৫. ৬. ২. ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলার নিষেধাজ্ঞা

ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতকে সতর্ক করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

إِذَا كَفَّرَ الرَّجُلُ أَخَاهُ فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا (إِنْ كَانَ كَمَا قَالَ وَإِلا رَجَعَتْ عَلَيْهِ)

‘‘যদি কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে কাফির বলে, তবে এ কথা দু জনের একজনরে উপর প্রযোজ্য হবে। যদি তার ভাই সত্যিই কাফির না হয় তবে যে তাকে কাফির বলল তার উপরেই কুফরী প্রযোজ্য হবে।’’[1]

অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

إِذَا قَالَ الرَّجُلُ لأَخِيهِ يَا كَافِرُ فَقَدْ بَاءَ بِهِ أَحَدُهُمَا

‘‘যদি কেউ তার ভাইকে বলে, হে কাফির, তবে তাদের দুজনের একজনের উপর এই কফরীর দায়ভার বর্তাবে।’’[2]

আবূ যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

مَنْ دَعَا رَجُلا بِالْكُفْرِ أَوْ قَالَ عَدُوَّ اللَّهِ وَلَيْسَ كَذَلِكَ إِلا حَارَ عَلَيْهِ

‘‘যদি কেউ কোনো মানুষকে কুফরীর সাথে জড়িত করে আহবান করে অথবা তাকে বলে ‘হে আল্লহর শত্রু’ আর সে তা না হয়, তবে তা বক্তার উপর বর্তাবে।’’[3]

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

مَا أَكْفَرَ رَجُلٌ رَجُلاً إِلاَّ بَاءَ أَحَدُهُمَا بِهَا إِنْ كَانَ كَافِراً وَإِلاَّ كُفِّرَ بِتَكْفِيْرِهِ

‘‘যে কোনো মানুষ যদি অন্য কাউকে কাফির বলে গণ্য করে তবে দুজনের একজনের উপর তা বর্তাবে। যদি সে কাফির হয় তবে ভাল, নইলে তাকে কাফির ঘোষণা করার কারণে কাফির ঘোষণাকারীই কাফির হয়ে যাবে।’’[4]

সাবিত ইবনু দাহহাক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

مَنْ رَمَى مُؤْمِنًا بِكُفْرٍ فَهُوَ كَقَتْلِهِ

‘‘যদি কেউ কোনো মুমিনকে কুফরীতে অভিযুক্ত করে তবে তা তাকে হত্যা করার মতই অপরাধ হবে।’’[5]

এই অর্থে অন্যান্য সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। একই অর্থে ৮/১০ জন সাহাবী থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে হাদীস বর্ণিত হওয়া প্রমাণ করে যে, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রায়শঃই তাঁর সাহাবীগণকে সতর্ক করতেন।

মক্কা বিজয়ের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীগণকে যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু কোন্ দিকে রাওয়ানা দিবেন বা কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালন করবেন তা কিছুই বলেন না। তার উদ্দেশ্য ছিল যথাসম্ভব কম রক্তপাতে পবিত্র মক্কা বিজয় সম্পন্ন করা। সাহাবী হাতিব ইবনু আবী বালতা‘আ বুঝতে পারেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কা অভিমুখে রাওয়ানা দিবেন। তিনি মক্কার কাফিরদেরকে এ বিষয়ে সংবাদ দিয়ে চিঠি লিখেন। এ বিষয়ে আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমি, যুবাইর ও মিকদাদ-তিনজনকে বললেন, দ্রুত রাওদা খাখ-এ চলে যাও। সেখানে একজন মহিলা যাত্রী পাবে। তার কাছে একটি পত্র আছে। তোমরা পত্রটি নিয়ে আসবে। আমরা তথায় যেয়ে মহিলাকে পেলাম। তাকে বললাম চিঠিটি দাও। সে বলল, আমার কাছে কোনো চিঠি নেই। আমরা বললাম, তুমি যদি চিঠিটি না দাও তবে আমরা তোমাকে উলঙ্গ করে তল্লাশী করব। তখন মেয়েটি তার খোপার ভিতর থেকে চিঠিটি বের করে দিল। চিঠিটি ছিল হাতিবের পক্ষ থেকে মক্কার কাফিরদেরেক লিখা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, হাতিব, এ কী? হাতিব বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি একটু ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনুন। আমি কুরাইশ বংশের লোক নই, তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মক্কায় ছিলাম। মক্কা থেকে হিজরত করে আসলেও আমার পরিজন তথায় বাস করছে। আপনার কুরাইশ সাহাবীগণের কাফির আত্মীয়স্বজনেরা তাদের ধনসম্পদ ও পরিজনদের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। কিন্তু আমার কেউ নেই। আমি চেয়েছিলাম এই খবর প্রদানের মাধ্যমে মক্কার কাফিরদের একটু উপকার করতে, যেন তারা আমার পরিবারের দিকে লক্ষ্য রাখে। আমি কুফরীর কারণে, ধর্মত্যাগ করতে বা কাফিরদের কুফরীতে সন্তুষ্টির কারণে আমি এ কাজ করিনি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, হাতিব তোমাদেরকে সত্য কথাই বলেছে। তখন উমার (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিককে হত্যা করি। তিনি বলেন, হাতিব বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আর সম্ভবত আল্লাহ বদরবাসীদের প্রতি দষ্টিপাত করে বলেছেন, তোমরা যা চাও কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছি।’’[6]

এখানে হাতিবের কাজ বাহ্যত ইসলামের বিরুদ্ধে কাফিরদের বিজয়ের জন্য ইসলাম ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে বিশ্বাঘাতকতা এবং কুফর। এজন্যই উমার তাকে মুনাফিক বলেছেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত না দিয়ে তার কাছে এ কাজের ব্যাখ্যা চেয়েছেন এবং তার ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন।

অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

أَسْرَفَ رَجُلٌ عَلَى نَفْسِهِ فَلَمَّا حَضَرَهُ الْمَوْتُ أَوْصَى بَنِيهِ فَقَالَ إِذَا أَنَا مُتُّ فَأَحْرِقُونِي ثُمَّ اسْحَقُونِي ثُمَّ اذْرُونِي فِي الرِّيحِ فِي الْبَحْرِ فَوَاللَّهِ لَئِنْ قَدَرَ عَلَيَّ رَبِّي لَيُعَذِّبُنِي عَذَابًا مَا عَذَّبَهُ بِهِ أَحَدًا قَالَ فَفَعَلُوا ذَلِكَ بِهِ فَقَالَ لِلأَرْضِ أَدِّي مَا أَخَذْتِ فَإِذَا هُوَ قَائِمٌ فَقَالَ لَهُ مَا حَمَلَكَ عَلَى مَا صَنَعْتَ فَقَالَ خَشْيَتُكَ يَا رَبِّ أَوْ قَالَ مَخَافَتُكَ فَغَفَرَ لَهُ بِذَلِكَ

‘‘একব্যক্তি জীবনভর সীমালঙ্ঘন ও পাপে লিপ্ত থাকে। যখন তার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয় তখন সে তার পুত্রদেরকে ওসিয়ত করে বলে: আমার মৃত্যু হলে তোমরা আমাকে আগুনে পুড়াবে। এরপর আমাকে বিচুর্ণ করবে। এরপর ঝড়ের মধ্যে আমাকে (আমার দেহের বিচুর্ণিত ছাই) সমূদ্রের মধ্যে ছাড়িয়ে দেবে। কারণ, আল্লাহর কসম, যদি আমার প্রতিপালক আমাকে ধরতে সক্ষম হন তবে আমাকে এমন শাস্তি দিবেন যে শাস্তি তিনি অন্য কাউকে দেন নি। তার সন্তানগণ তার ওসিয়ত অনুসারে কর্ম করে। তখন আল্লাহ যমিনকে নির্দেশ দেন যে যা গ্রহণ করেছে তা ফেরত দিতে। তৎক্ষণাৎ লোকটি পুনর্জীবিত হয়ে তার সামনে দন্ডায়মান হয়ে যায়। তখন তিনি লোকটিকে বলেন: তুমি এরূপ করলে কেন? লোকটি বলে: হে আমার প্রতিপালক: আপনার ভয়ে। তখন তিনি তাকে এজন্য ক্ষমা করে দেন।’’[7]

এখানে আমরা দেখি যে, এ ব্যক্তি একটি কুফরী বিশ্বাস পোষণ করেছে। সে ধারণা করেছে যে, তার দেহ এভাবে পুড়িয়ে ছাই করে সমূদ্রে ছাড়িয়ে দিলে মহান আল্লাহ তাকে আর পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন না এবং শাস্তিও দিতে পারবেন না। বাহ্যত তার এরূপ ধারণা ছিল অজ্ঞতা প্রসূত। এজন্য তার মধ্যে বিদ্যমান নির্ভেজাল আল্লাহ-ভীতির কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। এভাবে আমরা দেখি যে, একটি বিশ্বাস সুনিশ্চিত কুফরী হলেও উক্ত বিশ্বাসে লিপ্ত ব্যক্তি কাফির বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

[1] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২২৬৩-২২৬৪; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৭৯।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২২৬৪।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৭৯।
[4] ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১/৪৮৩।
[5] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২২৪৭, ২২৬৪।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১০৯৫; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৪১।
[7] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৮৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২১১০।