২. ১২. ১৪. ইঞ্জিলটার ভাষ্যমতে তা যোহনের মৃত্যুর পরে লেখা

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখছি যে, এ ইঞ্জিলটাও একটা বেনামি পুস্তক যা দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের কোনো গ্রিক লেখকের রচিত। এ পুস্তকটার শেষ অধ্যায়ের যে বক্তব্য লেখকের বিষয়ে তথ্য দিচ্ছে সে অধ্যায়টা পুরোটাই জাল বা পরবর্তী সংযোজন বলে উল্লেখ করছেন অধিকাংশ গবেষক। এরপরও আমরা এ সংযোজিত কথাগুলো অধ্যয়ন করে লেখকের পরিচয় জানার চেষ্টা করব।

ইউহোন্না ২১/২০-২৫  (মো.-১৩) নিম্নরূপ: ‘‘পিতর মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, সেই সাহাবী পিছনে পিছনে আসছেন, যাঁকে ঈসা মহববত করতেন এবং যিনি রাতের বেলা ভোজের সময় তাঁর বক্ষস্থলের দিকে হেলে পড়ে বলেছিলেন, প্রভু, কে আপনাকে দুশমনদের হাতে তুলে দেবে? তাঁকে দেখে পিতর ঈসাকে বললেন, প্রভু, এর কি হবে? ঈসা তাঁকে বললেন, আমি যদি ইচ্ছা করি, এ আমার আগমন পর্যন্ত থাকে, তাতে তোমার কি? তুমি আমার পিছনে এসো। অতএব ভাইদের মধ্যে এই কথা রটে গেল যে, সেই সাহাবী মারা যাবেন না; কিন্তু ঈসাকে তাঁকে বলেননি যে, তিনি মারা যাবেন না; কেবল বলেছিলেন, আমি যদি ইচ্ছা করি, এ আমার আগমন পর্যন্ত থাকে, তাতে তোমার কি? সেই সাহাবীই এসব বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং এসব লেখেছেন; আর আমরা জানি তাঁর সাক্ষ্য সত্যি (This is the disciple which testifieth of these things, and wrote these things: and we know that his testimony is true) ঈসা আরও অনেক কাজ করেছিলেন; সেসব যদি এক এক করে লেখা হত, তবে আমার মনে হয় (I suppose), লেখতে লেখতে এত কিতাব হয়ে উঠতো যে, দুনিয়াতেও তা ধরতো না।

এ বক্তব্যের ভিত্তিতে এ পুস্তকটা শিষ্য যোহন কর্তৃক রচিত বলে মনে করা হয়। ইঞ্জিলগুলোর কোথাও উল্লেখ করা হয়নি যে, যীশুর প্রিয় এবং রাত্রিভোজের সময়ে যীশুর বক্ষস্থল বা স্তনের উপর হেলে পড়া (leaned on his breast) এ শিষ্য ছিলেন সিবদিয়ের পুত্র যোহন। তবুও আমরা ধরে নিচ্ছি যে, যোহনই ছিলেন এ শিষ্য। তারপরও কি উপরের কথাগুলো দ্বারা পুস্তকটা তার লেখা বলে প্রমাণিত হয়?

লেখক লেখেছেন: ‘‘সেই সাহাবীই এসব বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং এসব লেখেছেন; আর আমরা জানি তার সাক্ষ্য সত্যি।’’ আমরা বুঝতে পারি না, এ কথা থেকে কিভাবে বুঝা যায় যে, যোহন এ পুস্তকের লেখক! বরং এ কথাতে নিশ্চিত বুঝা যায় যে, এ পুস্তকের লেখক যোহন ছাড়া অন্য কেউ।

কারণ সুসমাচারের লেখক শিষ্য যোহনের বিষয়ে বলছেন: ‘সেই সাহাবীই এসব বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন’, ‘তাঁর সাক্ষ্য’ ইত্যাদি। এভাবে তিনি যোহনের জন্য নাম পুরুষের সর্বনাম ব্যবহার করছেন। পক্ষান্তরে লেখক তার নিজের জন্য উত্তম পুরুষের সর্বনাম ব্যবহার করে বলছেন: ‘আমরা জানি’। এ থেকে স্পষ্ট যে, এ সুসমাচারের লেখক যোহন ছাড়া অন্য কেউ। লেখক যোহনের ছাত্র হতে পারেন অথবা পরের প্রজন্মের কেউ হতে পারেন। তিনি বলছেন যে, তার এ গ্রন্থের তথ্য যোহনের সূত্রে মৌখিক ও লিখিত ভাবে পাওয়া। এ তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এ পুস্তকটা রচনা করেছেন; কারণ তিনি জানেন যে, যোহনের সূত্রে পাওয়া তথ্য সত্য।

আমরা দেখেছি এর পরের শ্লোকে লেখক বলেছেন: ‘‘ আমার মনে হয় হয় (I suppose)’’। এখানেও লেখক নিজেকে বুঝাতে উত্তম পুরুষ ব্যবহার করেছেন। এ শ্লোকের ‘আমার’ (I) ও উপরের শ্লোকের ‘আমরা’ (We) এর সাথে ‘সেই শিষ্য...’, ‘তাঁর’ ... ইত্যাদির তুলনা করলে আমরা বুঝতে পারি যে, সেই শিষ্য বলতে যোহনকে বুঝানো হয়েছে। যোহনের কথার ভিত্তিতে অন্য কেউ এ গসপেলটা রচনা করেছেন।

এখানে আরো সুস্পষ্ট যে, এ পুস্তকটা যোহনের মৃত্যুর পরে লেখা। প্রথম প্রজন্মের খ্রিষ্টানরা জানতেন যে, যীশুর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে যোহনের মৃত্যুর আগেই কিয়ামত হবে। কিন্তু যখন কিয়ামত ঘটার আগেই তার মৃত্যু হয়ে গেল তখন অনেকেই যীশুর ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা নিয়ে সন্দিহান হন। এখানে লেখক যোহনের মৃত্যুর কারণে খ্রিষ্টানদের মনে যে দ্বিধা-সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করার চেষ্টা করেছেন।

আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, প্রথম প্রজন্মের খ্রিষ্টানরা সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, তাদের জীবদ্দশাতেই কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং যীশু তাঁর প্রতাপে পৃথিবীতে পুনরাগমন করবেন। খ্রিষ্টানরা জীবিত অবস্থাতেই পরিবর্তিত হয়ে স্বর্গে গমন করবেন। যীশুর অনেক বক্তব্য এবং বিশেষ করে যোহন বিষয়ে যীশুর বক্তব্য থেকে তারা এরূপ নিশ্চিত বিশ্বাস পোষণ করতেন। ঘটনাচক্রে যোহন দীর্ঘজীবি হন। ফলে খ্রিষ্টানদের প্রত্যাশাও নিশ্চিত বিশ্বাসের রূপ গ্রহণ করে। যোহনের মৃত্যুতে এ বিশ্বাসে ফাটল ধরে। খ্রিষ্টান ধর্মগুরু ও প্রচারকরা নতুন পরিস্থিতিতে ধর্মবিশ্বাস নতুন করে সাজান। তারা বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, খ্রিষ্টের পুনরাগমনের পরে অনন্ত জীবন লাভের বিশ্বাস সঠিক নয়; বরং খৃস্টে বিশ্বাসের মাধ্যমে জীবদ্দশাতেই অনন্ত জীবন লাভ হয়। আর এ বিষয়টাই যোহনের ইঞ্জিল বলে কথিত এ পুস্তকে বলা হয়েছে।

খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা একমত যে, প্রথম তিন ইঞ্জিলের বর্ণনায় বিশ্বাসীরা অধীর আগ্রহে যীশুর পুনরাগমনের অপেক্ষা করছেন। পক্ষান্তরে যোহনের ইঞ্জিলে এ অপেক্ষার ধারণা দূর করে বিশ্বাসের মাধ্যমেই অনন্ত জীবন অর্জিত হয়েছে বলে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার বক্তব্য এরকম: “The numerous differences between the Synoptics and John can be summed up thus: in John eternal life is already present for the believer, while in the Synoptics there is a waiting for the Parousia for the fulfillment of eschatological expectations.”

‘‘সমমতীয় (প্রথম তিন) ইঞ্জিলের সাথে যোহনের অগণিত বৈপরীত্যকে সংক্ষেপে নিম্নের কয়েকটা বিষয়ে ভাগ করা যায়: প্রথম তিন সমমতীয় ইঞ্জিলের নির্দেশনা পরকাল বিষয়ক প্রতিশ্রুতি ও আশা আকাংঙক্ষা পূরণের জন্য যীশুর পুনরাগমনের অপেক্ষা করা। পক্ষান্তরে যোহনের ইঞ্জিলের বক্তব্য অনুসারে বিশ্বাসীদের জন্য অনন্ত জীবন ইতোমধ্যেই উপস্থিত।’’[1]

[1] "biblical literature." Encyclopædia Britannica. Encyclopædia Britannica 2009 Ultimate Reference Suite. Chicago: Encyclopædia Britannica, 2009.