৬. ৫. ৪. ২. ৩. রিসালাত ও বিলায়াত বিষয়ে মূলনীতি

এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি কুরআন ও হাদীসের সর্বজনীনতায় বিশ্বাস করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে কোনো ব্যক্তির নিষ্পাপত্ব, অভ্রান্ততা বা বিশেষ জ্ঞানে বিশ্বাস না করা। তাঁরা কাশফ, ইলহাম, ইলকা ইত্যাদির অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন এবং এগুলিকে ব্যক্তি মুমিনের জন্য ‘কারামত’ বা মর্যাদা ও নিয়ামত বলে গণ্য করেন। কিন্তু এগুলিকে আকীদার উৎস হিসেবে বা কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন না। আলিম বা বজুর্গ ব্যক্তি যতই বড় হোন, তিনি কখনোই ইসমাত বা অভ্রান্ততার পদমর্যাদা পাবেন না। তার অনেক সঠিক মতের পাশাপাশি কিছু ভুল মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। শুধু স্বাভাবিকই নয়, বরং সুনিশ্চিত। এ বিষয়ে ইমাম মালিক (রাহ) বলেন:

كل أحد يؤخذ من قوله ويترك الا صاحب هذا القبر صلى الله عليه وسلم

‘‘প্রত্যেক ব্যক্তিরই কিছু মত গ্রহণ করা হয় এবং কিছু মত বাদ দেওয়া হয়, একমাত্র ব্যতিক্রম এ কবরে যিনি শায়িত আছেন তিনিই, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)।’’[1]

এভাবে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণের নিকট রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে আর কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করা হয় না। কুরআন ও সুন্নাতের মানদন্ডে যাচাই করেই সকল কথা গ্রহণ করতে হবে। কারো কথা দিয়ে কুরআন বা সুন্নাত বিচার করা যায় না, বরং কুরআন ও সুন্নাত দিয়ে প্রত্যেকের কথা যাচাই করে গ্রহণ করতে হবে। অমুক বলেছেন কাজেই তা দীনের প্রমাণ বা আকীদার দলীল এরূপ চিন্তা করার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।

আল্লামা উমর ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাসাফী (৫৩৭ হি.) তাঁর ‘‘আল-আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ’’ ও অষ্টম শতকের প্রখ্যাত শাফেয়ী ইমাম আল্লামা সা’দ উদ্দীন মাসঊদ ইবনু উমর আত-তাফতাযানী (৭৯১ হি) তাঁর ‘‘শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ’’ -তে লিখেছেন:

 الإلهام المفسر بإلقاء معنى في القلب بطريق الفيض ليس من أسباب المعرفة بصحة الشيء عند أهل الحق

‘‘হক্কপন্থীগণের নিকট ইলহাম বা ইলকা কোনো কিছুর সঠিকত্ব জানার কোনো মাধ্যম নয়।’’[2]

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত সাহাবীগণ, নবী-বংশ এবং নেককার মানুষদের ভক্তি ও ভালবাসায় তাঁরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তাঁরা নেককার মানুষদেরকে ভালবাসেন, কিন্তু কারো ভালবাসায় বাড়াবাড়ি করেন না। তাঁরা সকল মুমিনকে আল্লাহর ওলী বলে গণ্য করেন, যার তাকওয়া ও কুরআন-সুন্নাতের আনুগত্য যত বেশি সে তত বেশি কামিল ওলী বলে বিশ্বাস করেন। তবে কুরআন কারীমে বা হাদীস শরীফে যাদের বিষয়ে জান্নাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাঁরা ছাড়া অন্য কাউকে সুনিশ্চিত ‘ওলী’ বলা তো দূরের কথা, সুনিশ্চিত জান্নাতী বলেও সাক্ষ্য দেন না। বরং তাদের বিষয়ে ভাল ধারণা পোষণ করেন এবং তাদের জান্নাতের আশা করেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন:

وأفضل الناس بعد النبين عليهم الصلاة والسلام أبو بكر الصديق ثم عمر بن الخطاب الفاروق ثم عثمان بن عفان ذو النورين ثم علي بن أبي طالب المرتضي رضوان الله تعالي أجمعين، عابدين ثابتين علي الحق ومع الحق، نتولاهم جميعا ولا نذكر أحدا من أصحاب َرسول الله (ﷺ) إلا بخير.

‘‘নবীগণের (আঃ) পরে মানব জাতির মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আবূ বাক্র সিদ্দীক, তাঁর পরে উমার ইবনুল খাত্তাব আল-ফারূক, তাঁর পরে যুন্নুরাইন উসমান ইবনু আফ্ফান, তাঁর পরে আলী ইবনু আবী তালিব আল-মুরতাযা, রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন, আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হন। তাঁর আজীবন আল্লাহর ইবাদতের থেকেছেন এবং সত্যের উপরে ও সত্যের সাথে সুপ্রতিষ্ঠিত থেকেছেন। আমরা তাঁদের সকলকেই ভালবাসি ও ওলী হিসেবে গ্রহণ করি। আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোনো একজন সাহাবীর বিষয়েও ভাল কথা ছাড়া কিছু বলি না।"[3]

এ বিষয়ে ইমাম তাহাবী (রাহ) বলেন:

نحب أصحاب رسول الله (ﷺ)، ولا نفرط في حب أحد منهم. ولا نتبرأ من أحد منهم، ونبغض من يبغضهم وبغير الخير يذكرهم. ولا نذكر هم إلا بخير. ... وإن العشرة الذين سماهم رسول الله (ﷺ) وبشرهم بالجنة نشهد لهم بالجنة على ما شهد لهم رسول الله (ﷺ) وقوله الحق ... ومَنْ أحسن القولَ في أصحاب رسول الله (ﷺ)، وأزواجه الطاهرات من كل دنس وذرياته المقدسين من كل رجس فقد برئ من النفاق. وعلماء السلف من السابقين، ومن بعدهم من التابعين، أهل الخير الأثر، وأهل الفقه والنظر، لا يذكرون إلا بالجميل، ومن ذكرهم بسوء فهو على السبيل.

‘‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণকে ভালবাসি। তাঁদের কারো ভালবাসায় বাড়াবাড়ি করি না এবং তাঁদের কারো প্রতি অভক্তি বা সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করি না। যারা সাহাবীগণকে বিদ্বেষ করে বা ঘৃণা করে বা ভালভাবে ছাড়া তাদের উল্লেখ করে আমারা তাদেরকে ঘৃণা করি। আমরা তাঁদেরকে ভাল কথা ছাড়া উল্লেখ করি না। ... রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে দশজন সাহাবীর নাম উল্লেখ করে তাদের জান্নাতবাসী হওয়ার সুসংবাদ দান করেছেন আমার তাঁর এই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তাদের জান্নাতবাসী হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান করি। কেননা, তাঁর উক্তি সত্য। ... যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবীগণ, তাঁর নিষ্কলুষ সহধর্মিনী ও পুত-পবিত্র নির্মল বংশধরগণ সম্পর্কে উত্তম মন্তব্য করলো সে নেফাক থেকে মুক্ত হলো। প্রথম যুগের সালফে সালেহীন ও তাঁদের সঠিক অনুসারী পরবর্তীকালের আলেমগণ যারা হলেন কল্যাণ ও ঐতিহ্যের প্রতীক এবং ধর্ম জ্ঞানে পারদর্শী চিন্তাবিদ, যথাযোগ্য কৃতজ্ঞতা ও সম্মানের সাথে তাঁদের উল্লেখ করতে হয়।  আর যে তাঁদের সম্পর্কে কটুক্তি বা বিরূপ মন্তব্য করে সে ভ্রান্ত পথের অনুসারী।’’[4]

চতুর্থ অধ্যায়ে কারামাতুল আউলিয়া প্রসঙ্গে আমরা দেখেছি, উম্মাতের ওলীগণের পরিচয়ে ইমাম তাহাবী বলেছেন: ‘‘সকল মুমিন করুণাময় আল্লাহর ওলী। তাঁদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কুরআনের অনুসরণকারী সে ততবেশি আল্লাহর নিকট সম্মানিত।’’ আমরা আরো দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা (রাহ), ইমাম তাহাবী (রাহ) প্রমুখ ইমাম উল্লেখ করেছেন যে, ঈমান ও মা’রিফাতের দিক থেকে সকল মুমিনই সমান, কাজেই বেলায়াতের কমবেশি তাকওয়া ও আনুগত্য অনুসরণের ভিত্তিতেই হয়, কোনো ব্যক্তির বিশেষ সম্পর্ক, বংশ, ইত্যাদির কারণে নয়।

মুমিনদের বিষয়ে ও ওলীগণের বিষয়ে এ হলো আহলুস সুন্নাতের সাধারণ আকীদা। শীয়া বা অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মত তাঁরা ওলীগণের মর্যাদা বিষয়ক সাধারণ আয়াত ও হাদীসকে পুঁজি করে নির্দিষ্ট কাউকে ওলী বলে নিশ্চিত করেন না বা তাকে অভ্রান্ত বলে দাবি করে তার মতামতকে কুরআন বা হাদীসের একমাত্র ব্যাখ্যা বা আকীদার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন না। কেবলমাত্র কুরআন বা হাদীসে যাদেরর জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে তাঁদেরকেই জান্নাতী বলে সাক্ষ্য দেন। আর তাঁদের জান্নাত ও বিলায়াতের সাক্ষ্যকে তাঁরা অভ্রান্ততার সাক্ষ্য বলে গণ্য করেন না। বরং তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে কাউকে মা’সূম বা নিষ্পাপ, নিভুল বা অভ্রান্ত বলে বিশ্বাস করেন না। ইমাম তাহাবী বলেন:

ونرجو للمحسنين من المؤمنين أن يعفو عنهم ويدخلهم الجنة برحمته، ولا نأمن عليهم، ولا نشهد لهم بالجنة، ونستغفر لمسيئهم، ونخاف عليهم، ولا نقنطهم

‘‘নেককার বা ইহসান অর্জনকারী মুমিনদের বিষয়ে আমরা আশা পোষণ করি যে, মহান আল্লাহ দয়া করে তাদের ক্ষমা করবেন এবং জান্নাত প্রদান করবেন, তবে আমরা তাদের বিষয়ে নিশ্চিত নিরাপত্তা অনুভব করি না এবং তাদের জন্য জান্নাতের সাক্ষ্য প্রদান করি না। আর আমার পাপী মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাদের বিষয়ে ভীতি অনুভব করি। তবে তাদেরকে নিরাশ করি না।’’[5]

এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনু আবিল ইয্য বলেন: ‘‘বিষয়টি যেহেতু এরূপ সেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যার বিষয়ে জান্নাতের সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি ছাড়া উম্মাতের কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিষয়ে তাকে জান্নাতী বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না, বরং আমরা নেককার বা ইহসানের পর্যায়ে পৌঁছানো মুমিনদের জন্য আশাবোধ করি এবং তাদের বিষয়ে ভীতিও বোধ করি।’’[6]

ইমাম তাহাবী অন্যত্র বলেন:

وَلا نُنْزِلُ أَحَدًا مِنْهُمْ جَنَّة وَلا نَارًا

‘‘আমরা মুমিনদের কাউকে জান্নাতে বা জাহান্নামে অবতরণ কারই না।’’[7]

এর ব্যাখ্যায় ইবনু আবিল ইয্য বলেন: ‘‘ইমাম তাহাবী বলছেন যে, আমরা আহলূ কিবলার মধ্য থেকে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিষয়ে বলি না যে, সে জান্নাতী অথবা জাহান্নামী। কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যার বিষয়ে জান্নাতী বলে সংবাদ দিয়েছেন তাদেরকেই আমরা জান্নাতী বলি, যেমন আশারায়ে মুবাশ্শারা। আমরা যদিও বলি যে, কবীরা গোনাহে লিপ্ত মুমিনদের যাকে চান আল্লাহ জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন এবং এরপর শাফা‘আতকারীদের শাফা‘আতে তাদেরকে সেখান থেকে বের করবেন, তবে আমরা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির বিষয়ে নিশ্চিত মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকি। ওহীর জ্ঞান ছাড়া আমরা তার জান্নাতের সাক্ষ্য দেই না, জাহান্নামের সাক্ষ্যও দেই না। কারণ প্রকৃত বিষয় তো গুপ্ত রয়েছে। কে কিভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং মৃত্যুর সময় তার কি অবস্থা ছিল তা আমরা কেউ জানি না। তবে আমরা নেককার বা ইহসান অর্জনকারীদের সম্পর্কে ভাল আশা করি এবং পাপীদের বিষয়ে ভয় পোষণ করি।’’[8]

[1] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালাহ ৮/৯৩।
[2] সা’দ উদ্দীন তাফতাযানী, শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, পৃ: ২২।
[3] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১০৯-১১৬।
[4] আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৮-১৯।
[5] আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৪।
[6] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩২৫-৩৩০।
[7] আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৫-১৬।
[8] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩৭৮।