৬. ১. ১৪. মিসরবাসীদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব

মিসরের শাসক ফেরাউনের নিকট থেকে মূসা (আ.)-এর নেতৃত্বে বনি-ইসরাইলদের মুক্ত হয়ে আসার বিবরণ বাইবেল ও কুরআন উভয় পুস্তকের মধ্যেই বিদ্যমান। তবে বর্ণনার বিষয়বস্ত্ত ও পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কুরআনের বর্ণনায় মূসা (আ.) ফেরাউনকে মহান আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপনের দাওয়াত দেন এবং বনি-ইসরাঈলকে মিসর থেকে বের করে নেওয়ার অনুমতি দাবি করেন। কিন্তু ফেরাউন ও তার অনুসারীরা সবকিছু জেনে বুঝেও জাগতিক স্বার্থে মূসার দাওয়াত অস্বীকার করেন। শেষ পর্যন্ত ফেরাউন ও তার অনুগামীরা শাস্তি পায়।

পক্ষান্তরে বাইবেলের বর্ণনায় মূসা (আ.) ফেরাউনকে বিশ্বাসের কোনো দাওয়াত দেননি। শুধু নিজের জাতিকে মুক্তি দেওয়ার দাবি করেন। ফেরাউন তাদেরকে ছেড়ে দিতে চান। কিন্তু ঈশ্বর পরিকল্পিতভাবে ফিরাউনের মন কঠিন করে দেন। যেন ফেরাউন ও মিসরবাসীকে শাস্তি দিয়ে তাঁর গৌরব ও কুদরত দেখাতে পারেন। এছাড়া কুরআনের বর্ণনায় ফেরাউন ও তার সৈন্যরা শাস্তি পায়। পক্ষান্তরে বাইবেলের বর্ণনায় ঈশ্বর ফেরাউনের  অপরাধে মিসরের অগণিত নিরপরাধ মানুষ ও জীব-জানোয়ারকেও শাস্তি দেন। ঈশ্বর ফেরাউনকে অবাধ্য হতে বাধ্য করেন।

ঈশ্বর বলেন: ‘‘কিন্তু আমি ফেরাউনের মন কঠিন করব যাতে আমি মিসর দেশে অনেক অলেŠকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখাতে পারি। সে কিছুতেই তোমাদের কথা শুনবে না। সেজন্য আমি মিসর দেশের উপরে আমার হাত তুলব এবং ভীষণ শাস্তি দিয়ে আমি আমার সৈন্যদের, অর্থাৎ আমার আপন প্রজা (ইংরেজি: my people, কি. মো.: বান্দা) বনি-ইসরাইলদের সেই দেশ থেকে বের করে আনব। আমি যখন আমার কুদরত ব্যবহার করে মিসর দেশ থেকে বনি-ইসরাইলদের বের করে আনব তখন মিসরীয়রা বুঝতে পারবে যে, আমিই মাবুদ।’’ (যাত্রাপুস্তক/হিজরত ৭/৩-৫, মো.-০৬)

তাহলে সুপরিকল্পিতভাবে ফিরাউনের মন কঠিন করে মহা হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞের উদ্দেশ্য একটাই, ঈশ্বরের যে অনেক ক্ষমতা আছে তা মিসরীয়দের জানান। ঈশ্বর নিজের সেনাবাহিনী ও নিজের বিশেষ প্রজাদের পক্ষে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য নিম্নের কর্মগুলো করলেন:

  1. মিসরের সকল নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় ও ঘরের পাত্রের সকল পানি  রক্ত বানালেন এবং সকল মাছ মেরে ফেললেন। (যাত্রাপুস্তক ৭/১৪-২৫)
  2. এর সাত দিন পর ব্যাঙ দিয়ে মিসর দেশ ভরে দিলেন। পরে ডাঙার সকল ব্যাঙ মেরে ফেললেন। (যাত্রাপুস্তক ৮/১-১৫)
  3. পুরো দেশ মশা দিয়ে ভরে দিলেন। (যাত্রাপুস্তক ৮/১৬-১৯)
  4. মিসর দেশটাকে পোকা দিয়ে ভরে দিলেন এবং পোকার উৎপাতে মিসর দেশের সর্বনাশ হতে লাগল। (যাত্রাপুস্তক ৮/২০-২৪)
  5. এরপর ঈশ্বর মিসরীয়দের সব পশু মেরে ফেললেন। (যাত্রাপুস্তক ৯/৬)
  6. মিসরের সকল পশু মেরে ফেলার পরেই ঈশ্বর মিসরের সকল পশু এবং সকল মানুষের গায়ে ফোড়া ও ঘা দিয়ে ভরে দিলেন। (যাত্রাপুস্তক ৯/৮-১২)
  7. মাঠে অবস্থানরত সকল মানুষ ও পশুকে ভয়ঙ্কর শিলাবৃষ্টি দিয়ে মেরে ফেললেন। তবে যে সকল পশু ও মানুষ ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল তারা বেঁচে গেল। যদিও কয়েকদিন আগেই সকল পশু মরে গিয়েছিল। (যাত্রাপুস্তক ৯/১৩-২৬)।
  8. পুরো মিসর দেশটা পঙ্গপাল দিয়ে ভরে দিলেন। এরপর লক্ষকোটি পঙ্গপালকে লোহিত সাগরে ফেলে মেরে ফেললেন (যাত্রাপুস্তক ১০/১৩-২০)
  9. তিনদিন গাঢ় অন্ধকারে দেশটা ডুবিয়ে রাখলেন। (যাত্রাপুস্তক ১০/২১)
  10. এরপর মিসরের সকল মানুষের সকল প্রথম ছেলেকে হত্যা করেন। উপরন্তু মিসরীয়দের সকল প্রাণির সকল প্রথম পুরুষ বাচ্চা হত্যা করেন; যদিও মাত্র কয়েকদিন আগেই মিসরীয়দের সব পশু মরে গিয়েছিল!  (যাত্রাপুস্তক ১১/১-৫, ২৯; ১২/১২, ১২/২৯-৩০)
  11. সর্বশেষ ফেরাউন বনি-ইসরাইলকে মিসর থেকে চলে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করে (যাত্রাপুস্তক ১২/৩০)।  তবে ঈশ্বর ফেরাউন ও তার সকল সৈন্য হত্যা করে গৌরবান্বিত হওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের মন আবারো কঠিন করে দিলেন: ‘‘আর আমি ফেরাউনের অন্তর কঠিন করবো, আর সে তোমাদের পিছনে ধাবমান হবে এবং আমি ফেরাউন ও তার সমস্ত সৈন্য দ্বারা মহিমান্বিত হব; আর মিসরীয়েরা তখন জানতে পারবে যে, আমিই মাবুদ।’’ (হিজরত ১৪/৪, মো.-১৩) এরপর যতবারই ফেরাউন ও তার সৈন্যরা নরম হয়েছে ততবারই ঈশ্বর তাদের হৃদয় শক্ত করে বনি-ইসরাইলের পিছনে তাড়া করতে বাধ্য করেন এবং সর্বশেষ সকলকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেন। (হিজরত/ যাত্রা ১৪/৮-৩১)

উপরের সকল হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনার মধ্যে বারবার বাইবেল নিশ্চিত করেছে যে, ঈশ্বর সুপরিকল্পিতভাবেই ফেরাউন ও তার কর্মচারীদের মন কঠিন করেছিলেন। ঈশ্বরের পূর্ব-সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা অনুসারেই ফেরাউন মোশির কথা শুনতে অক্ষম হয়েছিল (যাত্রাপুস্তক/ হিজরত: ৭/ ১৩, ২২-২৩; ৮/১৫, ১৯, ৯/১২, ৩৫, ১০/১-২, ২০, ২৭)। আর সকল কিছুর উদ্দেশ্য ঈশ্বরের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার কথা সবাইকে জানানো এবং কিভাবে ঈশ্বর মিসরীয়দের বোকা বানিয়েছিলেন তা বনি-ইসরাইলের নাতি-পুতিদের কাছে গল্প করা: ‘‘এর পর মাবুদ মূসাকে বললেন, ‘তুমি ফেরাউনের কাছে যাও। আমি ফেরাউন ও তার কর্মচারীদের মন শক্ত করেছি যাতে তারা আমার এ সব অলৌকিক চিহ্ন দেখতে পায় আর যাতে পরে তুমি তোমার ছেলেদের ও নাতিদের কাছে বলতে পার মিসরীয়দের আমি কিভাবে বোকা বানিয়েছি এবং আমার কুদরতির চিহ্ন দেখিয়েছি। (হিজরত/ যাত্রাপুস্তক ১০/১-২, মো.-০৬)

বাইবেল আরো নিশ্চিত করেছে যে, বনি-ইসরাইলের পক্ষে মিসরীদের বিপক্ষে মহান ঈশ্বর তাঁর ক্ষমতা ইচ্ছামত ব্যবহার করেছেন। একদিকে মিসরীয়দের মধ্যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ বাস্তবায়নের জন্য ফেরাউন ও মিসরবাসীদের মন কঠিন করেছেন। অপরদিকে বনি-ইসরাইলদের জন্য মিসরীয়দের থেকে সোনা-রূপা লুট করার সুবিধার্থে মিসরীয়দের মধ্যে তাদের প্রতি দয়ার ভাব জাগিয়ে দেন, যেন বনি-ইসরাইলরা মিসরীয়দের কাছে যা চায় তাই দিয়ে দেয় এবং এগুলো নিয়ে তারা পালিয়ে যেতে পারে: ‘‘তুমি বনি-ইসরাইলদের বলবে, স্ত্রী-পুরুষ সকলেই যেন তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সোনা ও রূপার জিনিস চেয়ে নেয়।’ এদিকে মাবুদ বনি-ইসরাইলদের প্রতি মিসরীয়দের মনে একটা দয়ার ভাব জাগিয়ে দিলেন।’’ (হিজরত ১১/৩, মো.-০৬)

সাধু পল লেখেছেন: ‘‘পাক-কিতাবে আল্লাহ ফেরাউনকে এই কথা বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে বাদশাহ করেছি যেন তোমার প্রতি আমার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আমার কুদরত দেখাতে পারি এবং সমস্ত দুনিয়াতে যেন আমার নাম প্রচারিত হয়’। তাহলে দেখা যায় আল্লাহ নিজের ইচ্ছামত কাউকে দয়া করেন এবং কারও দিল কঠিন করেন।’’ (রোমীয় ৯/১৭-১৮, মো.-০৬)