৫. ১. ৫. নিফাক: পরিচিতি ও প্রকারভেদ

আরবীতে ‘নিফাক’ শব্দের অর্থ কপটতা (hypocrisy)। শব্দটির মূল অর্থ খরচ করা, চালু করা, গোপন করা, অস্পষ্ট করা ইত্যাদি।[1] নিফাকে লিপ্ত মানুষকে ‘মুনাফিক’ বলা হয়। ইসলামী পরিভাষায় নিফাক দুই প্রকার: (১) বিশ্বাসের নিফাক ও (২) কর্মের নিফাক।

৫. ১. ৫. ১. বিশ্বাসের নিফাক (النفاق الاعتقادي)

অন্তরের মধ্যে অবিশ্বাস গোপন রেখে মুখে বিশ্বাসের প্রকাশকে বিশ্বাসের নিফাক বা নিফাক ই’তিকাদী বলা হয়। এরূপ নিফাকের স্বরূপ নিম্নরূপ: (১) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সকল শিক্ষা বা দাও‘আত বা তাঁর শিক্ষার কোনো দিককে মিথ্যা বলে মনে করা, (২) তাঁকে ঘৃণা করা বা তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা (৩) তাঁর কোনো শিক্ষাকে ঘৃণা করা, (৪) তাঁর দীনের অবমাননায় আনন্দিত হওয়া অথবা (৫) তাঁর দীনের সাহায্য করতে অপছন্দ করা। মূলত কুরআন-হাদীসে এরূপ নিফাকের কথাই বলা হয়েছে। এরূপ নিফাক কুফরেরই একটি প্রকার; কারণ এরূপ নিফাকে লিপ্ত ব্যক্তির অন্তরে অন্যান্য কাফিরের মতই অবিশ্বাস বিদ্যমান, যদিও সে জাগতিক স্বার্থে মুখে ঈমানের দাবি করে। এদের বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:

ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا فَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لا يَفْقَهُونَ

‘‘তা এ জন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে, ফলে তাদের হৃদয়ে মোহর করে দেওয়া হয়েছে, পরিণামে তারা বোধশক্তি হরিয়ে ফেলেছে।’’[2]

৫. ১. ৫. ২. কর্মের নিফাক (النفاق العملي)

আমরা জানি যে, বিশ্বাসই মানুষের কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাহ্যিক কর্ম মানুষের আভ্যন্তরীন বিশ্বাসের প্রতিফলন। যার অন্তরে বিশ্বাস নেই কিন্তু বাইরে বিশ্বাস দাবি করে স্বভাবতই তার অন্তরের অবিশ্বাস তার কর্মে প্রকাশিত হয়, যেগুলি প্রমাণ করে যে, সে ঈমান ও তাকওয়ার দাবি করলেও বস্ত্তত তার মধ্যে ঈমান ও তাকওয়া অনুপস্থিত। হাদীস শরীফে এ জাতীয় কিছু কর্মের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনু আম্র (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ

‘‘চারটি বিষয় যার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে সে নির্ভেজাল মুনাফিক। আর যার মধ্যে এগুলির মধ্য থেকে কোনো একটি স্বভাব বিদ্যমান থাকবে তার মধ্যে নিফাক বা কপটতার একটি দিক বিদ্যমান থাকবে, যতক্ষণ না সে তা পরিত্যাগ করে: (১) যখন তার কাছে কিছু আমানত রাখা হয় সে তা খিয়ানত করে, (২) যখন সে কথা বলে তখন মিথ্যা বলে, (৩) যখন সে চুক্তি বা প্রতিজ্ঞা-বদ্ধ হয় তখন তা ভঙ্গ করে এবং (৪) যখন সে ঝগড়া করে তখন সে অশ্লীল কথা বলে।’’[3]

এ সকল কর্ম বাহ্যত অন্তরে বিশ্বাসের অনুপস্থিতি প্রমাণ করে। তবে যদি অন্তরে প্রকৃত অবিশ্বাস না থাকে তবে এ সকল কর্ম ‘কুফর’ বা অবিশ্বাসের নিফাক বলে গণ্য হবে না। বরং কুফর আসগারের ন্যায় নিফাক আমালী বা কর্মের নিফাক বলে গণ্য হবে।

৫. ১. ৬. কুফর আস্গার বা ক্ষুদ্রতর অবিশ্বাস

কুফর মূলত হৃদয়ের অবিশ্বাসের নাম, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মের নাম নয়। এজন্য কুরআন ও হাদীসে যে সকল ‘পাপ কর্ম’-কে কুফর বলা হয়েছে কিন্তু যেগুলির সাথে হৃদয়ের অবিশ্বাস জড়িত নয় সেগুলিকে ‘কুফর আসগার’ বা ‘কুফরুন নি’মাহ (كفر النعمة) অর্থাৎ নিয়ামতের অস্বীকার বা কুফর মাজাযী (الكفر المجازي) বা রূপকার্থে কুফর বলে অভিহিত করা হয়।[4]

কুরআনে অবিশ্বাসের পাশাপাশি অকৃতজ্ঞতাকেও কুফর বলা হয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ বলেন:

وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلا قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ

‘‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিত, যেথায় আসত সর্বদিক থেকে তার প্রচুর রিয্ক, অতঃপর তা আল্লাহর নিয়ামতের কুফ্রী করল, ফলে তারা যা করত তজ্জন্য আল্লাহ তাদেরকে আস্বাদ গ্রহণ করালেন ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছদনের।’’[5]

এছাড়া আমরা বুঝতে পারি যে, প্রকৃত ও পরিপূর্ণ ঈমানের সাথে পাপ ও অবাধ্যতার সহ-অবস্থান না হওয়াই ঈমানের দাবি। বস্ত্তত বিশ্বাসের ঘাটতি ছাড়া কেউ পাপে লিপ্ত হতে পারে না। আল্লাহর প্রতি, তাঁর সিফাতসমূহের প্রতি, আখিরাতের প্রতি ও আখিরাতের শাস্তি ও পুরস্কারের প্রতি বিশ্বাস পরিপূর্ণ থাকলে কেউ পাপে লিপ্ত হতে পারে না। এজন্য পাপে লিপ্ত হওয়া বিশ্বাসের ঘাটতি বা অপূর্ণতা নির্দেশ করে। তবে যতক্ষণ এরূপ অপূর্ণতা পূর্ণ অবিশ্বাসে পরিণত না হয় ততক্ষণ একে ‘কুফর্ আসগার’ বা কুফর মাজাযী (রূপক কুফর) বলে অভিহিত করা হয়।

কুরআন ও হাদীসে অনেক কঠিন পাপকে কুফর বলে অভিহিত করা হয়েছে, আবার অন্যত্র এ সকল ‘কুফ্রী'তে লিপ্ত মানুষদেরকে মুমিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল আয়াত ও হাদীসের সমন্বয়ে সাহাবীগণ ও পরবর্তী যুগের আলিমগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, এ সকল অপরাধ ‘কুফর আসগার’ বা ক্ষুদ্রতর কুফর বলে গণ্য। এগুলি কঠিন পাপ, তবে যদি কেউ এগুলিকে পাপ ও নিষিদ্ধ জেনে, নিজেকে অপরাধী বলে বিশ্বাস করে শয়তানের প্ররোচনায় বা জাগতিক কোনো স্বার্থে এরূপ পাপে লিপ্ত হয় তবে সে পাপী মুমিন বলে গণ্য হবে, ইসলাম ত্যাগকারী বা পারিভাষিক কাফির বলে গণ্য হবে না। পক্ষান্তরে যদি কেউ এরূপ কর্ম বৈধ মনে করে, অথবা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করা ঐচ্ছিক মনে করে, বা আল্লাহর এ সকল নির্দেশ বা যে কোনো নির্দেশ মান্য করা তার নিজের জন্য বা অন্য কারো জন্য বা কোনো যুগের জন্য অনাবশ্যক বা অপ্রয়োজনীয় মনে করে বা অন্য কোনো ধর্মের বা সমাজের বিধান অধিকতর উপযোগী বলে মনে করে তবে সে ধর্মত্যাগী ও কাফির বলে গণ্য হবে।

মহান আল্লাহ বলেন:

وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

‘‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির।’’[6]

এখানে বাহ্যত বুঝা যায় যে আল্লাহর বিধানের বাইরে চলা বা যে কোনো পাপ করাই কুফরী, কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানের বাইরে চলে বা পাপে লিপ্ত হয় সে মুলত তার নিজের জন্য বা অন্যের জন্য আল্লাহর বিধানের বাইরে বাইরে ফয়সালা করল। আর আল্লার নাযিলকৃত বিধানাবলির অন্যতম যে, মুসলিম অন্য মুসলিমের সাথে হানাহানি বা যুদ্ধে রত হবে না। ইবনু আববাস (রাঃ), আবূ বাক্রাহ সাকাফী (রাঃ), ইবনু উমার (রাঃ), ইবনু মাসঊদ (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত প্রায় মুতাওয়াতির হাদীসে তাঁরা বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিদায় হজ্জে বলেন:

لا تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ

‘‘তোমরা আমার পরে কাফির হয়ে যেও না, যে একে অপরকে হত্যা করবে।’’[7]

এখানে স্পষ্টতই পরস্পরে যুদ্ধ করাকে কুফরী বলা হয়েছে। অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ وَقِتَالُهُ كُفْرٌ

‘‘মুসলিমকে গালি দেওয়া পাপ এবং তার সাথে যুদ্ধ করা কুফরী।’’[8]

কিন্তু অন্য আয়াতে এরূপ কর্মে রত মানুষদেরকে মুমিন বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:

وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الأخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

‘‘মুমিনগণের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলের উপর অত্যাচার বা সীমলঙ্ঘন করলে তোমরা জুলুমকারী দলের সাথে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে তাদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে ফয়সালা করবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালবাসেন। মুমিনগণ পরস্পর ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও।’’[9]

এখানে আমরা দেখছি যে, পরস্পকের যুদ্ধে রত মানুষদেরকে সুস্পষ্টভাবেই মুমিন বলা হয়েছে। কারণ এরূপ কর্ম কুফর আসগার বা কুফর মাজাযী হওয়ার কারণে তা ঈমানের সাথে একত্রিত হতে পারে।

[1] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাঈসিল লুগাহ ৫/৪৫৪-৪৫৫।
[2] সূরা (৬৩) মুনাফিকূন: ৩ আয়াত।
[3] বুখারী, আস-সহীহ ১/২১, ৩/১১৬০; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৭৮।
[4] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩২০-৩২৪।
[5] সূরা (১৬) নাহ্ল: ১১২ আয়াত।
[6] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৪ আয়াত।
[7] বুখারী, আস-সহীহ ১/৫৬, ২/৬১৯, ৬২০, ৪/১৫৯৮, ১৫৯৯, ৫/২২৮২; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৮১-৮২।
[8] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৭, ৫/২২৪৭, ৬/২৫৯২; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৮১।
[9] সূরা (৪৯) হুজুরাত: ৯-১০ আয়াত।