্ধা জাতিদেরকেও নির্মমভাবে শাস্তি প্রদান করেন এবং হত্যা করেন।

(ঘ) সর্বোপরি, তিনি একজন মহান পুত্র রেখে যান, যে পুত্র পিতার মতই মহা হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেন। এখানে এ বিষয়ক বাইবেলীয় বিবরণ দেখুন।

ঈশ্বরের এ প্রিয় সাধু, বীর ও শাসনকর্তার অনেকগুলো স্ত্রী ও ৭১ জন পুত্র সন্তান ছিল। ‘‘তাঁর অনেকগুলো স্ত্রী ছিল বলে তাঁর নিজেরই সত্তরজন ছেলে ছিল। শিখিমে তাঁর একজন উপস্ত্রী ছিল। তার ঘরেও তাঁর একটি ছেলে হয়েছিল। গিদিয়োন তাঁর নাম দিয়েছিলেন আবিমালেক (Abimelech)।’’ (কাজীগণ ৮/৩০)

গিদিয়োনের মৃত্যুর পর আবিমালেক তার ৭০ ভাইকে হত্যা করে রাজা হয়। এরপর তার নেতৃত্বে বনি-ইসরাইল পরস্পর হত্যাযজ্ঞ চালায়: ‘‘যিরুববালের ছেলে আবিমালেক শিখিমে তাঁর মামাদের কাছে গিয়ে তাদের এবং তাঁর মায়ের বংশের অন্য সবাইকে বললেন, ‘শিখিমের সমস্ত বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসা করুন কোন্টা তাদের পক্ষে ভাল যিরুববালের সত্তরজন ছেলে তাদের শাসনকর্তা হবে, নাকি একজন লোক হবে? ভুলে যাবেন না আমি আপনাদেরই রক্ত-মাংস।’ আবিমালেকের মামারা শিখিমের লোকদের এইসব কথা বলবার পরে তাদের মধ্যে আবিমালেকের পক্ষে থাকার একট ঝোঁক দেখা গেল। তারা বলল যে, আবিমালেক তাদের আত্মীয়। তারা বাল-বরীতের মন্দির থেকে তাঁকে সত্তর টুকরা রুপা দিল। আবিমালেক তা দিয়ে কতগুলো বাজে দুঃসাহসী লোক ভাড়া করলেন। এরা তাঁর সংগী হল। অফ্রাতে তিনি তাঁর বাবার বাড়ীতে গিয়ে তাঁর সত্তর ভাইদের প্রত্যেককে, অর্থাৎ যিরুববালের ছেলেদের প্রত্যেককে একই পাথরের উপর হত্যা করল। কিন্তু যিরুববালের সব চেয়ে ছোট ছেলে যোথম লুকিয়ে থেকে বেঁচে গেল। তারপর শিখিম ও বৈৎ-মিলেস্নার সমস্ত লোক একত্র হয়ে শিখিমের থামের কাছে এলোন গাছটার পাশে গিয়ে আবিমালেককে বাদশাহ্ করল। আবিমালেক তিন বছর বনি-ইসরাইলদের শাসন করলেন। ...

তারপর আল্লাহ আবিমালেক ও শিখিমের লোকদের মধ্যে একটি খারাপ রুহু পাঠিয়ে দিলেন। তাতে শিখিমের লোকেরা আবিমালেকের সাথে বেঈমানী করল। আল্লাহ এটা করলেন যাতে যিরুববালের সত্তরজন ছেলের উপর রক্তপাতের যে অন্যায় করা হয়েছে তার দরুন তাদের ভাই আবিমালেকের উপর এবং তাদের হত্যা করবার কাজে তাঁর ও তাঁর সাহায্যকারী শিখিমের লোকদের উপর প্রতিশোধ নেয়া হয়। শিখিমের লোকেরা আবিমালেকের বিরুদ্ধে পাহাড়ের উপরে কিছু লোক রাখল, আর তারা লুকিয়ে থেকে সেই পথে যারা যেত তাদের লুটপাট করত। কথাটা আবিমালেককে জানানো হল। কাজেই আবিমালেক ও তাঁর সমস্ত সৈন্যদল রাতের বেলায় বের হয়ে চার দলে ভাগ হয়ে শিখিমের কাছে লুকিয়ে রইল। শহর থেকে বেরিয়ে এবদের ছেলে গাল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় আবিমালেক ও তাঁর সৈন্যরা তাদের লুকানো জায়গা থেকে বের হয়ে আসল। ...

তখন গাল শিখিমের লোকদের পরিচালনা করে নিয়ে গিয়ে আবিমালেকের সাথে যুদ্ধ করল। আবিমালেক গালকে তাড়া করলেন, তাতে সে পালিয়ে গেল। পালাবার পথে তার দলের অনেকেই আঘাত পেয়ে শহরের দরজা পর্যন্ত সারা পথে পড়ে রইল। ... পরের দিন শিখিমের লোকেরা বের হয়ে মাঠে যাচ্ছিল, আর সেই খবর আবিমালেককে জানানো হল। তখন আবিমালেক তাঁর লোকদের তিন দলে ভাগ করলেন এবং তারা মাঠে ওত পেতে রইল। শহর থেকে লোকদের বের হয়ে আসতে দেখে তিনি তাদের আক্রমণ করলেন। আবিমালেক ও তাঁর দলের লোকেরা সামনের দিকে ছুটে গিয়ে শহরে ঢুকবার পথে দাঁড়াল। মাঠের মধ্যে যারা ছিল অন্য দু’দল সৈন্য তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের হত্যা করল। সারাদিন ধরে আক্রমণ চালিয়ে আবিমালেক শহরটা অধিকার করে নিয়ে সেখানকার লোকদের হত্যা করলেন। তারপর শহরটা ধ্বংস করে তার উপর তিনি লবণ ছিটিয়ে দিলেন। এই খবর শুনে শিখিমের কেল্লার লোকেরা এল-বরীৎ দেবতার মন্দিরের ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢুকল।

আবিমালেক যখন শুনলেন যে, লোকেরা সেখানে গিয়ে জমায়েত হয়েছে তখন তাঁর লোকদের নিয়ে তিনি সলমোন পাহাড়ে গিয়ে উঠলেন। তিনি কুড়াল নিলেন এবং গাছ থেকে একটি ডাল কেটে নিয়ে কাঁধের উপরে তুললেন। তারপর তিনি তাঁর লোকদের হুকুম দিলেন, ‘তোমরা আমাকে যা করতে দেখলে তোমরাও তাড়াতাড়ি তা-ই কর।’ কাজেই সকলে গাছ থেকে ডাল কেটে নিয়ে আবিমালেকের পিছনে পিছনে চলল। তারপর তারা সেই ভিতরের ঘরের উপরে সেগুলো জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিল। এতে শিখিমের কেল্লার সমস্ত লোক পুড়ে মারা গেল। সেখানে প্রায় একহাজর পুরুষ ও স্ত্রীলোক ছিল। এরপর আবিমালেক তেবেসে গিয়ে তা ঘেরাও করে দখল করে নিলেন। শহরের মধ্যে ছিল একটা শক্ত কেল্লা; শহরের সমস্ত পুরুষ ও স্ত্রীলোক সেখানে পালিয়ে গেল। তারা  কেল্লায় ঢুকে সেখানকার দরজা বন্ধ করে ছাদে গিয়ে উঠল। আবিমালেক সেই কেল্লার কাছে গিয়ে সেটা হামলা করলেন; কিন্তু কেল্লাটাতে আগুন লাগাবার জন্য যখন তিনি কেল্লার দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন একজন স্ত্রীলোক জাঁতার উপরের পাথরটা আবিমালেকের মাথার উপর ফেলে তাঁর মাথাটা ফাটিয়ে দিল। আবিমালেক তাড়াতাড়ি তাঁর অস্ত্রবহনকারী যুবককে বললেন, ‘তোমার তলোয়ার বের করে আমাকে মেরে ফেল যাতে ওরা বলতে না পারে, একজন স্ত্রীলোকের হাতে সে মারা পড়েছে।’ কাজেই সেই যুবক তাকে তলোয়ার দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল আর তিনি মারা গেলেন। আবিমালেক মারা গেছে দেখে বনি-ইসরাইলরা বাড়ী ফিরে গেল। সত্তরজন ভাইকে হত্যা করে আবিমালেক তাঁর বাবার প্রতি যে অন্যায় করেছিলেন আল্লাহ এভাবেই তার পাওনা শাস্তি দিলেন। শিখিমের লোকেরা যে সব অন্যায় করেছিল তার পাওনা শাস্তি আল্লাহ তাদেরকেও দিলেন।’’ (কাজীগণ ৯/১-৫৭)

সুপ্রিয় পাঠক, ঈশ্বরের প্রিয় মনোনীত জাতির এ হত্যাকাণ্ড-র বর্বরতা ও অমানবিকতা লক্ষ্য করুন। মাঠে হাজার হাজার মানুষ হত্যায় তৃপ্ত না হয়ে মন্দিরের মধ্যে আশ্রয়গ্রহণকারীদেরকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা। আরো লক্ষণীয় বাইবেলীয় ঈশ্বরের বিচারপদ্ধতি। ৭০ জন ভাই হত্যা করতে যারা আবিমালেককে সাহায্য করেছিল শুধু তাদেরকেই শাস্তি দেননি। বরং অপরাধীদের সাথে নিরপরাধ নারী, পুরুষ, শিশু ও কিশোরের নির্মম হত্যাযজ্ঞের ব্যবস্থা করেছেন।