পবিত্র বাইবেল পরিচিতি ও পর্যালোচনা তৃতীয় অধ্যায় - বৈপরীত্য ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
৩. ৯. ৭. পিতা ও পুত্র এক, পৃথক অথবা বৃহত্তর ও ক্ষুদ্রতর

যীশু বলেন: ‘‘আমি ও পিতা, আমরা এক (I and my Father are one)।’’ (যোহন ১০/৩০)। তিনি আরো বলেন: ‘‘যে আমাকে দেখেছে সে পিতাকে দেখেছে।’’ (যোহন ১৪/৯, মো.-১৩) এ থেকে বুঝা যায় যে যীশু ও ঈশ্বর এক ও অভিন্ন।

কিন্তু যীশু মৃত্যুর পূর্বে বলেন: ‘‘আল্লাহ আমার, আল্লাহ আমার, তুমি কেন আমায় পরিত্যাগ করেছ?’’ (মথি ২৭/৪৬, মো.-১৩) তাঁর এ কথা নিশ্চিত করে যে, তাঁর ঈশ্বর বা পিতা এবং তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন, যে কারণে একে অন্যকে পরিত্যাগ করতে পারেন।

যীশু অন্যত্র বলেন: ‘‘আর যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, তিনি আমার সঙ্গে সঙ্গে আছেন; তিনি আমাকে একা ছেড়ে দেননি, কেননা আমি সব সময় তাঁর সন্তোষজনক কাজ করি।’’  (ইউহোন্না/ যোহন ৮/২৯, মো.-১৩)

এ বক্তব্যও প্রমাণ করে যে, পিতা ও পুত্র এক নন। কারণ একই ব্যক্তি নিজে নিজেকে ‘পাঠাতে’ পারেন না, নিজেই নিজের সাথে থাকতে পারেন না, নিজে নিজেকে পরিত্যাগ করতে পারেন না এবং নিজে নিজের সন্তুষ্টির কর্ম করে বলতে পারেন না যে, যেহেতু আমি তার সন্তুষ্টির কর্ম করি সেজন্য তিনি আমাকে পরিত্যাগ করেন না।

এ ছাড়া এখানে যীশু বলছেন যে, ঈশ্বর তাঁকে পরিত্যাগ করেন না; কারণ তিনি সর্বদা ঈশ্বরের সন্তুষ্টির কর্ম করেন। তাহলে কি যীশু শেষ মুহূর্তে ঈশ্বরের অসন্তুষ্টির কোনো কর্ম করেছিলেন যে, ঈশ্বর তাঁকে পরিত্যাগ করেছিলেন?

 যোহন/ ইউহোন্না ৫/১৮, মো.-১৩: ‘‘এই কথার জন্য ইহুদীরা তাঁকে হত্যা করতে আরও চেষ্টা করতে লাগল; কেননা তিনি কেবল বিশ্রামবার লঙ্ঘন করতেন তা নয়, কিন্তু আবার আল্লাহকে নিজের পিতা বলে নিজেকে আল্লাহর সমান করতেন।’’

যোহন বড় মজার কথা লেখেছেন! আমরা দেখেছি, ইহুদিরা সকলেই আল্লাহকে পিতা বলতেন। বাইবেলে সকল মানুষ এবং বিশেষ বিশেষ অনেক মানুষকে বারবার ‘ঈশ্বরের পুত্র’, ‘প্রথম পুত্র’ ‘জাত পুত্র’ ইত্যাদি বলা হয়েছে। তাহলে যীশু নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বললে ইহুদিরা তাঁকে বধ করবে কেন? যোহনের লেখক নিশ্চিতভাবেই একজন রোমান ছিলেন যিনি ইহুদি পরিভাষায় ‘ঈশ্বরের পুত্র’ ব্যবহার জানতেন না। রোমান পরিভাষায় দেবতা অর্থে ঈশ্বরের পুত্র ব্যবহারই তার জানা ছিল। এজন্য মনের কল্পনায় লেখেছেন যে, যীশু নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বলাতে ইহুদিরা ক্রুদ্ধ হয়েছিল।

এছাড়া যোহন লেখলেন যে, যীশু নিজেকে ঈশ্বরের সমতুল্য করছিলেন। এ কথা নিশ্চিত করে যে, যীশু নিজেকে ঈশ্বর দাবি করেননি এবং ঈশ্বর ছিলেন না। কারণ কেউ নিজেকে নিজের সমতুল্য বানাতে পারে না।

বাইবেল গবেষক ও সমালোচক গ্যারি ডেভানি লেখেছেন: “John 5:18... He also called God His Own Father, making Himself equal to God.  If Jesus is stated to be "equal to" God, how can Jesus actually be God? How can any father and son be, in reality, the same person?” ‘‘যোহন ৫/১৮... কারণ তিনি ঈশ্বরকে নিজের পিতা বলছেন, এভাবে নিজেকে ঈশ্বরের সমতুল্য বানাচ্ছেন। এখানে বলা হল যে, যীশু ঈশ্বরের সমতুল্য। যদি তা-ই হয় তবে তিনি প্রকৃতপক্ষে কিভাবে ঈশ্বর হবেন? বাস্তবে কিভাবে পিতা ও পুত্র একই সত্তা হতে পারে?’’[1]

যীশু বলেন: ‘‘আমি পিতার কাছে যাচ্ছি; কারণ পিতা আমার চেয়ে মহান (Father is greater than I)’’ (ইউহোন্না ১৪/২৮, মো.-১৩)। এ থেকে জানা যায় যে, পিতা ও পুত্র এক নন এবং সমানও নন; একজন আরেকজন অপেক্ষা মহান বা ক্ষুদ্র।

অন্যত্র যীশু বলেন: ‘‘আমার উপদেশ আমার নয়, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, তাঁর। যদি কেউ তাঁর ইচ্ছা পালন করতে ইচ্ছা করে, তবে সে এই উপদেশের বিষয়ে জানতে পারবে যে, এই শিক্ষা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে, নাকি আমি নিজের থেকে বলি।’’ (যোহন/ ইউহোন্না ৭/১৬-১৭, মো.-১৩)

এ কথা থেকে পাঠক কী বুঝছেন? যীশু কি বললেন যে, তিনি ও ঈশ্বর এক? নাকি তিনি বললেন যে, তিনি ঈশ্বর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং তাঁর নিজের শিক্ষা ও ঈশ্বরের শিক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি যে শিক্ষা দেন তা তাঁর নিজের নয়; বরং ঈশ্বরের শিক্ষা। এখানে যীশু মোশি ও অন্যান্য বাইবেলীয় নবীদের মত অবিকল বলছেন যে, তাঁর শিক্ষাগুলো তাঁর নিজের শিক্ষা নয়; বরং তিনি আল্লাহর বাণী প্রচার করছেন মাত্র।

পিতর লেখেছেন (১ পিতর ৩/২২, মো.-০৬): ‘‘মসীহ বেহেশতে গেছেন এবং এখন আল্লাহর ডান দিকে আছেন।’’ এ কথাও নিশ্চিত করে যে, যীশু ঈশ্বর নন বা তিনি ও ঈশ্বর এক নন। কারণ একই সত্তা নিজেই নিজের ডান দিকে বসতে পারে না।

স্কট বিডস্ট্রাপ লেখেছেন, খ্রিষ্টান প্রচারকরা এখানে বলেন, ত্রিত্ববাদী বিশ্বাসে যীশু এবং পিতা (ঈশ্বর) এক ও অভিন্ন, তবে তারপরও তাঁরা পৃথক ব্যক্তি। ঈশ্বর হিসেবে যীশু এবং পিতা সমান; তবে যীশু যখন পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে আসলেন তখন স্বেচ্ছায় নিজেকে পিতার অধীনস্থ করেন। যেমন, বলা যায় যে, একজন রাজা ও একজন প্রজা মানুষ হিসেবে উভয়েই সমান, এরপরও একজন অন্যজনের চেয়ে মর্যাদায় অধিক।

পাঠক, লক্ষ্য করছেন যে, এটা কোনো ব্যাখ্যা হল না। রাজা এবং প্রজাকে কেউ বলেন না যে, তারা উভয়ে মিলে একজন মানুষ বা তারা এক ও অভিন্ন। দুজন পৃথক ব্যক্তি সমান হতে পারে, অসমানও হতে পারে, তবে কখনোই এক হতে পারে না। আর যখন দুজনই এক হয়, তখন আর সমান, অসমান বা ছোটবড় হওয়ার কোনো অর্থ হয় না। যেমন একই ব্যক্তি দুটো নামে পরিচিত হতে পারেন। দুজন তাকে দু’ নামে চিনতে পারে। সে ব্যক্তি বিষয়ে বলা যায় যে, অমুক ও অমুক একই ব্যক্তি বা একই ব্যক্তির দুটো নাম। কিন্তু সেক্ষেত্রে বলা যায় না যে, তারা কেউ কারো চেয়ে বড় বা ছোট। এজন্য এ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে স্কট বিডস্ট্রাপ লেখেছেন:

“If the fundamentalist’s argument is true, then John 10:30 makes no sense at all. How can you be one and still be separate? They are either one or they are not. The states are mutually exclusive.”

‘‘যদি মৌলবাদীদের যুক্তি সঠিক হয়, তবে যোহন ১০/৩০ (আমি ও পিতা, আমরা এক) কথাটা একেবারেই অর্থহীন প্রলাপে পরিণত হয়। আপনি কিভাবে এক ও অভিন্ন হবেন এবং একই সাথে পৃথক ও ভিন্ন হবেন? যীশু ও ঈশ্বর হয় উভয়ে অভিন্ন অথবা ভিন্ন। দুটো অবস্থা একই সাথে সমন্বিত হতে পারে না।’’[2]

[1] Gary DeVaney, JESUS, http://www.thegodmurders.com/id134.html
[2] http://www.bidstrup.com/bible2.htm