তাওয়াক্কুল-এর সাথে সম্পৃক্ত ইবাদত আশা ও ভয়। তাওয়াক্কুলের ন্যায় ভয়-ভীতি বা আশা-ভরসা দুই প্রকারের: প্রাকৃতিক  বা বৈষয়িক ও অতিপ্রাকৃতিক বা অলৌকিক। সাধারণ প্রাকৃতিক ভয়-ভীতি বা আশা-ভরসার সৃষ্টি হয় দুনিয়ার জীবনের বিভিন্ন বস্ত্তগত ও বৈষয়িক কারণে। আমরা হিংস্র বা বিষাক্ত জীব, ধারাল অস্ত্র, জালিম মানুষ ইত্যাদি দেখলে ভয় পাই। পার্থিব জীবনে একে অপরের বিভিন্ন ধরণের উপকারর আশা করি। এ ধরণের পার্থিব ও বৈষযিক ভয়-ভীতি বা আশা-ভরসা মানুষ ও মানবেতর জীব জানোয়ারের মধ্যে বিরাজমান এবং তা ইবাদতের মধ্যে গণ্য নয়। এরূপ ভয় বা আশা কোনো ‘বিশ্বাসের’ সাথে সম্পৃক্ত নয়, বরং ‘মানবীয় প্রকৃতির’ সাথে সম্পৃক্ত। নাস্তিক, আস্তিক, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী সকলেই এরূপ ভয় ও আশা করেন।

পক্ষান্তরে মানুষ যখন কোন ব্যক্তি, সত্তা বা শক্তিকে ‘চূড়ান্ত বা অলৌকিকভাবে ভক্তি করে’ অর্থাৎ ইবাদত করে, স্বাভাবিক মানবীয় বা প্রাকৃতিক শক্তির ঊর্ধ্বে তাকে শক্তিমান বলে বিশ্বাস করে, অর্থাৎ বিশ্বাস করে যে, তিনি অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী, তিনি ইচ্ছা করলেই জাগতিক উপকরণ ছাড়াই অলৌকিকভাবে কল্যাণ বা অকল্যাণ, উপকার বা ক্ষতি করতে পারেন, তখন ঐ মানুষের মনে ঐ ব্যক্তি, সত্তা বা শক্তির প্রতি ভয় ও আশার সঞ্চার হয়। এরূপ ভয় বা আশার ভিত্তি ‘বিশ্বাস’। যে যাকে অলৌকিক শক্তিময় বলে বিশ্বাস করেন তাকেই এরূপ ভয় করেন বা তার অলৌকিক সাহায্যের আশা করেন। এজন্যই একজন মানুষ একটি মাটির ঢিলার মতই বিনা দ্বিধায় একটি মুর্তি, কবর বা উপাসনালয় একজন ভেঙ্গে ফেলতে পারেন, পক্ষান্তরে অন্য একজন মানুষ উক্ত মুর্তি, কবর বা উপাসনালয়ে প্রতি সামান্যতম অভক্তির কথা কল্পনা করতেও ভয় পান।

এই অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতিক ভয়-ভীতি ও আশা-ভরসা ইবাদত বলে গণ্য, যা একমাত্র আল্লাহর নিমিত্ত নির্ধানিত। মহান আল্লাহ বলেন:

وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ

এবং তোমরা কেবলমাত্র আমাকেই ভয় কর।’’[1]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:

وَيَدْعُونَنَا رَغَبًا وَرَهَبًا وَكَانُوا لَنَا خَاشِعِينَ

‘‘তারা আমাকে ডাকত আশা ও ভীতির সাথে এবং তারা ছিল আমার নিকট বিনীত।’’[2]

কোনো মানুষ যদি মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে এরূপ ভয় করে বা অন্য কারো মধ্যে কোনোরূপ অলৌকিক বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা, মঙ্গল-অমঙ্গল করা বা তা রোধ করার অলৌকিক ও অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অথিকারী মনে করে কাউকে ভয় করে তবে তবে তা শিরক হবে। কিন্তু জাগতিক বা পার্থিব ভয় করলে তা শিরক হবে না। আল্লাহ বলেন:

وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَاهُ

‘‘তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছ আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন; তুমি মানুষদেরকে ভয় করছ, অথচ আল্লাকেই ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সংগত।’’[3]

কেউই কল্পনা করবেন না যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মানুষকে ভয় করে শিরকে লিপ্ত হয়েছিলেন। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:  

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ قِيلَ لَهُمْ كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَخْشَوْنَ النَّاسَ كَخَشْيَةِ اللَّهِ أَوْ أَشَدَّ خَشْيَةً

‘‘তুমি কি তাদেরকে দেখ নি যাদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর, সালাত কায়েম কর এবং যাকাত দাও? অতঃপর যখন তাদেরকে যুদ্ধের বিধান দেওয়া হল তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করছিল আল্লাহকে ভয় করার মত অথবা তদপেক্ষা অধিক।’’[4]

এখানে কেউই বলবেন না যে, সাহাবীগণ মানুষদেরকে আল্লাহর মত বা তার চেয়েও বেশি ভয় করে শিরকে নিপতিত হয়েছিলেন। কারণ, তাদের ভয় ছিল মানবীয়, মানুষদেরকে তারা আল্লাহর মত ক্ষমতার অধিকারী মনে করে ভয় পান নি।

মানুষ প্রাকৃতিকভাবে মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টিকে ভয় পায়। এতে শিরক হয় না। এমনকি মানুষের ভয়ে বা প্রাণ বাঁচানোর জন্য আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা করাকেও কেউ শিরক বলবেন না। সর্বোপরি মানুষের ভয়ে জীবন বাঁচাতে সুস্পষ্ট শিরক করলেও তাকে শিরক বলে গণ্য করা হবে না। জাগতিক উপকরণাদি ছাড়া ইচ্ছা করলেই অলৌকিকভাবে অমঙ্গল করার ক্ষমতা আছে বলে কাউকে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতিক ভয় করা ইবাদত।

[1] সূরা বাকারা: ৪০ আয়াত ও নাহল: ৫১ আয়াত।
[2] সূরা (২১) আম্বিয়া: ৯০ আয়াত।
[3] সূরা আহযাব, ৩৭ আয়াত।
[4] সূরা নিসা, ৭৭ আয়াত।