আমরা দেখেছি যে, আভিধানিক অর্থে বিদ‘আত অর্থ খারাপ কিছু নয়; নব-উদ্ভাবিত বিষয় ভাল বা খারপ হতে পারে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ধর্মের বিষয়ে নব-উদ্ভাবন বা বিদ‘আত নিন্দনীয় বলে জানিয়েছেন।

আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে মানবীয় বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞানের মাধ্যমেই মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। কিন্তু শুধু মানবীয় জ্ঞানের উপর নির্ভর করে মহান স্রষ্টার কর্ম ও বিশেষণের প্রকৃতি, তাঁর সন্তুষ্টির পথ, তাঁর ইবাদতের পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এজন্য এ সকল বিষয়ে ওহীর উপর নির্ভর করতে হয়। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেন এবং তাঁদেরকে কিতাব প্রদান করেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ওহীর বাইরে কোনো ধর্মীয় মতামত তৈরি করা, ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান বা কর্ম উদ্ভাবন করা ধার্মিক মানুষের জন্য শয়তানের প্রবঞ্চনার দরজা খুলে দেয়। এজন্য বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতকে বিদ‘আত থেকে সতর্ক করেছেন।

ইতোপূর্বে একাধিক হাদীসে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদ‘আতকে সুন্নাতের বিপরীতে উল্লেখ করেছেন এবং তা ধ্বংসের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। এ অর্থে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ)-এর হাদীসে দেখেছি যে, আব্দুল্লাহ (রাঃ) দুটি নেককর্মে পদ্ধতিগতভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যতিক্রম করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ আদায় করতেন এবং মাসের কিছু দিনে সিয়াম পালন করতেন, পক্ষান্তরে আব্দুল্লাহ সারারাত তাহাজ্জুদ আদায় এবং সারামাস নফল সিয়াম আদায় করতেন। বিষয়টির প্রতি আপত্তি প্রকাশ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে অপছন্দ করল আমার সাথে তার সম্পর্ক থাকবে না।...  এরপর তিনি বলেন : প্রত্যেক আবেদের কর্মের উদ্দীপনার জোয়ার ভাটা আছে। ইবাদতের উদ্দীপনা কখনো তীব্র হয় আবার এই তীব্রতা এক সময় থেমে যায়, কখনো সুন্নাতের দিকে, কখনো বিদ‘আতের দিকে। যার প্রশান্তি সুন্নাতের প্রতি হবে সে হেদায়েত প্রাপ্ত হবে। আর যার প্রশান্তি অন্য কিছুর দিকে হবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।’’

এখানে আমরা কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করছি:

(১) তাহাজ্জুদ ও নফল সিয়াম ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। বিভিন্ন হাদীসে এ ইবাদত বেশি বেশি পালন করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ সকল হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, এ ইবাদত যত বেশি পালন করা যাবে তত বেশি সাওয়াব হবে। কাজেই অর্ধেক রাতের চেয়ে সারারাত তাহাজ্জুদে সাওয়াব বেশি হওয়ার কথা। অনুরূপভাবে মাসের কয়েকদিন সিয়াম পালনের চেয়ে পুরো মাস সিয়াম পালনে বেশি সাওয়াব হওয়ার কথা।

(২) সারারাত তাহাজ্জুদ বা নিষিদ্ধ দিনগুলি বাদ দিয়ে সারা মাস সিয়াম পালন মূলত নিষিদ্ধ নয়। তবে তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদ্ধতির বাইরে।

(৩) এরূপ করাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সুন্নাত বা পদ্ধতি অপছন্দ করার নামান্তর বলে বারংবার উল্লেখ করেছেন।

(৪) তিনি আরো বলেছেন যে, কোনো আবিদ যদি কর্মের উদ্দীপনায় সাময়িকভাবে অতিরিক্ত কিছু করে তবে তা ধ্বংসাত্মক নয়। তবে তার স্থিতি যদি সুন্নাতের ব্যতিক্রম হয় তবে তা ধ্বংসাত্মক হবে।

(৫) তিনি তাঁর সুন্নাতের ব্যতিক্রম ইবাদতকে বিদ‘আত বলেছেন।

অন্যান্য অনেক হাদীসে এভাবে বিদ‘আতকে সুন্নাতের বিপরীতে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ‘নব-উদ্ভাবন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে আকীদার বিষয়ে সাহাবীগণের মতামত ও ব্যাখ্যার গুরুত্ব আলোচনাকালে এ অর্থের অন্য হাদীসে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ(ﷺ)  বলেছেন: ‘‘আমার পরে তোমরা যারা বেঁচে থাকবে তাঁরা অনেক মতবিরোধ ও দলাদলি দেখতে পাবে। কাজেই তোমার দৃঢ়ভাবে আমার সুন্নাত এবং আমার পরের খুলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নাত আঁকড়ে ধরে থাকবে, অনুসরণ করবে। আর খবরদার! নব উদ্ভাবিত কর্মাদি থেকে সাবধান থাকবে; কারণ সকল নব উদ্ভাবিত বিষয়ই ‘‘বিদ‘আত’’ এবং সকল ‘‘বিদ‘আত’’-ই পথভ্রষ্ঠতা বা গোমরাহী।’’

অন্য হাদীসে জাবির (রাঃ) বলেন,  নবী করীম (ﷺ) বলেছেন :

إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ وَكُلُّ ضَلالَةٍ فِي النَّارِ.

‘‘সত্যতম বাণী আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম আদর্শ মুহম্মদের (ﷺ) আদর্শ, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো নতুন উদ্ভাবিত বিষয়, প্রতিটি নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ই ‘‘বিদ‘আত’’ আর প্রতিটি ‘‘বিদ‘আত’’-ই পথভ্রষ্ঠতা এবং সকল পথভ্রষ্ঠতা জাহান্নামের মধ্যে।’’[1]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

إِنَّمَا هُمَا اثْنَتَانِ الْكَلامُ وَالْهَدْيُ فَأَحْسَنُ الْكَلامِ كَلامُ اللَّهِ وَأَحْسَنُ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ أَلا وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدِثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ شَرَّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلالَةٌ

‘‘বিষয় শুধুমাত্র দুটি : বাণী ও আদর্শ। সর্বোত্তম বাণী হলো আল্লাহর বাণী এবং সর্বোত্তম আদর্শ ও পথ হলো মুহম্মদ (ﷺ) -এর আদর্শ ও পথ। সাবধান! তোমরা নব উদ্ভাবিত বিষয়াবলী থেকে সতর্ক ও সাবধান থাকবে; কারণ সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো নবউদ্ভাবিত বিষয়। আর সকল নবউদ্ভাবিত বিষয়ই ‘‘বিদ‘আত’’ এবং সকল ‘‘বিদ‘আত’’ই বিভ্রান্তি বা পথভ্রষ্টতা।’’[2]

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ

‘‘আমাদের (রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর যুগের মুসলমানদের: সাহাবীদের) এ কাজের (ধর্মীয় কর্মকান্ডের) মধ্যে যে নতুন কোনো বিষয় উদ্ভাবন করবে তার নতুন উদ্ভাবিত কাজটি প্রত্যাখ্যান করা হবে।’’

সহীহ মুসলিমের দ্বিতীয় বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

مَنْ عَمِلَ عَمَلا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ

‘‘আমাদের কর্ম যা নয় এমন কোনো কর্ম যদি কোনো মানুষ করে তাহলে তার কর্ম প্রত্যাখ্যাত হবে (আল্লাহর নিকট কবুল হবে না)।’’[3]

তাবেয়ী হাসান বসরী (রাহ.) বলেন : রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন :

عَمَلٌ قَلِيْلٌ فِيْ سُنَّةٍ خَيْرٌ مِنْ عَمَلٍ كَثِيْرٍ فِيْ بِدْعَةٍ وَمَنِ اسْتَنَّ بِيْ فَهُوَ مِنِّيْ وَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ

‘‘সুন্নাতের মধ্যে অল্প আমল করা বিদ‘আতের মধ্যে অনেক আমল করার চেয়ে উত্তম। যে আমার পদ্ধতির অনুসরণ করবে সে আমার উম্মত, আমার সাথে সম্পর্কিত। আর যে আমার পদ্ধতি (সুন্নাত) অপছন্দ করবে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’’[4]

বিদ‘আত বিষয়ক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসগুলি পর্যালোচনা করলে আমরা নিম্নের বিষয়গুলি দেখতে পাই:

(১) আভিধানিকভাবে সকল নতুন উদ্ভাবিত বিষয়কেই বিদ‘আত বলা হয়, তবে হাদীসে নববীতে ‘আমাদের কর্মের মধ্যে’ বা ‘দীনের মধ্যে’ ‘নব উদ্ভাবিত বিষয়’-কে বিদ‘আত বলা হয়েছে।

(২) বিদ‘আতকে ‘সুন্নাতের’ বিপরীতে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাকওয়া, আল্লাহর ভয় ও ইবাদতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতকেই সর্বোচ্চ আদর্শ বলে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যতিক্রম বা অতিরিক্ত কোনো মত, কথা, কর্ম বা রীতিকে তাকওয়া, বুজুর্গী বা ইবাদত বলে গণ্য করাই বিদ‘আত।

(৩) বিদ‘আত মূলত বর্জনের সুন্নাতের সাথেই সংশ্লিষ্ট। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা করেন নি বা বলেন নি, অর্থাৎ তিনি যা করা বা বলা বর্জন করেছেন তা ইবাদতের উদ্দীপনায় করা বা বলা বা তাকে ইবাদত, কামালাত বা বুজুর্গি মনে করাকে বিদ‘আত বলা হয়েছে।

(৪) ইবাদতের উদ্দীপনাতেই বিদ‘আতের উৎপত্তি। ইবাদতের উদ্দীপনায় নেককার ব্যক্তি ইবাদতের ক্ষেত্রে কোনো পদ্ধতি, প্রকার বা রীতিতে সুন্নাতের ব্যতিক্রম করলে তা বিদ‘আতে পরিণত হয়।

(৫) কবুলিয়্যাত বা সাওয়াবের আশাতেই বিদ‘আত করা হয়, এজন্য বিদ‘আত কবুল হবে না বলে বারংবার হাদীসে বলা হয়েছে এবং বিদ‘আত পদ্ধতিতে বেশি ইবাদতের চেয়ে সুন্নাত পদ্ধতিতে অল্প ইবাদত বেশি গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

(৬) আভিধানিকভাবে বিদ‘আত নিন্দনীয় নয়, বরং তা ভাল বা মন্দ হতে পারে। তবে হাদীসে নববীতে বিদ‘আত সর্বদা নিন্দনীয় এবং সকল বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা। এর কারণ যেখানে অপূর্ণতা আছে সেখানে নতুনত্ব প্রশংসনীয়। আর যেখানে পরিপূর্ণ পূর্ণতা বিদ্যমান সেখানে পূর্ণতার অতিরিক্ত কোনো সংযোজনীর প্রয়োজন আছে মনে করার অর্থই পূর্ণকে অপূর্ণ মনে করা।

[1] নাসাঈ, আস-সুনান ৩/১৮৮। মূল হাদীসটি সহীহ মুসলিমে ২/৫৯২-৫৯৩ রয়েছে।
[2] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১৮।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ২/৯৫৯; মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৩৪৩।
[4] আব্দুর রাজ্জাক সানআনী, আল-মুসানণাফ ১১/২৯১, নং ২০৫৬৮। হাসান বসরী পর্যন্ত হাদীসটির সনদ মুরসালরূপে সহীহ। এ ছাড়া বিভিনণ সনদের আলোকে মুত্তাসিল হিসাবে হাদীসটি গ্রহণযোগ্য। দেখুন: শাতেবী, আল-ইতিসাম ১/১০৮।