ঈশ্বরের সিংহাসনের চির-অধিকারী ও ঈশ্বর-পুত্র (ইবনুল্লাহ) শলোমন ঈশ্বরের ধর্ম পরিত্যাগ করে শেষ জীবনে প্রতিমাপূজার ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মূর্তিপূজক অবস্থাতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এতে তাঁর ঈশ্বরের পুত্রত্ব ও ভাববাদিত্ব নষ্ট হয় নি। আমরা দেখেছি যে, ঈশ্বর তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাবান বলে ঘোষণা করেছেন। তাহলে কি শলোমন তাঁর এ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞার মাধ্যমে অনুধাবন করেছিলেন যে, মাবুদ আল্লাহর ইবাদত করার চেয়ে অন্যান্য দেবদেবীর ইবাদত করাই অধিক উপকারী? ঈশ্বরের দেওয়া এ মহাপ্রজ্ঞা দ্বারা তিনি কি বুঝেছিলেন যে ঈশ্বরের উপাসনা সঠিক নয়; অন্যান্য দেবদেবীর উপাসনাই সঠিক?

১ বাদশাহনামা ১১/১-১৩ (মো.-১৩): বাদশাহ্ সোলায়মান ফেরাউনের কন্যা ছাড়া আরও বিদেশী রমণী, অর্থাৎ মোয়াবীয়া, অম্মোনীয়া ইদোমীয়া, সীদোনীয়া ও হিত্তীয়া রমণীকে মহববত করতেন।   যে জাতিদের বিষয়ে মাবুদ বনি-ইসরাইলদের বলেছিলেন, তোমরা তাদের কাছে যেও না এবং তাদেরকে তোমাদের কাছে আসতে দিও না, কেননা তারা নিশ্চয়ই তোমাদের হৃদয়কে তাদের দেবতাদের পিছনে চলে বিপথগামী করবে, সোলায়মান তাদেরই প্রতি প্রেমাসক্ত হলেন। সাত শত রমণী তাঁর পত্নী ও তিন শত তাঁর উপপত্নী ছিল; তাঁর সেই স্ত্রীরা তাঁর হৃদয়কে বিপথগামী করলো। ফলে এরকম ঘটলো, সোলায়মানের বৃদ্ধ বয়সে তাঁর স্ত্রীরা তাঁর হৃদয়কে অন্য দেবতাদের পশ্চাতগামী করে বিপথগামী করলো; তাঁর পিতা দাউদের অন্তঃকরণ যেমন ছিল, তেমনি তাঁর আল্লাহ্ মাবুদের ভক্তিতে তাঁর অন্তঃকরণ একাগ্র ছিল না। কিন্তু সোলায়মান সীদোনীয়দের দেবী অষ্টারত ও অম্মোনীয়দের ঘৃণ্য দেবতা মিল্কমের অনুগামী হলেন। এভাবে সোলায়মান মাবুদের দৃষ্টিতে যা মন্দ তা-ই করলেন; তাঁর পিতা দাউদের মত সম্পূর্ণভাবে মাবুদের অনুগামী হলেন না।

সেই সময়ে সোলায়মান জেরুশালেমের সম্মুখস্থ পর্বতে মোয়াবের ঘৃণ্য দেবতা কমোশ ও অম্মোনীয়দের ঘৃণ্য দেবতা মোলাকের জন্য উচ্চস্থলী (মো.-০৬: পূজার উঁচু স্থান) নির্মাণ করলেন। তাঁর যত বিদেশী স্ত্রী যার যার দেবতার উদ্দেশে ধূপ জ্বালাত ও পশু কোরবানী করতো, তাদের সকলের জন্য তিনি তা-ই করলেন। অতএব মাবুদ সোলায়মানের প্রতি ক্রুদ্ধ হলেন; কেননা তাঁর অন্তঃকরণ ইসরাইলের আল্লাহ্ মাবুদের দিকে না থেকে বিপথগামী হয়েছিল, যিনি দু’বার তাকে দর্শন দিয়েছিলেন, এই বিষয়ে মাবুদ তাকে হুকুম দিয়েছিলেন, যেন তিনি অন্য দেবতাদের অনুগামী না হন; কিন্তু মাবুদ যা হুকুম দিয়েছিলেন, তা তিনি পালন করলেন না। অতএব মাবুদ সোলায়মানকে বললেন, তোমার তো এই ব্যবহার, তুমি আমার নিয়ম ও আমার হুকুম করা সমস্ত বিধি পালন কর নি; এই কারণ আমি অবশ্য তোমা থেকে রাজ্য চিরে নিয়ে তোমার গোলামকে দেব। তবুও তোমার পিতা দাউদের জন্য তোমার বর্তমান কালে তা করবো না, কিন্তু তোমার পুত্রের হাত থেকে তা চিরে নেব। যা হোক, সারা রাজ্য চিরে নেব না; কিন্তু আমার গোলাম দাউদের জন্য ও আমার মনোনীত জেরুশালেমের জন্য তোমার পুত্রকে এক বংশ দেব।’’

পাঠক, বাইবেলীয় ঈশ্বর ও তাঁর পুত্র ইবনুল্লাহ শলোমনের বিষয় চিন্তা করুন:

(ক) শলোমন কয়েকটা মহাপাপ করেছেন: (১) নিজে মূর্তিপূজা করেছেন, (২) স্ত্রীদেরকে মূর্তিপূজায় সহযোগিতা করেছেন এবং (৩) প্রতিমাপূজার জন্য জেরুজালেমের সম্মুখস্থ পর্বতে উচ্চস্থলী বা পূজার উঁচু স্থান নির্মাণ করলেন।

এ সকল প্রতিমা-মন্দির ও কোরবানগাহ পরবর্তী কয়েকশ বছর তথায় স্থায়ী ছিল। অবশেষে শলোমনের মৃত্যুর প্রায় সাড়ে তিন শত বছর পরে এহুদা রাজ্যের রাজা যোশিয় বিন আমোন এ সকল মন্দির ও প্রতিমা বিনষ্ট করেন। (২ রাজাবলি ২৩/১-২০)

(খ) উপরের প্রতিটা অপরাধেরই শাস্তি আগুনে পুড়িয়ে বা পাথর মেরে হত্যা করা। মূর্তিপূজা, প্রতিমা স্থাপন বা প্রতিমার জন্য বেদি নির্মাণের বাইবেল নির্ধারিত শাস্তি প্রস্তারাঘাতে মৃত্যুদণ্ড। এমনকি কোনো মহা-মুজিযা প্রদর্শনকারী নবী এ সকল কর্ম করলে তাকেও এ শাস্তি প্রদান করতে হবে। এ অপরাধে গ্রাম বা জনপদ পর্যন্ত পুড়িয়ে দিতে হবে। গ্রামের সকল সম্পদ ও দ্রব্যাদি পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে তাওবারও কোনো সুযোগ নেই। (যাত্রাপুস্তক ২২/২০, ৩২/২৮, দ্বিতীয় বিবরণ ১৩/১-১৬, ১৭/২-৭, ১ রাজাবলি ১৮/৪০) এ সকল বিধান অনুসারে ঈশ্বরের পুত্র ও নবীর দায়িত্ব ছিল তাঁর স্ত্রীদেরকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা। অথচ তিনি তাঁর ঈশ্বর ও তাঁর পিতার আদেশের বিপরীতে স্ত্রীদেরকে সহায়তা করলেন।

(গ) বাইবেলের বিবরণ থেকে সুস্পষ্ট যে, শলোমন মহাপাপ ত্যাগ করেননি। তিনি যদি তাওবা করতেন তবে অবশ্যই তিনি এ সকল মন্দির ও বেদি ভেঙে ফেলতেন, যে সকল দেবতা ও প্রতিমা স্থাপন করেছিলেন সেগুলো বিনষ্ট করতেন এবং এ সকল স্ত্রীকে তিনি প্রস্তরাঘাতে বধ করতেন। তিনি কিছুই করেননি।

(ঘ) সবচেয়ে মজার বিষয় ঈশ্বরের প্রতিক্রিয়া। বাইবেলের সর্বত্র আমরা দেখি যে, সামান্য অপরাধে ঈশ্বর সঙ্গে সঙ্গে আগুনে পুড়িয়ে, বিষধর সাপ দিয়ে, মহামারি দিয়ে, মাটির নিচে পুতে বা কোনো উপকরণ ছাড়াই তাৎক্ষণিক হত্যা করে অপরাধীকে শাস্তি দেন। কিন্তু শলোমনকে ঈশ্বর কোনো শাস্তি দিলেন না। সাধারণ মানুষ এরূপ অপরাধ করলে প্রস্তরাঘাতে হত্যা! আর ঈশ্বরের দু’বার দর্শন লাভ করা নবী ও পুত্র এরূপ ভয়ঙ্কর অপরাধ করলেন, ঈশ্বর শুধু বললেন, ‘‘তার রাজ্য দুভাগ হবে’’!

(ঙ) আরো মজার বিষয়, এ ভয়ঙ্কর অপরাধগুলোর এরূপ সামান্য শাস্তিও শলোমন নিজে ভোগ করবেন না; বরং তাঁর পুত্র এ শাস্তি ভোগ করবে! ঈশ্বর নিজেই বলেছেন: ‘‘পিতার অপরাধ পুত্র বহন করিবে না... দুষ্টের দুষ্টতা তাহার উপর বর্তিবে।’’ (যিহিষ্কেল ১৮/২০) কিন্তু ঈশ্বর নিজেই নিজের এ নীতি ভঙ্গ করে শলোমনের দুষ্টতার ভার তাঁর পুত্রের উপর অর্পণ করলেন!

(চ) ইহুদি-খ্রিষ্টান বিশ্বাস অনুসারে পবিত্র বাইবেলের কয়েকটা পুস্তকের রচয়িতা শলোমন। যে ভাববাদী নিজেই নিজের ধর্ম ত্যাগ করে মূর্তিপূজায় লিপ্ত হলেন, তাঁর লেখা পুস্তক কিভাবে পবিত্র বাইবেলের মধ্যে ঠাঁয় পেল তা চিন্তার বিষয়।

(ছ) ঈশ্বর তাঁর ধর্ম পরিত্যাগকারী ও মূর্তিপূজক তাঁর এ পুত্র শলোমনকেই তাঁর পরবর্তী পুত্র যীশুর পূর্বপুরুষ হিসেবে বাছাই করলেন। অন্য কারো বংশে যীশুকে না পাঠিয়ে শলোমনের বংশেই পাঠালেন।