২. ১১. ১. তোরাহ বা পঞ্চপুস্তক (Torah or Pentateuch)

বাইবেল গবেষকদের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বর্তমানে প্রচলিত তোরাহ, ‘তৌরাত’ বা ‘পঞ্চপুস্তক’ মূসা (আ.) প্রদত্ত ‘তৌরাত’ নয়। তাঁর তৌরাতের সাথে অনেক কিছু সংযোজন, বিয়োজন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে বর্তমান পঞ্চপুস্তক সৃষ্টি হয়েছে। বিগত কয়েক শত বছর যাবৎ পাশ্চাত্যের ইহুদি-খ্রিষ্টান গবেষকরা এ বিষয়ে একমত পোষণ করছেন। অনেকগুলো বিষয় তা প্রমাণ করে:

২. ১১. ১. ১ পাণ্ডুলিপির অবস্থা

পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে আমরা দেখেছি যে, মোশি (মূসা আ.) থেকে হিব্রু তৌরাতের প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপি পর্যন্ত সময়কাল প্রায় আড়াই হাজার বছর। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তৌরাতের কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। কুমরান উপত্যাকায় মৃত সাগরের পাণ্ডুলিপির মধ্যে খণ্ডতে যে অংশগুলো পাওয়া গিয়েছে এবং গ্রিক বাইবেল বা সেপ্টুআজিন্টের যে সকল প্রাচীন খণ্ডতে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ভিন্নতা ও বৈপরীত্য নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, পূর্ববর্তী প্রায় দু’ হাজার বছর ধরে পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধন ও বিয়োজনের ধারা অব্যাহত ছিল।

পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, তৌরাত ও বাইবেলীয় পুস্তকগুলো কখনোই মুখস্থ করা হয়নি বা মুখস্থ করা সম্ভবও ছিল না। এগুলো সাধারণ মানুষদের পাঠ্যও ছিল না। এগুলো একান্তই ধর্মগুরুদের নিয়ন্ত্রণাধীন পাণ্ডুলিপিতে লেখা হত। তা জনসম্মুখে পাঠ করা হত না। সাধারণ মানুষ এর কিছু বিধি-বিধান, প্রার্থনা ও প্রয়োজনীয় কথা জানতেন। সাধারণের মধ্যে প্রচলিত এ সামান্য বিষয়গুলো ছাড়া অন্য সকল বিষয় পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন ইত্যাদি খুবই সহজ ছিল। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীর আগে তৌরাত ও হিব্রু বাইবেলের অন্যান্য পুস্তক চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করেনি। এর পূর্ব পর্যন্ত পরিমার্জন ও পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত ছিল। পাঠক এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের গবেষকদের বক্তব্য দেখেছেন।

২. ১১. ১. ২ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাইবেলের বর্ণনার আলোকে ইহুদি-খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা একমত যে, মোশির দেওয়া তৌরাতের পাণ্ডুলিপিটা শতশত বছরের জন্য হারিয়ে যায়। এরপর হঠাৎই এক ব্যক্তি তা কুড়িয়ে পান। এরপর তা পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। প্রায় শত বছর পরে একজন তা নিজের পক্ষ থেকে লেখেন। এরপর আবারো বিদ্যমান পাণ্ডুলিপিগুলো ধ্বংস করা হয়। এরপর কিভাবে তা অবিকল বিশুদ্ধভাবে পুনরুদ্ধার করা হয় তা তারা বলতে পারেন না। এখানে আমরা বাইবেলের বর্ণনার ভিত্তিতে ইহুদি জাতির ঐতিহাসিক পর্যায়গুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করছি:

(ক) মোশি থেকে শলোমন (১৫০০-৯২২ খ্রি.পূ.): তৌরাত হারিয়ে গেল

মোশি, দাউদ ও শলোমনের সময়কাল নিয়ে ইহুদি-খ্রিষ্টান ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেক মতভেদ বিদ্যমান। সাধারণভাবে মোশি যীশুর প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বের মানুষ ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৯২, ১৫৭১ বা ১২৭১ অব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন বলে ধারণা করা হয়। আর দাউদ (আ.)-এর সময়কাল অধিকাংশের মতে খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ থেকে ৯৬০ অব্দের মধ্যে ছিল। তিনি খ্রি. পূ ৯৬১ বা ৯৭১ অব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পুত্র শলোমন (সুলায়মান আ.) খ্রি. পূ. ৯২২ বা ৯৩১ অব্দে মৃত্যুবরণ করেন।[1] এ দীর্ঘ অর্ধ সহস্রাব্দের মধ্যে প্রথম এবং শেষ কয়েক বছর বাদে পুরো সময় ইহুদিরা তৌরাত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এ সময়ে তৌরাতের পাণ্ডুলিপিটা হারিয়ে যায়।

মোশি তোরাহ লেখে পন্ডুুলিপিটা বনি-ইসরাইলদের যাজক (priests ইমাম) ও গোত্রপতিদের (elders বৃদ্ধ নেতাদের/ মুরববীদের) নিকট সমর্পণ করেছিলেন। তিনি তাদেরকে নির্দেশ প্রদান করেন যে, তারা যেন সে পান্ডুলিপিটাকে সংরক্ষণ করেন এবং ‘সদাপ্রভুর নিয়ম-সিন্দুক’ বা শরীয়ত-সিন্দুক (the ark of the covenant)-এর মধ্যে তা রেখে দেন। তিনি তাদেরকে প্রতি সাত বছর পর পর সকল ইস্রায়েলের সামনে তা পাঠ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন: ‘‘প্রতি সাত বছরের পরে, ঋণ মাফের বছরের কালে, কুটির উৎসব ঈদে, যখন সমস্ত ইসরাইল তোমার আল্লাহ্ মাবুদের মনোনীত স্থানে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হবে, তখন তুমি সমস্ত ইসরাইলের সাক্ষাতে তাদের কর্ণগোচরে এই শরীয়ত (law: তোরাহ বা ব্যবস্থা)  পাঠ করবে।’’ (দ্বিতীয় বিবরণ ৩১/১০-১১, মো.-১৩)

বনি-ইসরাইল বা ইহুদিদের প্রথম প্রজন্ম এ নির্দেশ মেনে চলেন। এরপর তাদের মধ্যে পাপাচারিতা ও ধর্মদ্রোহিতা ব্যাপকহারে ছাড়িয়ে পড়ে। কখনো তারা ধর্মত্যাগ করতেন। আবার কখনো পুনরায় ধর্ম মানতে শুরু করতেন। দাউদ (আ.)-এর রাজত্বের শুরু পর্যন্ত প্রায় তিনশত বছর যাবৎ তাঁদের অবস্থা এরূপ ছিল।

দাউদের রাজত্বকালে বনি-ইসরাইলদের ধর্মীয় ও নৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। দাউদের রাজত্বকালে ও শলোমনের (সুলায়মান আ.-এর) রাজত্বের প্রথমাংশে বনি-ইসরাইলরা ধর্মদ্রোহ পরিত্যাগ করে ধর্মীয় অনুশাসনাদি পালন করে চলেন। কিন্তু বিগত শতাব্দীগুলোর ধর্মদ্রোহিতা, অস্থিরতা ও অরাজকতার মধ্যে মোশির প্রদত্ত ‘সদাপ্রভুর নিয়ম-সিন্দুকে রক্ষিত’ তোরাহটা হারিয়ে যায়। কখন তা হারিয়ে যায় তা সঠিকভাবে জানা যায় না। এতটুকুই জানা যায় যে, শলোমানের রাজত্বের পূর্বেই তা হারিয়ে যায়। কারণ শলোমনের রাজত্বকালে যখন তিনি ‘সদাপ্রভুর নিয়ম-সিন্দুক’-টা উন্মোচন করেন তখন তার মধ্যে তোরাহের কোনো অস্তিত্ব পাননি। সিন্দুকটার মধ্যে শুধু দুটো ‘তোরাহ-বহির্ভূত’ প্রাচীন প্রস্তরফলকই অবশিষ্ট ছিল। বাইবেলের ভাষায়: ‘‘বনি-ইসরাইলরা মিসর দেশ থেকে বের হয়ে আসবার পর মাবুদ তুর পাহাড়ে তাদের জন্য যখন ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন তখন মূসা সিন্দুকের মধ্যে যে পাথরের ফলক দু’টি রেখেছিলেন সেই দু’টি ছাড়া আর কিছুই তার মধ্যে ছিল না।’’ (১ বাদশাহনামা ৮/৯, মো.-১৩)

(খ) শলোমন সন্তানদের ৩০০ বছর (খ্রি. পূ. ৯২০-৬২০): হারানো তৌরাতের ধর্ম পরিত্যক্ত হল

বাইবেলের বিবরণ অনুসারে শলোমনের রাজত্বের শেষভাগ থেকে বনি-ইসরাইলদের মধ্যে জঘন্য বিপর্যয় নেমে আসে। স্বয়ং শলোমন তাঁর শেষ জীবনে ধর্মত্যাগ করেন। তিনি তাঁর স্ত্রীদের পরামর্শে মূর্তিপূজা শুরু করেন এবং মূর্তিপূজার নিমিত্ত মন্দিরাদি নির্মাণ করেন। এভাবে তিনি ধর্মত্যাগী (মুরতাদ) ও পৌত্তলিকে পরিণত হলেন (নাঊযু বিল্লাহ!!) বাইবেলের বর্ণনায় এ অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

তাঁর মৃত্যুর পরে আরো কঠিনতর বিপর্যয় শুরু হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৯২২ সালের দিকে বনি-ইসরাইলদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে শলোমনের একটা রাজ্য দুটো রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। তাদের ১২ গোত্রের মধ্যে ১০টা গোত্র এক পক্ষে এবং বাকি দুটো বংশ এক পক্ষে থাকেন। নবাটের পুত্র যারবিয়ামের (Jeroboam I) নেতৃত্বে বিদ্রোহী ১০টা গোত্র প্যালেস্টাইনের উত্তর অংশে পৃথক রাজ্য ঘোষণা করে। তাদের রাজ্যের নাম হয় ‘ইস্রায়েল’/ইসরাইল (Israel) রাজ্য বা শমরিয়া/ সামোরিয়া (Samaria) রাজ্য। এর রাজধানী ছিল নাবলুস। অবশিষ্ট দুটো গোত্র: যিহূদা ও বিন ইয়ামিন (বিন্যামীন) বংশের রাজা হন শলোমনের পুত্র রহবিয়াম (Rehoboam)। এ রাজ্যের নাম হয় এহূদা, যিহূদা, যুডিয়া বা জুডাহ (Judah/Judea) রাজ্য। এর রাজধানী ছিল জেরুজালেম। উভয় রাজ্যেই ধর্মদ্রোহিতা, মূর্তিপূজা ও অনাচার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তরের ইসরাইল বা শমরীয় রাজ্যের রাজা যারবিয়াম রাজ্যভার গ্রহণ করার পরপরই মোশির ধর্ম ত্যাগ করেন। তার সাথে ইস্রায়েলীয়দের ১০টা গোত্রের মানুষ মোশির ধর্ম ত্যাগ করেন। তারা মূর্তিপুজা শুরু করেন। এদের মধ্যে যারা তোরাহ-এর অনুসারী ছিলেন তারা নিজেদের রাজ্য পরিত্যাগ করে যুডাহ (যিহূদা/ এহুদা) রাজ্যে হিজরত করেন।

পরবর্তী প্রায় ২০০ বছর তারা মূর্তিপুজা ও অনাচারের মধ্যে অতিবাহিত করেন। আধুনিক গবেষকদের মতে ইস্রায়েল রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল খ্রি. পূ. ৯২২ থেকে ৭২২/৭২১ পর্যন্ত কমবেশি ২০০ বছর। এ সময়ে ১৯ জন রাজা এ রাজ্যে রাজত্ব করেন। এরপর নব্য আসিরীয়দের (the Neo-Assyrian Empire) আক্রমণে ইসরাইল রাজ্য বিলুপ্ত হয়। আসিরীয়রা ইস্রায়েলীদেরকে বন্দি করে আসিরীয় রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নির্বাসন দেয় এবং সেখানে অশুরীয় রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে পৌত্তলিকদেরকে এনে বসতি স্থাপন করায়। সেখানে অবশিষ্ট অল্প সংখ্যক ইস্রায়েলীয় এ সকল পৌত্তলিকদের সাথে সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে মিশে যায়। এ সকল ‘ইস্রায়েলীয়’ ইহুদিদেরকে ‘শমরীয়’ বলা হয়।

এভাবে আমরা দেখছি যে, ইহুদিদের ১২ বংশের ১০ বংশ শলোমনের পর থেকেই ধর্মচ্যুত হন এবং পৌত্তলিকদের মধ্যে মিশে যান। তৌরাত তো দূরের কথা, তৌরাতের ধর্মের সাথেও তাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।

যিহূদা রাজ্য আরো প্রায় দেড় শত বছর টিকে ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৭ বা ৫৮৬ সালের দিকে এ রাজ্যের পতন ঘটে। শলোমনের পরে প্রায় সাড়ে তিন শত বছরে ২০ জন রাজা এ রাজ্যে রাজত্ব করেন। এ সকল রাজার মধ্যে বিশ্বাসী রাজার সংখ্যা ছিল কম। অধিকাংশ রাজাই ছিলেন ধর্মত্যাগী ও মূর্তিপূজারী। প্রথম রাজা রহবিয়ামের যুগ থেকেই মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রচলন ঘটে। প্রতিটা বৃক্ষের নিচে মূর্তি স্থাপন করা হয় এবং পূজা করা হয়। ক্রমান্বয়ে বাল-প্রতিমার পূজা ও তার উদ্দেশ্যে পশু-উৎসর্গ করার জন্য জেরুজালেমের অলিতে গলিতে ও সকল স্থানে বেদি স্থাপন করা হয়। শলোমনের মন্দির বা ধর্মধামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়

এ সময়ে দু’বার  জেরুজালেম এবং জেরুজালেমস্থ ধর্মধাম বা শলোমনের মনিদর (মসজিদে আকসা) লুণ্ঠিত হয়। প্রথমবারে যুডাহ রাজ্যের প্রথম রাজা রহবিয়ামের রাজত্বকালে, খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ৯২০ অব্দের দিকে মিশরের ফেরাউন ১ম শেশাঙ্ক বা শীশক (Shashanq I/ Sheshonk I) যুডাহ রাজ্য আক্রমণ করে জেরুজালেম নগর, রাজপ্রাসাদ ও ধর্মধাম  লুণ্ঠন করে নিয়ে যান।[2] দ্বিতীয়বারে, প্রথমবারের কিছুদিন পরে, ইস্রায়েল রাজ্যের ধর্মত্যগী ও মূর্তিপূজক রাজা বাশা (Baasha) জেরুজালেম আক্রমণ করে ধর্মধাম ও রাজপ্রাসাদ ব্যাপকভাবে লুণ্ঠন করেন।

যিহূদা রাজ্যে ধর্মদ্রোহ, মূর্তিপূজা ও অনাচারের ব্যাপকতম প্রসার ও প্রতিষ্ঠা ঘটে রাজা মনঃশি/ মানশা (Manasseh)-এর শাসনামলে (আনুমানিক খ্রি. পূ. ৬৯৩-৬৩৯ অব্দ)। এ সময়ে এ রাজ্যে প্রায় সকল অধিবাসীই তৌরাতের ধর্ম পরিত্যাগ করে মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিক ধর্ম গ্রহণ করেন। শলোমনের ধর্মধাম বা সদাপ্রভুর মন্দিরের মধ্যেই মূর্তিপূজা ও প্রতিমার জন্য পশু-উৎসর্গ করার নিমিত্ত বেদি নির্মাণ করা হয়। রাজা মনঃশি/ মানশা যে প্রতিমার পূজা করতেন তিনি সদাপ্রভুর মন্দিরের মধ্যে সে প্রতিমা স্থাপন করেন। তার পুত্র আমোন (Amon)-এর শাসনামলেও (খ্রি. পূ. ৬৩৯-৬৩৮ অব্দ) ধর্মত্যাগ ও পৌত্তলিকতার অবস্থা একইরূপ থাকে।

(গ) শতশত বছর পরে হারানো তৌরাত কুড়িয়ে পাওয়া (খ্রি. পূ. ৬২০)

আমোনের মৃত্যুর পরে তার পুত্র যোশিয়/ ইউসিয়া (Josiah) আট বছর বয়সে (খ্রি. পূ. ৬৩৮ সালের দিকে) যিহূদা রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। তিনি ধর্মদ্রোহিতা ও অনাচার থেকে বিশুদ্ধভাবে তাওবা করেন। তিনি ও তাঁর রাজ্যের কর্ণধাররা পৌত্তলিকতা সমূলে বিনাশ করে তৌরাতের শরীয়ত পুনপ্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বাতমক চেষ্টা শুরু করেন। তা সত্ত্বেও তাঁর রাজত্বের প্রথম সতের বছর পর্যন্ত কেউ মোশির তৌরাতের কোনো পান্ডুলিপির চিহ্ন দেখেননি বা এর কোনো কথাও কেউ শুনেননি।

বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে, যোশিয়ের রাজত্বের ১৮শ বছরে (খ্রি. পূ. ৬২০/ ৬২১ সালে) মহাযাজক/ মহা-ইমাম হিল্কিয় (Hilki'ah the high priest) দাবি করেন যে, তিনি ‘সদাপ্রভুর গৃহে’, অর্থাৎ শলোমনের মন্দিরের মধ্যে ‘ব্যবস্থাপুস্তকখানা’ বা তৌরাত কিতাবটা (the book of the law) পেয়েছেন। তিনি পুস্তকটা শাফন লেখককে (Shaphan the scribe) প্রদান করেন। শাফন লেখক রাজা যোশিয়কে পুস্তকটা পাঠ করে শোনান। রাজা তা শ্রবণ করে এত বেশি উদ্বেলিত হন যে তিনি নিজের পরিধেয় বস্ত্র ছিড়ে ফেলেন। (২ রাজাবলি ২২/৩-১১; ২ বংশাবলি ৩৪/১৪-১৯)

সম্মানিত পাঠক, এভাবে শত শত বছর পূর্বে হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপিটা পাওয়া গেল! কিন্তু মহাযাজকের এ গল্প কতটুকু সত্য? নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:

(ক) তৌরাতের বিধান অনুসারে তৌরাতের একটামাত্র পাণ্ডুলিপি নিয়ম সিন্দুকে সংরক্ষিত ছিল। এটার অনুলিপি বা প্রতিলিপি করার বিধান ছিল না। বাহ্যত মোশির রেখে যাওয়া ‘কপিটাই’ ফিরে পাওয়ার দাবি করলেন মহাযাজক। কিন্তু প্রায় হাজার বছর কোনোরূপ সংরক্ষণ ছাড়া একটা পাণ্ডুলিপি কিভাবে টিকতে পারে?

(খ) প্রায় তিন শত বছর পূর্বে বনি-ইসরাইল জাতি তৌরাতের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর মধ্যে দু’বার তৌরাতের অবস্থানস্থল ‘মাসজিদুল আকসা’ বা ‘সদাপ্রভুর গৃহ’ বিজয়ী শত্রুদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। এরপর এ গৃহটাকে প্রতিমা পূজার কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। প্রতিমাপূজারীরা প্রতিদিন এ গৃহে প্রবেশ করতেন।

(গ) বর্তমানে তৌরাতের পঞ্চপুস্তক অতি ছোট ছাপার অক্ষরে ঘন করে লেখেও প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ পৃষ্ঠার পুস্তক। এ বিশাল পুস্তকটা মাটির ফলক বা চামড়ায় লেখলে কত বিশাল আকৃতির হবে তা পাঠক বুঝতে পারছেন। এটা কোথাও গোপন রাখা যায় না। তৌরাতের ঘোর শত্রু মূর্তিপূজারীদের হাত থেকে এ পুস্তকটা রক্ষা করারও কেউ ছিলেন না। কাজেই আক্রমণ ও লুণ্ঠনকারী বিদেশীরা এটা বিনষ্ট না করলেও প্রতিমাপূজারী রাজা ও প্রজারা এটাকে বিনষ্ট করেছিলেন বলেই প্রতীয়মান।

(ঘ) যোশিয় রাজার রাজত্বের প্রথম ১৭টা বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। এ দীর্ঘ সময়ে রাজা স্বয়ং ও রাজ্যের নেতৃবর্গ ও সাধারণ প্রজারা সকলেই তৌরাতের শরীয়ত পালন ও পুন-প্রতিষ্ঠায় প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় নিরত ছিলেন। এত কিছু সত্ত্বেও এই দীর্ঘ সময়ে কেউ তোরাহ বা ব্যবস্থাপুস্তকের নামটা পর্যন্ত শুনতে পেলেন না। এ বিশাল গ্রন্থমালার কোনো সন্ধানই কেউ পেলেন না! এ দীর্ঘ সময়ে সদাপ্রভুর গৃহের রক্ষক ও যাজকরা প্রতিদিন এ গৃহের মধ্যে যাতায়াত করতেন। বড় অবাক কথা যে, এই দীর্ঘ সময় পুস্তকটা সদাপ্রভুর গৃহে থাকবে, অথচ এত মানুষ কেউ তার দেখা পাবে না!

প্রকৃত কথা হল, এ পুস্তকটা বা ‘তোরাহ’-এর এ পান্ডুলিপিটা পুরোটাই হিল্কিয় মহাযাজকের উদ্ভাবনা ও রচনা ছাড়া কিছুই নয়। তিনি যখন দেখলেন যে, রাজা যোশিয় এবং তাঁর অমাত্যবর্গ সকলেই তৌরাতের শরীয়ত পালন ও প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী, তখন তিনি তাঁর যুগে লোকমুখে প্রচলিত সত্য ও মিথ্যা সকল প্রকারের মৌখিক বর্ণনা একত্রিত করে এ পুস্তকটা রচনা করেন। এগুলো সংকলন ও লিপিবদ্ধ করতেই তাঁর এ দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। যখন তিনি সংকলনের কাজ সমাপ্ত করেন, তখন তিনি তাঁর সংকলিত এ তৌরাত কিতাবটার বিষয়েই মহাযাজক বা মহা-ইমাম হিল্কিক লেখক শাফনকে বলেন: ‘‘মাবুদের ঘরে আমি তৌরাত কিতাবটি পেয়েছি।’’ (২ বাদশাহনামা ২২/৮)

তাহলে হিল্কিয়ি যে তৌরাত কিতাবটা পেলেন সেটা মূলত তাঁরই রচনা ও সংকলন। এরপরও এ সত্যকে পাশ কাটিয়ে আমরা ধরে নিচ্ছি যে, হিল্কিয়ি তোরাহ-এর পান্ডুলিপিটা পেয়েছিলেন। রাজা যোশিয়ের রাজত্বের ১৮শ বছরে পান্ডুলিপিটা পাওয়া যায়। পরবর্তী ১৩ বছর, যতদিন রাজা যোশিয় জীবিত ছিলেন, ততদিন যিহূদা বা জুডাহ রাজ্যের ইহুদিরা এ তোরাহ অনুসারে নিজেদের ধর্মকর্ম পরিচালনা করেন।

(ঘ) ১৩ বছর পর তৌরাতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন

যোশিয়ের মৃত্যুর পরে তার পুত্র যিহোয়াহস (Jeho'ahaz) রাজত্ব লাভ করেন। তিনি রাজত্ব লাভ করে তৌরাতের ধর্ম পরিত্যাগ করেন এবং রাজ্যে পৌত্তলিকতার প্রসার ঘটান। মিশরের সম্রাট ফরৌণ-নখো বা নেকু (Neku) যিহোয়াহসকে বন্দি করে নিয়ে যান এবং তার ভ্রাতা ইলিয়াকীমকে যিহোয়াকীম (Jehoiakim/Joakim) নাম প্রদান পূর্বক সিংহাসনে বসান। যিহোয়াকীমও তার ভাইয়ের মত ধর্মদ্রোহী ও পৌত্তলিক ছিলেন। যিহোয়াকীমের মৃত্যুর পরে তার পুত্র যিহোয়াখীন (Jehoiachin/Joachin) রাজত্ব লাভ করেন। তিনিও তাঁর পিতা ও চাচার মতই ধর্মত্যাগী ও পৌত্তলিক ছিলেন। এ সময়ে ব্যাবিলনের সম্রাট বখত নসর বা ২য় নেবুকাদনেজার (Nebuchadrezzar II) প্রথমবারের মত যিহূদা রাজ্য দখল করেন। তিনি জেরুজালেম শহর, রাজ প্রাসাদ, ও ‘সদাপ্রভুর গৃহের’ সমস্ত ধন-সম্পদ ও দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করে নিয়ে যান। তিনি রাজা যিহোয়াখীনকে বন্দি করে ব্যাবিলনে নিয়ে যান এবং তাঁর পরিবর্তে তাঁর চাচা সিদকিয়কে (Zedekiah) রাজত্ব প্রদান করেন। তিনি বিপুল সংখ্যক ইহুদিকে বন্দি করে ব্যাবিলনে নিয়ে যান।[3]

যদি একথা ধরে নেওয়া হয় যে, যোশিয়ের সময়ে ‘পাওয়া’ (অথবা সংকলিত!) তোরাহ-এর পান্ডুলিপিটা বা তার প্রতিলিপি যোশিয়ের মৃত্যুর পরে তাঁর ধর্মত্যাগী বংশধরদের নিকট বিদ্যমান ছিল, তবে স্বভাবতই নেবুকাদনেজারের প্রথম এ আক্রমণ ও লুণ্ঠনে তা বিনষ্ট হয়েছিল বলে বুঝতে হবে।

(ঙ) মাত্র তিন দশকের মাথায় কুড়ানো মানিক হারিয়ে গেল (খ্রি. পূ. ৫৮৬)

প্রায় দশ বছর পরে খ্রি. পূ. ৫৮৭/৫৮৬ সালের দিকে রাজা সিদকিয় (Zedekiah) নেবুকাদনেজারের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তখন তিনি  দ্বিতীয়বার জেরুজালেম আক্রমন ও দখল করেন। তিনি রাজা সিদকিয়কে বন্দি করে তাঁরই সামনে তাঁর পুত্রদেরকে জবাই করেন। এরপর তিনি সিদকিয়ের চক্ষু উৎপাটন করেন এবং তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ব্যাবিলন প্রেরণ করেন। নেবুকাদনেজার-এর বাহিনী এবার জেরুজালেমকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে। তারা জেরুজালেমের ধর্মধাম বা ‘সদাপ্রভুর গৃহ’, রাজ-প্রাসাদসমূহ ও জেরুজালেমের সকল বাড়িঘর ও অট্টালিকা অগ্নিসংযোগ করে ভস্মীভূত করে, জেরুজালেম নগরীর চারিদিকের প্রাচীর ভেঙে দেয় এবং যিহূদা (Judah) রাজ্যে অবস্থানকারী অবশিষ্ট ইস্রায়েল সন্তানকে বন্দি করে ব্যাবিলনে নিয়ে যায়। কিছু দীন-দরিদ্র, কৃষক ও আঙ্গুর বাগানের কর্মী শুধু সেদেশে বসবাস করতে থাকে।[4]  এ ঘটনায় তোরাহ এবং পুরাতন নিয়মের অন্যান্য সকল পুস্তক - যেগুলো এ ঘটনার পূর্বে লিখিত হয়েছিল - সবই চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে বিলীন হয়ে যায়। ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিতরাও একথা একবাক্যে স্বীকার করেন। প্রায় এক শতাব্দী ইহুদিরা বন্দি অবস্থায় ব্যাবিলনে অবস্থান করেন।

(চ) প্রায় শতবর্ষ পরে ইয্রা কর্তৃক তৌরাতের পুনর্লিখন (আনু. খ্রি. পূ. ৪৫০)

ইহুদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী প্রায় এক শতাব্দী পরে ইয্রা (Ezra/Ezra the Scribe/ Ezra the Priest) পুনরায় পুরাতন নিয়মের এ সকল গ্রন্থ নিজের পক্ষ থেকে লেখেন। বাইবেল ও তালমুদের বর্ণনা অনুসারে ইয্রা ও নহিমিয়া (Nehemiah) পারস্যের রাজা আরটাক্সেরক্সেস (Artaxerxes: 445/444 BC)-এর অনুমতিক্রমে ইহুদিদেরকে ব্যাবলিনের নির্বাসন (Babylonian exile) থেকে পুনরায় জেরুজালেমে ফেরত আনেন। এরপর ইয্রা নিজের পক্ষ থেকে তৌরাত লেখেন।

(ছ) ইয্রার পুনর্লিখন কাহিনী বিষয়ে আধুনিক গবেষকদের মত

আধুনিক অনেক পাশ্চাত্য বাইবেল বিশেষজ্ঞ ইয্রার অস্তিত্বই অস্বীকার করেন। তারা দাবি করেন ইয্রার নাম ও তার নামের কাহিনীগুলো অনেক পরে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতকে প্রচারিত হয়। প্রকৃতপক্ষে এ নামে কেউ ছিলেন না। এ মতের পক্ষে তারা বিভিন্ন প্রমাণ পেশ করেন। সেগুলোর মধ্যে দুটো বিষয় সর্বাধিক লক্ষণীয়:

(১) ইয্রার নামে প্রচারিত পুস্তকগুলো পরস্পর বিরোধী। যেমন, নহিমিয়ের পুস্তকের যে গল্পগুলো নহিমিয়ের নামে বলা হয়েছে, ১ ইসদরাস (১ ইয্রা) পুস্তকে সেগুলো ইয্রার নামে বলা হয়েছে।

(২) খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রচিত বাইবেলীয় গ্রন্থ ‘বেন-সিরা’ (Wisdom of Sirach/Ecclesiasticus) থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ইয্রার নামও জানতেন না। তিনি নহিমিয়ের প্রশংসা করেছেন, কিন্তু ইয্রার কোনো উল্লেখই করেননি।[5]

ইয্রার পুনর্লিখন কাহিনী সত্য হলেও তা পুনর্লিখিত তৌরাতের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করে না। কারণ আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখব যে, ইয্রার নিজের লেখা বলে প্রচলিত ‘ইয্রা’ পুস্তকের মধ্যেই অনেক পরস্পর-বিরোধী সাংঘর্ষিক বক্তব্য বিদ্যমান। ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা বলেন, ইয্রা হগয় ও ইদ্দোর পুত্র সখরিয়, এ দুজন ভাববাদীর সহায়তায় ‘বংশাবলির প্রথম খন্ড (1 Chronicles) ও ‘বংশাবলির দ্বিতীয় খন্ড (2 Chronicles) গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। এ গ্রন্থদ্বয় মূলত এ তিনজনের লেখা। অথচ এ দুই গ্রন্থের সাথে তোরাহ-এর বিবরণের ব্যাপক বৈপরীত্য রয়েছে। ইহুদি-খ্রিষ্টান পণ্ডিতরা একমত যে, ইয্রা তৌরাতের অসম্পূর্ণ ও আংশিক কাগজপত্রের উপর নির্ভর করেছিলেন বলে এমন ভুল করেছিলেন। একথা তো স্পষ্ট যে, এ তিনজন ভাববাদী তাঁদের নিকট বিদ্যমান ‘তোরাহ’ এর বর্ণনা অনুসরণ করে তাঁদের গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। মোশির যে তোরাহ-এর উপর তাঁরা নির্ভর করেছিলেন আজকের প্রচলিত তোরাহ যদি সে তোরাহই হত তাহলে কোনো মতেই এ তিন জনের বর্ণনার সাথে প্রচলিত তোরাহ-এর বর্ণনার বৈপরীত্য দেখা দিত না। আর যদি ইয্রার সময়ে মোশির তোরাহ-এর কোনো অস্তিত্ব থাকত তাহলে তিনি কখনোই তোরাহ বাদ দিয়ে ‘অসম্পূর্ণ বংশতালিকা’র উপর নির্ভর করতেন না।

ইহুদি-খ্রিষ্টানরা দাবি করেন যে, ইয্রা ওহী বা ইলহামের (Divine Inspiration) মাধ্যমে তোরাহ নতুন করে লেখেছিলেন। অথচ ইহুদি ধর্মীয় ঐতিহ্যে কখনোই ইয্রাকে নবী বলা হয়নি। তাকে লিপিকার ইয্রা (Ezra the Scribe) বা পুরোহিত ইয্রা (Ezra the Priest) বলা হয়। (উইকিপিডিয়া: Ezra)

সর্বাবস্থায়, বর্তমানে বিদ্যমান তৌরাতের সাথে ইয্রা লিখিত পুস্তকগুলোর তথ্যের বৈপরীত্য প্রমাণ করে যে, প্রচলিত তৌরাত ইয্রা লিখিত তৌরাত নয়। এগুলো প্রমাণ করে যে, প্রচলিত তৌরাত, ইয্রার পুস্তক ও বাইবেলীয় সকল পুস্তকের মধ্যেই অনেক বিকৃতি ও পরিবর্তন অনুপ্রবেশ করেছে।

(জ) পুনর্লিখিত তৌরাত তিন শতাব্দী পরে বিনষ্ট হয় (খ্রি. পূ. ১৬৮)

এর প্রায় তিন শতাব্দী পরে খ্রি. পূ. ১৬৮-১৬৪ সালের দিকে সিরিয়ার গ্রিক শাসক চতুর্থ এন্টিয়ক (Antiochus IV Epiphanes c. 215-164 BC)-এর হাতে আবার তৌরাত বিনষ্ট ও বিলুপ্ত হয়।

এন্টিয়ক ইহুদি ধর্ম সম্পূর্ণ নির্মূল করে ফিলিস্তিনে গ্রিক হেলেনীয় ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি অর্থের বিনিময়ে ইহুদি ধর্মযাজকদের পদ ক্রয় করে নেন। তিনি প্রায় ৮০ হাজার ইহুদি হত্যা করেন, জেরুজালেম ধর্মালয়ের সকল সম্পদ লুণ্ঠন করেন এবং ইহুদিদের বেদিতে শূকর জবাই করেন। তিনি ২০ হাজার সৈন্যকে জেরুজালেম অবরোধ করতে নির্দেশ দেন। শনিবার ইহুদিরা যখন ধর্মালয়ে প্রার্থনার জন্য জমায়েত হয় তখন তারা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। তারা নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করে, সকল বাড়িঘর ধ্বংস করে অগ্নিসংযোগ করে। পাহাড়ে-গুহায় পলাতক কিছু ইহুদি ছাড়া কেউই এ হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পায় না।

বাইবেলের মাকাবীয় ১ম পুস্তক (1 Maccabees)-এর প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, এন্টিয়কাস জেরুজালেম অধিকার করার পর তার নির্দেশে পুরাতন নিয়মের পুস্তকাদির কপি-পান্ডুলিপি যেখানে যা পাওয়া যেত তা সবই ছিড়ে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হত। কোনো ব্যক্তির নিকট পুরাতন নিয়মের কোনো পুস্তকের পান্ডুলিপি বা কপি পাওয়া গেলে, অথবা কোনো ব্যক্তি তৌরাতের কোনো বিধান পালন করলে তাকে হত্যা করা হত। প্রতি মাসে অনুসন্ধান করা হত। কারো নিকট পুরাতন নিয়মের কোনো পুস্তকের পান্ডুলিপি বা কপি পাওয়া গেলে, অথবা কেউ শরীয়তের কোনো বিধান পালন করলে তাকে হত্যা করা হত। আর সে পাণ্ডুলিপিটা বিনষ্ট করা হত। (জুবিলী বাইবেল, ১ মাকাবীয় ১/৫৪-৫৯)

সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত এ নিধন ও বিনাশের ধারা অব্যাহত থাকে। খ্রিষ্টান ঐতিহাসিকদের এবং ইহুদি ঐতিহাসিক জোসেফাস (Flavius Josephus)-এর রচনায় এ সকল ঘটনা বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

আমরা আগেই বলেছি, তৌরাতের পূর্ণ পাণ্ডুলিপি একটার বেশি থাকত বলে প্রমাণ নেই। সাধারণ মানুষের কাছে আংশিক কিছু থাকত। ইয্রার লিখিত তৌরাতের সকল পাণ্ডুলিপিই এ ঘটনায় বিনষ্ট ও বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বাহ্যত ইহুদিরা খণ্ডতে পাণ্ডুলিপি, জনশ্রুতি ও ধর্মগুরুদের জ্ঞানের উপর নির্ভর করে তাঁদের ধর্মগ্রন্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করেছেন। তবে সময়ের আবর্তনে সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা দেখেছি যে, এন্টিয়কের আক্রমণের পূর্বেই হিব্রু বাইবেল গ্রিক ভাষায় অনূদিত হয়। গ্রিক সংস্করণের মধ্যেও পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন ও বিয়োজন অব্যাহত থাকে। বাইবেলীয় পুস্তকগুলোর সংখ্যা আলোচনায় আমরা এর নমুনা দেখেছি।

[1] উইকিপিডিয়া, ব্রিটানিকা,এনকার্টা: Moses, David ও Solomon আর্টিকেলগুলো দেখুন।
[2] ১ রাজাবলি ১১/৪০, ১৪/২৫, ১৫/২৫-২৬; বংশাবলি ১২/২-৯; মতিওর রহমান, ঐতিহাসিক অভিধান, পৃ. ৬।
[3] বাইবেলের ভাষায়: তিনি জেরুজালেমের সমস্ত লোক, সমস্ত প্রধান লোক ও সমস্ত বলবান বীর, অর্থাৎ দশ সহস্র বন্দি এবং সমস্ত শিল্পকার ও কর্মকারকে লইয়া গেলেন; দেশের দীন দরিদ্র লোক ব্যতিরেকে আর কেহ অবশিষ্ট থাকিল না। ২ রাজাবলি ২৪/১৪
[4] ২ রাজাবলি ২৪ অধ্যায়ে এ সকল ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
[5] উইকিপিডিয়া: Ezra.