৬. ৫. ৪. ২. ৫. রাষ্ট্র ও নাগরিক বিষয়ক মুলনীতি

ইসলামের প্রথম দুটি ফিরকা: শীয়া ও খারিজী ফিরকার উদ্ভব ও উন্মেষ ঘটেছিল রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে। রাজনৈতিক বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভক্তি ঘটে। বিশেষত খারিজীগণ এ বিষয়ে দুটি আকীদার উদ্ভাবন করে: (১) পাপী ব্যক্তির ইমামতের অবৈধতা এবং (২) পাপী ইমামের অপসারণের আবশ্যকতা। তাদের দাবি ছিল যে, পাপী ব্যক্তি কাফির, আর কাফির ব্যক্তি সালাতের বা রাষ্ট্রের ইমামতি করতে পারে না। বরং মুমিনের জন্য ফরয যে,  এরূপ ইমামের বিরুদ্ধে সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের অংশ হিসেবে বিদ্রোহ করবে এবং জিহাদ করে একে অপসারণ করবে।

এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের সকল নির্দেশনা গ্রহণ করার মূলনীতির আলোকে সাহাবীগণ ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতে আলিমগণ মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তাঁদের মতে অন্যান্য মুমিনের ন্যায় পাপী শাসকের ক্ষেত্রেও পাপের কারণে তাকে কাফির বলা যায় না, যতক্ষণ না সুনিশ্চিত কুফরী বা শিরকে সে নিপতিত হয়। পাপী শাসক-প্রশাসকের পাপ যেমন সমর্থন করা যাবে না, তেমানি তার পাপের কারণে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা নষ্ট বা বিদ্রোহ করা যাবে না। মধ্যপন্থা অবলম্বন করে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও শান্তি বজায় রাখতে হবে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

مَنْ رَأَى مِنْ أَمِيرِهِ شَيْئًا يَكْرَهُهُ فَلْيَصْبِرْ عَلَيْهِ فَإِنَّهُ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ (وفي لفظ: خَرَجَ مِنْ السُّلْطَانِ) شِبْرًا فَمَاتَ إِلا مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً

‘‘কেউ তার শাসক বা প্রশাসক থেকে কোন অপছন্দনীয় বিষয় দেখলে তাকে ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। কারণ যদি কেউ জামা‘আতের (সমাজ বা রাষ্টের ঐক্যের বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের) বাইরে, দ্বিতীয় বর্ণনায়: রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের বাইরে এক বিঘতও বের হয়ে যায় এবং এই অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাহলে সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।’’[1]

উম্মু সালামা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

إِنَّهُ يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ فَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ بَرِئَ وَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ سَلِمَ وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلا نُقَاتِلُهُمْ قَالَ لا مَا صَلَّوْا

‘‘অচিরেই তোমাদের উপর অনেক শাসক প্রশাসক আসবে যারা ন্যায় ও অন্যায় উভয় প্রকারের কাজ করবে। যে ব্যক্তি তাদের অন্যায়কে ঘৃণা করবে সে অন্যায়ের অপরাধ থেকে মুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি আপত্তি করবে সে (আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে) নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু যে এ সকল অন্যায় কাজ মেনে নেবে বা তাদের অনুসরণ করবে (সে বাঁচতে পারবে না।)’’ সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বলেন, ‘‘না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করবে।’’[2]

আউফ ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

أَلا مَنْ وَلِيَ عَلَيْهِ وَالٍ فَرَآهُ يَأْتِي شَيْئًا مِنْ مَعْصِيَةِ اللَّهِ فَلْيَكْرَهْ مَا يَأْتِي مِنْ مَعْصِيَةِ اللَّهِ وَلا يَنْزِعَنَّ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ

‘‘তোমরা হুশিয়ার থাকবে! তোমাদের কারো উপরে যদি কোনো শাসক-প্রশাসক নিযুক্ত হয় এবং সে দেখতে পায় যে, উক্ত শাসক বা প্রশাসক আল্লাহর অবাধ্যতার কোনো কাজে লিপ্ত হচ্ছে, তবে সে যেন আল্লাহর অবাধ্যতার উক্ত কর্মকে ঘৃণা করে, কিন্তু আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেবে না।’’[3]

ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন:

والصلاة خلف كل بر وفاجر من المؤمنين حائزة.

‘‘এবং সকল নেককার ও বদকার মুমিনের পিছনে সালাত আদায় বৈধ।’’[4]

ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:

ونرى الصلاة خلف كل بر وفاجر من أهل القبلة ... ولا نري الخروج على أئمتنا وولاة أمورنا وإن جاروا، ولا ندعو عليهم ولا ننزع يدا من طاعتهم. ونرى طاعتهم من طاعة الله عز وجل فريضة ما لم يأمروا بمعصية. وندعو لهم بالصلاح والمعافاة... ونحب أهل العدل والأمانة، ونبغض أهل الجور والخيانة. .... والحج والجهاد ما ضيان مع أولي الأمر من المسلمين برهم وفاجرهم، إلى قيام الساعة، لا يبطلهما شيء ولا ينقضهما.

‘‘আমরা কিবলাপন্থী প্রত্যেক নেককার ও বদকার মুসলিমের পিছনে সালাত কায়েম করা ... বৈধ মনে করি। ... আমাদের ইমাম বা শাসকবর্গ অত্যাচার করলেও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বৈধ মনে করি না। আমরা তাদেরকে অভিশাপ প্রদান করি না এবং তাদের আনুগত্যও বর্জন করি না। আমরা তাদের প্রতি আনুগত্যকে আল্লাহরই আনুগত্যের অংশ হিসেবে ফরয মনে করি যতক্ষণ না তারা কোনো পাপ কর্মের নির্দেশ দেয়। আর তাদের সংশোধন ও সংরক্ষণের জন্য দু‘আ করি। আমরা ন্যায়বিচারক ও দায়িত্ববান-আমানত আদায়কারী শাসকদের ভালবাসি এবং জালিম, দুর্নীতিবাজ বা দায়িত্বে খিয়ানতকারীদের ঘৃণা করি। মুসলিম শাসকের অধীনে- সে নেককার হোক আর পাপী-বদকার হোক- হজ্জ্ব এবং জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কোনো কিছুই এ দু’টোকে বাতিল বা ব্যাহত করতে পারে না।’’[5]

[1] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬১২; মুসলিম আস-সহীহ ৩/১৪৭৭।
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৮০, ১৪৮১।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৮২।
[4] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১২৩।
[5] আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৫-১৬।