৬. ৪. ৬. আল্লাহর বিশেষণ: বিশ্বাস, অবিশ্বাস ও ব্যাখ্যা

ইফতিরাকের অন্যতম বিষয় ছিল মহান আল্লাহর সিফাত বা কর্ম ও বিশেষণ। প্রাচীন কাল থেকেই মহান আল্লাহর অস্তিত্ব এবং স্রষ্টা ও প্রতিপালক হিসেবে তাঁর একত্ব বা তাওহীদের বিষয়ে অধিকাংশ ধর্ম, সম্প্রদায় ও মানবগোষ্ঠী প্রায় একমত। প্রায় সকলেই স্বীকার ও বিশ্বাস করেছেন যে, অনাদি-অনন্ত সত্তা হিসেবে আল্লাহই একমাত্র সত্তা এবং এ বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহ। কিন্তু তাঁর সত্তার প্রকৃতি, তাঁর কর্ম, তাঁর বিশেষণ ইত্যাদি বিষয়ে অগণিত মতভেদ ও বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে।

এ সকল মতের অনুসারীগণ স্বীকার করেছেন যে, মানুষ তার মানবীয় জ্ঞান, বিবেক, প্রজ্ঞা, দর্শন ও যুক্তি দিয়ে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে। মানুষ বুঝতে পারে যে, নিখুত ও বৈজ্ঞানিক নিয়মে সৃষ্ট, পরিচালিত, পরিবর্তিত ও ক্ষয়শীল এ বিশ্বের একজন মহাজ্ঞানী, বৈজ্ঞানিক মহাক্ষমতাশীল স্রষ্টা আছেন। মানুষ এও বুঝতে পারে যে, স্রষ্টার প্রকৃতি, স্বরূপ, কর্ম, বিশেষণ মানবীয় ইন্দ্রিয়ের অগম্য, কারণ মানুষ যা কোনোভাবে ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেনি বা যার তুলনীয় কিছুই তার ইন্দ্রিয় বা কল্পনার মধ্যে প্রবেশ করে নি তা সে ইন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞান বা কল্পনায় ধারণ করতে পারে না। এরপরও মহান স্রষ্টার প্রকৃতি, কর্ম ও বিশেষণাদি সম্পর্কে মানুষ দর্শন, কল্পনা ও যুক্তি দিয়ে অনেক কিছু বুঝতে চেষ্টা করেছে এবং এ বিষয়ে অনেকেই অনেক বিতর্ক ও মতামত প্রকাশ করেছে। এ সকল মতামত সবই ‘অন্ধের হস্তি দর্শন’-এর মতই। এগুলি অন্তহীন বিতর্ক জন্ম দিয়েছে কিন্তু কোনো সমাধান দিতে পারে নি। কারণ কার্ মতটি সঠিক তা ইন্দ্রিয় বা মানবীয় জ্ঞানের গম্য কোনো বিষয় দিয়ে কোনোভাবে প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই। কুরআন কারীমে আল্লাহর আসমা ও সিফাত বা নাম ও বিশেষণ সম্পর্কে মক্কার কাফিরদের এ জাতীয় কিছু বিভ্রান্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে।

ওহীর সাথে মানবীয় ‘আকল’, জ্ঞান, বিবেক ও যুক্তির সম্পর্ক ও সমন্বয় বিষয়ে ইসলামের দিক নির্দেশনা আমরা প্রথম অধ্যায়ে আকীদার উৎস প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি। মহান আল্লাহর যে সকল সিফাত বা কর্ম ও বিশেষণের কথা ওহীর মাধ্যমে জানা যায় তা মানবীয় জ্ঞান, বিবেক বা বুদ্ধির সাথে সাংঘর্ষিক নয়, অবোধ্য নয় বা অসম্ভব নয়। যেমন মহান স্রষ্টা মানুষকে তার পাপের জন্য শাস্তি দিবেন বা ক্ষমা করবেন। দুটি বিষয়ই মানবীয় বিবেক ও বুদ্ধিতে সম্ভব। তবে কোন্টি কিভাবে তিনি করবেন সে বিষয়ে মানবীয় বুদ্ধি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। একজন হয়ত বলবেন, মহান আল্লাহ দয়াময়, কাজেই তিনি তার প্রিয় সৃষ্টিকে শাস্তি দিতে পারে না, তিনি কাউকে কোনো শাস্তি দিবেন না। অন্য ব্যক্তি হয়ত বলবেন, মহান আল্লাহ ন্যায়বিচারক, তিনি যদি কোনো পাপীকে শাস্তি না দেন তবে তা তাঁর ন্যায় বিচারের মর্যাদা ক্ষুন্ন করে। তিনি কাউকে ক্ষমা করবেন না। .... মহান আল্লাহর প্রতিটি বুদ্ধিগম্য সিফাত বা কর্ম নিয়ে এরূপ বিতর্ক করা যায়। যেহেতু মহান আল্লাহর সিফাতগুলি গাইবী জগতের বিষয় সেহেতু সকল বিতর্কই অন্তহীন, চূড়ান্ত ও সুনিশ্চিত কোনো ফলাফলে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে সাহাবীগণের রীতি ও পদ্ধতি ছিল এ সকল বিষয়ে ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান সর্বান্তকরণে বিশ্বাস ও গ্রহণ করা এবং এর স্বরূপ নির্ণয়ের জন্য চেষ্টা না করা। আমরা দেখেছি যে, গাইবী বিষয়ে যুক্তি, তর্ক বা দর্শন কোনো সমাধান দিতে পারে না।

প্রথম হিজরী শতকের শেষাংশ থেকে দ্বিতীয় প্রজন্মে নও-মুসলিমদের মধ্যে এ বিষয়ক পুরাতন দার্শনিক ও ধর্মীয় বিতর্ক ও বিভ্রান্তি প্রবেশ করে। কেউ কেউ বলতে থাকে মহান আল্লাহর কোনো কর্ম বা  বিশেষণ থাকতে পারে না। কারণ তাতে অমুক বা তমুক দিক থেকে তার অনাদিত্ব নষ্ট হয় বা সৃষ্টির সাথে তার তুলনা হয়ে যায়। কেউ বা অন্য দর্শন বা যুক্তি দিয়ে তাদের এমতের বিরোধিতা করেন। প্রত্যেকে তার মতের পক্ষে ও বিরোধী মতের বিপক্ষে অনেক ‘যুক্তি’ পেশ করতে থাকে। এভাবে মহান আল্লাহর সিফাত বা বিশেষণ স্বীকার, অস্বীকার, ব্যাখ্যা, সৃষ্টির কর্ম ও বিশেষণের সাথে তুলনা ইত্যাদি নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ব্যাপক বিভক্তি ও বিভ্রান্তি জন্ম নেয়।

আমরা দেখেছি প্রথম হিজরী শতকের শেষ থেকেই ‘কাদারিয়া’ ফিরকার মানুষেরা তাকদীর অস্বীকার করার মাধ্যমে আল্লাহর ইলম বা জ্ঞান বিশেষণের অনাদিত্ব অস্বীকার করে। এ সময় থেকে কেউ কেউ মহান আল্লাহ কালাম বা কথা বলার বিশেষণ অস্বীকার করেন। কারণ কথা বলা সৃষ্টির কর্ম। মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে এ বিশেষণ আরোপ করলে তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়। কাজেই তাঁর ক্ষেত্রে এ বিশেষণ আরোপ করা যায় না। বরং আল্লাহ কথা বলেছেন মর্মে যে সকল আয়াত কুরআনে রয়েছে সেগুলির ব্যাখ্যা করতে হবে যে, তিনি এই অর্থের জ্ঞান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে প্রদান করেছেন, অথবা তিনি কিছু কথা সৃষ্টি করে উক্ত ব্যক্তিকে শুনিয়েছেন ... ইত্যাদি।

দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরুর দিকে জাহ্ম ইবনু সাফওয়ান নামক এক ব্যক্তি ভারতীয়, গ্রীক ও মিসরীয় দর্শনের ভিত্তিতে মহান আল্লাহকে সকল প্রকার সিফাত বা বিশেষণ থেকে বিমুক্ত বা ‘নির্গুণ’ বলে দাবি করে। পরবতীকালে মু‘তাযিলীগণও মহান আল্লাহর বিশেষণসমূহ অস্বীকার ও ব্যাখ্যা করে।