পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে আমরা ইসলামী বিশ্বাস বা ঈমানের পরিচিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছি। ঈমান বা বিশ্বাসের বিপরীত ‘অবিশ্বাস’। ‘অবিশ্বাস’ সামগ্রিক বা ব্যাপক হতে পারে এবং আংশিকও হতে পারে। আমরা দেখেছি যে, ঈমান বা বিশ্বাসের বিভিন্ন রুকন ও বিষয় রয়েছে। কোনো অবিশ্বাসী এ সকল রুকন বা বিশ্বাসের সকল বিষয় ‘অবিশ্বাস’ করতে পারে। আবার অবিশ্বাস বা বিশ্বাসের বিভ্রান্তি আংশিকও হতে পারে। এমন অনেক দেখা যায় যে, কোনো কোনো অবিশ্বাসী ঈমানের কিছু বিষয় বিশ্বাস করেন এবং কিছু বিষয় অবিশ্বাস করেন। সামগ্রিক বা আংশিক উভয় প্রকার অবিশ্বাসেরই বিভিন্ন কারণ ও প্রকার রয়েছে।

কুরআনে বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী বিভ্রান্ত সম্প্রদায়সমূহের বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাসের কারণ উল্লেখ করেছেন। কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাওহীদ, রিসালাত ও আরকানুল ঈমানের বিশুদ্ধ বিশ্বাস থেকেই অবিশ্বাস বা কুফর ও শিরক জন্ম নিয়েছে। ঈমান থেকেই কুফরী জন্মেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঈমানের নামেই কুফরী প্রচারিত হয়েছে। ইহূদী, খৃস্টান ও আরবের অবিশ্বাসীগণ মূলত আসমানী কিতাব বা ওহী এবং আল্লাহর মনোনীত নবী-রাসূলদের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হন। কুরআন কারীমে এদের বিভ্রান্তির কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জাতির অবিশ্বাসের কারণ কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এ বিষয়ক অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। এ অধ্যায়ে আমরা অবিশ্বাসের ধরন, কারণ, প্রকরণ ও প্রকাশগুলি আলোচনা করব। মহান আল্লাহর নিকট তাওফীক প্রার্থনা করছি।

৫. ১. কুফর

৫. ১. ১. অর্থ ও পরিচিতি

আরবী ‘কুফর’ (الكُفْرُ) শব্দটি অবিশ্বাস, অস্বীকার, অকৃতজ্ঞতা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। শব্দটির মূল অর্থ ‘আবৃত করা’। ৪র্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ও অভিধান প্রণেতা আবুল হুসাইন আহমদ ইবনু ফারিস (৩৯৫হি) বলেন: ‘‘(কাফ, রা ও ফা) তিন অক্ষরের ক্রিয়ামূলটি একটি বিশুদ্ধ অর্থ প্রকাশ করে, তা হলো: ‘আবৃত করা বা গোপন করা’। কোনো ব্যক্তি যদি তার পরিহিত বর্মকে তার কাপড় দিয়ে আবৃত করেন তবে বলা হয় তিনি তার বর্ম ‘কুফর’ করেছেন। চাষীকে ‘কাফির’ (আবৃতকারী) বলা হয়, কারণ তিনি শষ্যদানাকে মাটি দ্বারা আবৃত করেন। ঈমান বা বিশ্বাসের বিপরীত অবিশ্বাসকে ‘কুফর’ বলা হয়; কারণ অবিশ্বাস অর্থ সত্যকে অবৃত করা। অকৃতজ্ঞতা বা নিয়ামত অস্বীকার করাকে কুফর বলা হয়; কারণ এতে নিয়ামত লুকানো হয় এবং আবৃত করা হয়।’’[1]

ইসলামী পরিভাষায় বিশ্বাসের অবিদ্যমানতাই কুফর বা অবিশ্বাস। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর এবং ঈমানের রুকনগুলিতে বিশ্বাস না থাকাকেই ইসলামের পরিভাষায় ‘কুফর’ বলে গণ্য। অস্বীকার, সন্দেহ, দ্বিধা, হিংসা, অহঙ্কার, ইত্যাদি যে কোনো কারণে যদি কারো মধ্যে ‘ঈমান’ বা দৃঢ় প্রত্যয়ের বিশ্বাস অনুপস্থিত থাকে তবে তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘কুফর’ বলে গণ্য করা হয়। অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে তাঁর সমতুল্য বা সমকক্ষ বা তাঁর সাথে তুলনীয় বলে বিশ্বাস করার মাধ্যমে আল্লাহর একত্ব ও অতুলনীয়ত্ব অস্বীকার করাও কুফর। তবে এ পর্যায়ের কুফরকে ইসলামী পরিভাষায় শির্ক বলা হয়।

৫. ১. ২. কুফর আকবার ও কুফর আসগার

কুরআন ও হাদীসের আলোকে কুফরকে দু ভাগে ভাগ করা হয়: (১) কুফর আকবার বা বৃহত্তর কুফর এবং (২) কুফর আসগার বা ক্ষুদ্রতর কুফর। কুফর আকবার বলতে প্রকৃত অবিশ্বাস বঝানো হয় যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় এবং প্রকৃত অবিশ্বাসী বা কাফিরে পরিণত করে। এর পরিণতি চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তিভোগ। আর কুফর আসগার বলতে বুঝানো হয় কঠিন পাপসমূহকে যা অবিশ্বাসেরই নামান্তর, তবে এরূপ পাপে লিপ্ত মানুষদেরকে ইসলাম ত্যাগকারী বা প্রকৃত কাফির বলে গণ্য করা হয় না। তাদেরকে অনন্ত জাহান্নামবাসী বলেও বিশ্বাস করা হয় না। বরং তাদেরকে পাপী ও শাস্তিযোগ্য মুসলিম বলে গণ্য করা হয়। কুফর আসগারকে কুফর মাজাযী বা রূপক কুফরও বলা হয়।

৫. ১. ৩. কুফর আকবার -এর প্রকারভেদ

কুফর আকবার বা ‘বৃহত্তর কুফর’-ই প্রকৃত কুফর বা অবিশ্বাস। তাওহীদ ও আরকানুল ঈমানের আলোকে আমরা কুফর বা অবিশ্বাসকে আমরা নিম্নের পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করতে পারি:

৫. ১. ৩. ১. ‘প্রতিপালনের একত্বে’ অবিশ্বাস

আমরা দেখেছি যে, তাওহীদের প্রথম পর্যায় তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত। এ বিষয়ে কোনো প্রকার অবিশ্বাস, অস্বীকার, দ্বিধা, সন্দেহ বা আংশিক বিশ্বাস ‘কুফর’ বলে গণ্য। আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস, তাঁর স্রষ্টাত্বে অবিশ্বাস, অন্য কোনো স্রষ্টা আছে বলে বিশ্বাস, তার প্রতিপানের ক্ষমতায় অবিশ্বাস, অন্য কারো বিশ্ব পরিচালনা, প্রতিপালন বা মঙ্গল-অমঙ্গলের ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস, তার রিয্ক দানের ক্ষমতায় অবিশ্বাস, অন্য কোনো রিযিকদাতা আছে বলে বিশ্বাস, ইত্যাদি সবই এ পর্যায়ের কুফর। অনুরূপভাবে কিছু বিষয়ে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস ও কিছু বিষয়ে তা অবিশ্বাস করাও একইরূপ কুফর।

৫. ১. ৩. ২. নাম ও গুণাবলির একত্বে অবিশ্বাস

‘তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত’ বা আল্লাহর নাম ও গুণাবলির একত্ব আমরা তাওহীদ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। আল্লাহ তা‘আলার নাম ও গুণাবলির কিছু বা সব অস্বীকার করা এ পর্যায়ের কুফর। এ কুফর দু প্রকারের:

প্রথমত: কুফরুন নাফই (كفر النفي) বা অস্বীকারের কুফর

এর অর্থ আল্লাহ যে সকল নাম ও গুণ তাঁর আছে বলে জানিয়েছেন তার সব বা যে কোনো একটি অবিশ্বাস বা অস্কীকার করা। যেমন আল্লাহর ইলম (জ্ঞান), কুদরত (ক্ষমতা), কালাম (কথা), রাহমাত... ইত্যাদি যে কোনো এক বা একাধিক নাম বা গুণ অস্বীকার করা, বা তার পূর্ণতা অস্বীকার করা। আল্লাহর কোনো কর্ম বা গুণ তার সৃষ্টির মত বা তুলনীয় বলে বিশ্বাস করাও একই পর্যায়ের কুফর বা অবিশ্বাস।

দ্বিতীয়ত: কুফরুল ইসবাত (كفر الإثبات) বা দাবির কুফর

এর অর্থ আল্লাহ নিজের জন্য যা অস্বীকার করেছেন তাঁর তা আছে বলে দাবি করা। যেমন আল্লাহর জন্য ঘুম, তন্দ্রা, সন্তান, স্ত্রী ... ইত্যাদি দাবি করা।

আল্লাহ তাঁর নিজের জন্য যে সকল বিশেষণ, গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, কেউ যদি নিজের জন্য বা অন্য কোনো সৃষ্টির জন্য সে সকল বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে এক বা একাধিক গুণ বা বিশেষণ দাবি করে তবে তাও এ প্রকারের কুফরী বলে গণ্য হবে। যেমন আল্লাহর মত ইলম, হিকমত, রহমত... ইত্যাদি অন্য কারো আছে বলে দাবি করা। এরূপ দাবি স্বীকার বা বিশ্বাস করাও একইরূপ কুফর।

[1] ইবনু ফারিস, মু‘জামু মাকাইসিল লুগাহ ৫/১৯১।