৮. ১. ১৫. জাতি-বৈষম্য (Racism) ও জাতি-বিদ্বেষ

রেভারেন্ড রেমন্ড কিছু কর্মের তালিকা প্রদান করেছেন যা সাধারণত অন্যায় বলে গণ্য কিন্তু বাইবেল তা অনুমোদন করেছে । এগুলোর অন্যতম জাতি-বৈষম্য।

Race শব্দেও অর্থ গোষ্ঠী, বংশ, প্রজাতি, জাতি বা চুলের রং, নাক, মুখ ইত্যাদির ভিত্তিতে মানব জাতির শাখা-প্রশাখা। Racism অর্থ গোষ্ঠী, বংশ, প্রজাতি বা জাতিগত ভেদাভেদ বা বৈষম্যের মতবাদ। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনলাইন ভার্শন ‘Racism’-এর সংজ্ঞায় বলছে: “Prejudice, discrimination, or antagonism directed against someone of a different race based on the belief that one’s own race is superior” ‘‘নিজের গোষ্ঠী বা বংশ অন্যান্যদের চেয়ে উচ্চতর-এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে ভিন্ন কোনো বংশ, গোষ্ঠী বা জাতির কারোর প্রতি লালনকৃত সংস্কার, বৈষম্য অথবা শত্রুতা’’।[1] জাতিগত বৈষম্য (racial discrimination), জাতিবৈষম্যগত সংস্কার (racial prejudice), বিজাতি-আতঙ্ক (xenophobia), বর্ণভেদ বা জাতিভেদ (casteism), বর্ণবাদ বা জাতিবিদ্বেষ (apartheid) ইত্যাদি পরিভাষাও এ অর্থে ব্যবহৃত।

বাইবেল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলে পাঠক সর্বপ্রধান যে বিষয়টা শিখবেন তা হল: ‘‘পৃথিবীর সকল মানবীয় বংশ, গোষ্ঠী বা জাতির চেয়ে বনি-ইসরাইল বংশ উচ্চতর ও পবিত্রতর’’। বনি-ইসরাইল ঈশ্বরের পবিত্র সন্তান,  মনোনীত জাতি ও ঈশ্বরের পবিত্র প্রজা (holy people)। আর অন্য সকল মানুষ  ‘পরজাতি’ (gentile)। এখানে বিশ্বাস, সততা, কর্ম বা অন্য কোনো কিছুই মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় ‘বনি-ইসরাইল’ বংশের মানুষ হওয়া। এ বংশের মানুষ হলেই সে ‘ঈশ্বরের মনোনীত সন্তান’। বাইবেলের সকল বিধান, বিচার, যুদ্ধ ও হত্যা এ বিশ্বাস ও তত্ত্বের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। বাইবেল সমালোচকরা তো বটেই, এমনকি অনেক সচেতন ধার্মিক খ্রিষ্টানও এ বিশ্বাসকে ‘রেসিজম’ (Racism) বা জাতিবৈষম্য বলে গণ্য করছেন। সকল মানুষ ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সমান বা মানবীয় সাম্যের বিশ্বাসের সাথে এটা সাংঘর্ষিক।

আমরা দেখেছি যে, বাইবেলীয় বর্ণনায় মিসরবাসীর সাথে ঈশ্বরের আচরণ পুরোটাই ছিল জাতিবৈষম্য ভিত্তিক। বাইবেলের বর্ণনায় ফেরাউন বা মিসরবাসীকে মোশি ঈমান বা সততার কোনো দাওয়াত দেননি বা তাদেকে ভাল করার কোনো চেষ্টা করেননি। বরং ঈশ্বর নিজের মনোনীত জাতির গৌরব ও শক্তি প্রকাশের জন্য পরিকল্পিতভাবে কখনো তাদের মন কঠিন করেছেন এবং কখনো নরম করেছেন যেন তিনি মিসরীয়দের মারতে এবং ইসরাইলীয়দের সকল সুবিধা দিতে পারেন। বাইবেল অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় এ বৈষম্যের কথা বারবার উল্লেখ করেছে: ‘‘এতে আপনারা জানতে পারবেন যে, মাবুদ মিসরীয় ও বনি-ইসরাইলদের আলাদা করে দেখেন’’ (যাত্রাপুস্তক/ হিজরত ১১/৭)। কি. মো.-১৩: ‘‘মাবুদ মিসরীয়দের ও ইসরাইলের মধ্যে প্রভেদ/ বৈষম্য করেন: (put a difference between...)

ঈশ্বর বলেন: ‘‘তোমরা যে দেশ অধিকার করবার জন্য যাচ্ছ সেখানে তোমাদের মাবুদ আল্লাহই তোমাদের নিয়ে যাবেন এবং অনেক জাতিকে তোমাদের সামনে থেকে তাড়িয়ে দেবেন। এই জাতিগুলো হল, হিট্টীয়, গির্গাষীয়, আমোরীয়, কেনানীয়, পরিষীয়, হিববীয় এবং যিবূষীয়। এই সাতটি জাতিই লোকসংখ্যায় এবং শক্তিতে তোমাদের চেয়ে বড়। তিনি যখন তাদের তোমাদের হাতের মুঠোয় এনে দেবেন এবং তোমরা তাদের হারিয়ে দেবে তখন তোমরা তাদের একেবারে ধ্বংস করে ফেলবে। তোমরা তাদের সংগে কোন সন্ধি করবে না এবং তাদের প্রতি কোন দয়া দেখাবে না। তোমরা তাদের সংগে কোন বিয়ের সম্বন্ধ স্থাপন করবে না। .... তোমরা ঐ সব জাতির বেদীগুলো ভেংগে ফেলবে, পূজার পাথরগুরো চুরমার করে ফেলবে, পূজার আশেরা-খুঁটিগুলো কেটে ফেলবে এবং মূর্তিগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেবে। তোমরা এমন একটি জাতি যাকে তোমাদের মাবুদ আল্লাহর উদ্দেশ্যে আলাদা করে রাখা হয়েছে। তোমরা যেন তোমাদের মাবুদ আল্লাহর নিজের বান্দা ও সম্পত্তি হও সেজন্য দুনিয়ার সমস্ত জাতির মধ্য থেকে তিনি তোমাদের বেছে নিয়েছেন।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ৭/১-৬)

কেরির মূলানুগ অনুবাদে শেষ শ্লোকটা নিম্নরূপ: ‘‘কেননা তুমি আপন ঈশ্বর সদাপ্রভুর পবিত্র প্রজা (holy people); ভূতলে যত জাতি আছে, সে সকলের মধ্যে আপনার নিজস্ব প্রজা করিবার জন্য তোমার ঈশ্বর সদাপ্রভু তোমাকেই মনোনীত করিয়াছেন। (the LORD thy God hath chosen thee to be a special people unto himself, above all people...)’’ কি. মো.-১৩: ‘‘কেননা তুমি তোমার আল্লাহ মাবুদের পবিত্র লোক; ভূতলে যত জাতি আছে, সেই সবের মধ্যে তাঁর নিজস্ব লোক করার জন্য তোমার আল্লাহ মাবুদ তোমাকেই মনোনীত করেছেন।’’

এ জাতি-বৈষম্য বাইবেলের মূল শিক্ষা। ইসরাইল বা যাকোবের বংশের হওয়ার কারণে বনি-ইসরাইল জাতি সকল জাতি থেকে উচ্চতর (above all people that are upon the face of the earth), বংশের কারণেই তারা পবিত্র ও মনোনীত জাতি (holy, chosen people)। বংশ ও রক্তের কারণেই অন্য সকল মানুষ নিম্নতর।

বনি-ইসরাইলের জাতিগত পবিত্রতা ও উচ্চতরতা বাইবেলে একইভাবে বার বার বলা হয়েছে। দু-একটা নমুনা দেখুন: দ্বিতীয় বিবরণ ১৪/২; ১৪/২১; ২৬/১৯; ২৮/৯; যিশাইয় ৬২/১২; দানিয়েল ৮/২৪; ১২/৭ ...।

বর্ণ-বৈষম্য বা জাতি-বৈষম্য বিষয়ক অনেক বিধান বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান। যেমন, বনি-ইসরাইলের কেউ ঋণগ্রস্ত হলে ৭ বছরের মাথায় তার ঋণ মওকুফ করা ধর্মীয়ভাবে জরুরি, তবে অ-ইসরাইলীয় কেউ এ সুযোগ পাবে না। অনুরূপভাবে ইসরাইলীয় কারো কাছ থেকে সুদ নেওয়া যাবে না, তবে অ-ইসরাইলীয়দের থেকে যত খুশি সুদ নেওয়া যাবে। এখানে ধর্ম, বিশ্বাস বা মানবতা মূল বিষয় নয়। বংশ ও গোষ্ঠীই মূল কথা। ইসরাইলীয় হলে সে ভাই; অন্যথায় সে পর।

‘‘প্রতি সপ্তম বছরের শেষে অন্যদের কাছ থেকে তোমাদের পাওনা সব মাফ করে দেবে। এই নিয়মে তা মাফ করতে হবে: প্রত্যেক ইসরাইলীয় পাওনাদার অন্য ইসরাইলীয়কে দেওয়া সব ঋণ মাফ করে দেবে। ঋণ মাফ করে দেবার জন্য মাবুদ যে সময় ঠিক করে দিয়েছেন তা ঘোষণা করা হয়েছে বলে কোন ইসরাইলীয় ভাইয়ের কাছ থেকে ঋণ শোধের দাবি করা চলবে না। ভিন্ন জাতির লোকদের কাছ থেকে ঋণ শোধের দাবি করা চলবে, কিন্তু তোমাদের ভাইদের ঋণ তোমাদের মাফ করে দিতে হবে।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ১৫/১-৩)

‘‘তোমরা কোন ইসরাইলীয় ভাইয়ের কাছ থেকে সুদ নেবে না- সেই সুদ টাকা পয়সার উপরেই হোক কিংবা খাবার জিনিসের উপরেই হোক, কিংবা অন্য যে কোন জিনিসের উপরেই হোক। অন্য জাতির লোকদের কাছ থেকে তোমরা সুদ নিতে পার কিন্তু কোন ইসরাইলীয় ভাইয়ের কাছ থেকে নয়।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ২৩/১৯-২০)

[1] http://www.oxforddictionaries.com/definition/english/racism