পবিত্র বাইবেল পরিচিতি ও পর্যালোচনা পঞ্চম অধ্যায় - বিকৃতি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৫. ৩. ১৫. ত্রিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন নিয়মের বিকৃতি

আমরা দেখেছি যে, খ্রিষ্টধর্মের মূল ভিত্তি যীশুর ঈশ্বরত্ব এবং ঈশ্বরের ত্রিত্ব। ত্রিত্ববাদ (Trinity)-এর ব্যাখ্যায় বিবিসির খ্রিষ্টধর্ম বিষয়ক ওয়েব সাইটে বলা হচ্ছে:

 “There is exactly one God. There are three really distinct Persons - Father, Son, and Holy Spirit. Each of the Persons is God. The Father is God. The Son is God. The Holy Spirit is God. The Father is not the Son. The Son is not the Holy Spirit. The Father is not the Holy Spirit.” ‘‘প্রকৃতই একজন ঈশ্বর বিদ্যমান। সম্পূর্ণ পৃথক তিনজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বিদ্যমান: পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা। তিনজনের প্রত্যেক ব্যক্তিই ঈশ্বর: পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর, পবিত্র আত্মা ঈশ্বর। পিতা পুত্র নন, পুত্র পবিত্র আত্মা নন, পিতা পবিত্র আত্মা নন।’’[1]

ত্রিত্ববাদ বিষয়ে বিবিসির খ্রিষ্টধর্ম বিষয়ক ওয়েবসাইট আরো বলছে:

“The Trinity is a controversial doctrine; many Christians admit they don't understand it, while many more Christians don't understand it but think they do. .... The doctrine of the Trinity is one of the most difficult ideas in Christianity, but it's fundamental to Christians ... This idea that three persons add up to one individual seems like nonsense. And logically, it is.”

‘‘ত্রিত্ববাদ একটা বিতর্কিত মতবাদ; অনেক খ্রিষ্টানই স্বীকার করেন যে, তারা তা বুঝেন না। অন্যান্য অধিকাংশ খ্রিষ্টান তা বুঝেন বলে ধারণা করেন, তবে প্রকৃতপক্ষে তারা তা বুঝেন না। ... ত্রিত্ববাদী বিশ্বাস খ্রিষ্টধর্মের সবচেয়ে কঠিন বিশ্বাসগুলোর অন্যতম; যদিও খ্রিষ্টানদের জন্য এটা মূল বিষয়। তিনজন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে একক ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছেন-এরূপ ধারণা ননসেন্স বা নির্বোধ প্রলাপ বলেই প্রতীয়মান হয়। আর যুক্তির বিচারে তা নির্বোধ প্রলাপই বটে।’’[2]

এ বিশ্বাসটা খ্রিষ্টধর্মের মূল হলেও বাইবেলের কোথাও এ অর্থে একটা কথাও নেই। ইঞ্জিলগুলো তো দূরের কথা নতুন নিয়মের অন্য কোনো স্থানেই ত্রিত্ববাদের এ বিশ্বাসটা নেই। তবে এ বিশ্বাসের নিকটর্বর্তী একটা বক্তব্য বিগত প্রায় দু’ হাজার বছর যোহনের প্রথম পত্রের মধ্যে ছিল। ১ যোহন ৫/৬-৮ কিং জেমস ভার্শনে নিম্নরূপ:

“6  This is he that came by water and blood, even Jesus Christ; not by water only, but by water and blood. And it is the Spirit that beareth witness, because the Spirit is truth. 7  For there are three that bear record in heaven, the Father, the Word, and the Holy Ghost: and these three are one. 8  And there are three that bear witness in earth, the Spirit, and the water, and the blood: and these three agree in one.”

 ‘‘(৬) তিনি সেই যিনি পানি ও রক্ত দ্বারা এসেছিলেন; যীশু খ্রিষ্ট; কেবল পানি দ্বারা নয়, কিন্তু পানি ও রক্ত দ্বারা। আর আত্মা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, কারণ আত্মা সত্য। (৭) কারণ স্বর্গে তিন জন রয়েছেন যাঁরা সাক্ষ্য সংরক্ষণ করেন: পিতা, বাক্য ও পবিত্র আত্মা (পাক-রূহ); এবং তাঁরা তিন এক। (৮) এবং পৃথিবীতে তিন রয়েছেন যাঁরা সাক্ষ্য প্রদান করেন: আত্মা, পানি ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একে একমত।’’

‘‘স্বর্গে তিন এবং তিন এক’’ মর্মে পুরো বাইবেলে এই একটামাত্রই বক্তব্য শতভাগ জালিয়াতি বলে নিশ্চিত করেছেন বাইবেল বিশেষজ্ঞরা। কারণ প্রাচীন কোনো পাণ্ডুলিপিতে এ কথাগুলো নেই। পরবর্তী যুগের কিছু মানুষ ত্রিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য এখানে কথাগুলো সংযোজন করেছিলেন। আমরা দেখব যে, মাত্র শতাধিক বছর আগেও এ কথাগুলো জাল বললে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্শন (RSV) ও আধুনিক ভার্শনগুলো থেকে এ সংযোজিত কথাগুলো মুছে দেওয়া হয়েছে। RSV এর ভাষ্যে ১ যোহন ৫/৬-৮ নিম্নরূপ:

“6  This is who came by water and blood, Jesus Christ; not with the water only, but with the water and the blood. 7 And the Spirit is the witness, because the Spirit is the truth. 8  There are witnesses, the Spirit, the water, and the blood: and these three agree.” ‘‘(৬) তিনি সেই, যিনি জল ও রক্ত দিয়া আসিয়াছিলেন, যীশু খ্রিষ্ট; কেবল জলে নয়, কিন্তু জলে ও রক্তে। (৭) আর আত্মাই সাক্ষ্য দিতেছেন, কারণ আত্মা সেই সত্য। (৮) বস্ত্তত তিনে সাক্ষ্য দিতেছেন আত্মা, জল ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই।’’ (কেরির অনুবাদ)

প্রচলিত বাংলা সংস্করণগুলো রিভাইজড ভার্শন অনুসরণ করেছে।

অষ্টাদশ শতকের সুপ্রসিদ্ধ বৃটিশ বৈজ্ঞানিক, গণিতবিদ ও পদার্থ বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন (Isaac Newton: 1643-1727)-এর নাম সকলেই জানেন। তিনি মধ্যাকর্ষণ শক্তি, পদার্থ বিজ্ঞান, আলোক বিজ্ঞান, গণিত ইতাদি বিষয়ে গবেষণার পাশাপাশি ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে গভীর অধ্যয়ন করতেন। বৃটিশ রাজ্যের বস্নাসফেমি আইনের ভয়ে তিনি তার ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণাগুলো শুধু লেখে রাখতেন, কিন্তু প্রকাশ করতেন না। উইকিপিডিয়ার ভাষায় তিনি ছিলেন ত্রিত্ববাদ বিরোধী একত্ববাদী (Antitrinitarian monotheist)। তার মতে ‘ত্রিত্ববাদই ভয়ঙ্করতম কুফরী’ (the great apostasy was trinitarianism)’’ এবং ‘ঈশ্বর হিসেবে খ্রিষ্টের আরধানা মূর্তিপূজা এবং মূল পাপ’।’’[3]

উপরে আলোচিত সর্বশেষ দু’টা বিকৃতি নিয়ে প্রথম মৌলিক গবেষণা করেন স্যার আইজাক নিউটন। তিনি ‘ধর্মগ্রন্থের দুটো উল্লেখযোগ্য বিকৃতির ঐতিহাসিক বিবরণ’ (An Historical Account of Two Notable Corruptions of Scripture) নামে একটা প্রবন্ধে এ বিষয়টা লেখেন। উইকিপিডিয়ায় এ শিরোনামের প্রবন্ধে তার গবেষণার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তিনি ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ নভেম্বর তার এ গবেষণাপত্রটা জন লকের নিকট প্রেরণ করেন এবং তার মৃত্যুর ২৭ বছর পরে ১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তা প্রকাশিত হয়। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে ১৬৯৭ খ্রিষ্টাব্দে জারিকৃত বস্নাসফেমি আইনে (The Blasphemy Act 1697) ত্রিত্ববাদ বা ত্রিত্বের তিনজনের কারো ঈশ্বরত্বের বিরুদ্ধে কথা বলা ছিল কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাঁর বন্ধু উইলিয়াম হুইসটন (William Whiston) ত্রিত্ববাদের সমালোচনায় কিছু কথা বলে কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকুরি হারান। ১৬৯৪ খ্রিষ্টাব্দে থমাস আইকেনহার্ড নামক ১৮ বছর বয়সের এক যুবককে ত্রিত্ববাদ অস্বীকার করার কারণে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।[4]

[1] http: //www.bbc.co.uk/religion/religions/christianity/beliefs/trinity_1.shtml
[2] www.bbc.co.uk/religion/religions/christianity/beliefs/trinity_1.shtml
[3] উইকিপিডিয়া, Isaac Newton: Religious views; Isaac Newton's religious views
[4] উইকিপিডিয়া: An Historical Account of Two Notable Corruptions of Scripture