আমরা ইতোপূর্বে বিভিন্ন আলোচনা থেকে দেখেছি যে, কুরআনে পাপ, জুলম, কুফর ইত্যাদি শব্দ কঠিন নিন্দা ও বিভ্রান্তির অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহর বিধান অমান্যকারীদেরকে কাফির বলা হয়েছে। পাপীদের অনন্ত জাহান্নাম বাসের কথা বলা হয়েছে। এ সকল আয়াত থেকে বাহ্যত বুঝা যেতে পারে যে, পাপ, ফিস্ক, জুলম ও কুফরের একই পরিণতি, তা হলো অনন্ত জাহান্নাম বাস। এ থেকে কেউ দাবি করতে পারেন যে, কর্ম ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বাস যতই ঠিক থাক, যদি কর্মের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি দেখা দেয় তবে তা ঈমানের ঘাটতি বলে বিবেচিত হবে এবং এরূপ ব্যক্তি কাফির বলে গণ্য হবে।

পক্ষান্তরে কুরআন কারীমে বারংবার বলা হয়েছে যে, শিরক ছাড়া সকল পাপ আল্লাহ ইচ্ছা করলে ক্ষমা করেন। কঠিন কবীরা গোনাহে লিপ্ত মানুষদেরকে কুরআনে ‘মুমিন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। অগণিত সহীহ হাদীসে পাপী মুমিনের শাস্তিভোগের পরে জান্নাতে গমনের কথা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আতের কারণে কবীরা গোনাহকারী মুমিন ব্যক্তি মুক্তিলাভ করবে বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল আয়াত ও হাদীস থেকে বাহ্যত বুঝা যায় যে, আমল বা কর্মের সাথে ঈমান বা বিশ্বাস অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নয়। বিশ্বাস বা ঈমান ঠিক থাকলে কবীরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিও জান্নাতে যাবে।

সাহাবীগণ এ সকল আয়াত ও হাদীসের নির্দেশ সর্বান্তকরণে মেনে নিয়েছেন ও বিশ্বাস করেছেন। উভয় প্রকারের আয়াত ও হাদীসের মধ্যে যে কোনোরূপ বৈপরীত্য আছে সে কথা তাঁরা কখনো কল্পনা করেন নি। এ বিষয়ে তাঁরা কোনো প্রশ্নও করেন নি। কারণ উভয় অর্থের মধ্যে সরাসরি কোনো সংঘর্ষ নেই এবং উভয় অর্থই মানবিক বুদ্ধি ও জ্ঞানে গ্রহণযোগ্য। কাজেই এ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন না করে মুমিন নিজের দায়িত্ব পালন করে যাবে।

কিন্তু দ্বিতীয় প্রজন্মের কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। মুসলিম উম্মাহর বিভক্তির অন্যতম প্রশ্ন ছিল এটি। প্রাথমিক শীয়াগণের পরে মুসলিম উম্মাহর  প্রথম ফিরকা খারিজীগণ কুরআনের কিছু আয়াতের বাহ্যিক অর্থের ভিত্তিতে দাবি করে যে, মুসলিম পাপে লিপ্ত হলে সে কাফির বা ঈমান হারা হয়ে যায়। তাদের মতে ইসলামের অনুশাসন অনুসরণ করা ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই যে ব্যক্তি ইসলামের কোনো অনুশাসন লঙ্ঘন করে সে ঈমানহারা বা কাফিরে পরিণত হয়। ঈমান ও কুফরের মাঝে আর কোনো মধ্যম অবস্থা নেই। কাজেই যার ঈমানের পুর্ণতা নষ্ট হবে সে কাফিরে পরিণত হবে।[1]

আলী (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ৩৭ হিজরী সাল থেকে খারিজী বিভ্রান্তি ও বিভক্তির উন্মেষ ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়। পরবর্তীকালে মুতাযিলাগণও খারিজীদের অনুরূপ মত গ্রহণ করে।

এর বিপরীতে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়, তারা দাবি করে যে, ঈমান ও ইসলাম সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়। ঈমান বা বিশ্বাস যদি ঠিক থাকে তাহলে কোনো গোনাহের কারণেই কোনো অসুবিধা হবে না। ইসলামের অনুশাসন মানুক অথবা নাই মানুক, সকল মুমিনই সরাসরি জান্নাতী হবে।

[1] বাগদাদী, আব্দুল কাহির ইবনু তাহির, আল-ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ. ৭২-৭৪; ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩১৬-৩২৫; ড. আহমদ, দিরাসাতুন আনিল ফিরাক, পৃ. ৬৩-৬৫; ড. নাসির আল-আকল, আল-খাওয়ারিজ, পৃ. ২০, ৪২।