কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা চতুর্থ অধ্যায়: আরকানুল ঈমান ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন কোনো শাফা‘আত কবুল করা হবে না, আল্লাহ ছাড়া কেউ শাফা‘আতের অধিকার রাখবে না এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো শাফা‘আতকারীও থাকবে না। মহান আল্লাহ বলেন:

وَاتَّقُوا يَوْمًا لا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلا هُمْ يُنْصَرُونَ

‘‘তোমরা সে দিনকে ভয় কর যে দিন কেউ কারো কাজে আসবেনা এবং কারো সুপারিশ স্বীকৃত হবেনা এবং কারো নিকট হতে ক্ষতিপূরণ গৃহীত হবে না এবং তারা কোন প্রকার সাহায্য পাবে না।’’[1]

তিনি আরো বলেন:

وَاتَّقُوا يَوْمًا لا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلا تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَلا هُمْ يُنْصَرُونَ

‘‘তোমরা সে দিনকে ভয় কর যে দিন কেউ কারো কোন উপকারে আসবে না এবং কারো নিকট হতে কোন ক্ষতিপূরণ গৃহীত হবে না এবং কোন সুপারিশ কারো পক্ষে লাভজনক হবে না এবং তারা কোন সাহায্য ও পাবে না।’’[2]

অন্যত্র ঘোষণা করা হয়েছে:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لا بَيْعٌ فِيهِ وَلا خُلَّةٌ وَلا شَفَاعَةٌ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ

‘‘হে মু’মিনগণ, আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা হতে তোমরা ব্যয় কর সেই দিন আসার পূর্বে- যে দিন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবে না।’’[3]

অন্যত্র আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা বলেন:

أَأَتَّخِذُ مِنْ دُونِهِ آَلِهَةً إِنْ يُرِدْنِ الرَّحْمَنُ بِضُرٍّ لا تُغْنِ عَنِّي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا وَلا يُنْقِذُونِ

‘‘আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্য ইলাহ গ্রহণ করব? দয়াময় আল্লাহ আমাকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে চাইলে তাদের সুপারিশ আমার কোন কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধার করতে পারবে না।’’[4]

তিনি আরো বলেন:

وَأَنْذِرْ بِهِ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْ يُحْشَرُوا إِلَى رَبِّهِمْ لَيْسَ لَهُمْ مِنْ دُونِهِ وَلِيٌّ وَلا شَفِيعٌ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

‘‘তুমি এ দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করে দাও যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের নিকট সমবেত করা হবে এমন অবস্থায় যে, তিনি ব্যতীত তাদের কোনো অভিভাবক থাকবে না এবং কোনো সুপারিশকারীও থাকবে না; হয়ত তারা সাবধান হবে।’’[5]

মহান আল্লাহ আরো বলেন:

وَذَكِّرْ بِهِ أَنْ تُبْسَلَ نَفْسٌ بِمَا كَسَبَتْ لَيْسَ لَهَا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلِيٌّ وَلا شَفِيعٌ

‘‘এ দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দাও, যাতে কেউ নিজ কৃত কর্মের জন্য ধ্বংস না হয়, যখন আল্লাহ ব্যতীত তার কোনো অভিভাবক থাকবে না এবং কোনো সুপারিশকারীও থাকবে না।’’[6]

অন্যত্র ঘোষণা করা হয়েছে:

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ مَا لَكُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلا شَفِيعٍ أَفَلا تَتَذَكَّرُونَ

‘‘আল্লাহ তিনি আকাশ মন্ডলী, পৃথিবী ও তার অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক নেই এবং সুপারিশকারীও নেই; তবু ও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না।’’[7]

অন্যত্র বলা হয়েছে:

وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَضُرُّهُمْ وَلا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلا فِي الأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘‘তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করে তারা তাদের ক্ষতিও করে না উপকারও করে না। তারা বলে এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। বল, তোমরা কি আল্লাহকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দিবে যা তিনি জানেন না? তিনি মহান পবিত্র এবং তাদের শির্ক করা থেকে তিনি উর্দ্ধে।’’[8]

অন্যত্র বলা হয়েছে:

قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

‘‘বল, সকল সুপারিশ আল্লাহরই ইখতিয়ারে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই; অতঃপর তারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তন করবে।’’[9]

উপরের আয়াতগুলিতে বাহ্যত শাফা‘আত অস্বীকার করা হয়েছে। এ সকল আয়াত থেকে মু’তাযিলা ও অন্যান্য ফিরকা দাবি করে যে, কিয়ামতের দিন কারো শাফা‘আতে কোনো পাপীর ক্ষমালাভের ধারণা বাতিল ও ভিত্তিহীন।

বস্ত্তত এ সকল আয়াতে মূলত শাফা‘আত বিষয়ে মুশরিকদের বিশ্বাস খন্ডন করা হয়েছে। আমার ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ওহীর জ্ঞানের সাথে কিছু কল্পনা যোগ করে আরবের কাফিরগণ ও অন্যান্য কাফির সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিশ্বাস করত যে, আল্লাহর ফিরিশতাগণ, নবীগণ বা প্রিয়পাত্রগণ শাফা‘আতের ক্ষমতা ও অধিকার সংরক্ষণ করেন। তারা তাদের ইচ্ছামত যাকে ইচ্ছা সুপারিশ করে মুক্তি দিতে পারবেন। মহান আল্লাহ তাদেরকে এ ধরনের ক্ষমতা ও অধিকার দিয়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাদের এ ভ্রান্ত বিশ্বাস খন্ডন করে জানিয়েছেন যে, শাফা‘আতের মালিকানা, অধিকার ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। অন্যান্য আয়াতে শাফা‘আতের স্বীকৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। যিনি শাফা‘আত করবেন তিনি যদি শাফা‘আত করার জন্য মহান আল্লার অনুমতি গ্রহণ করেন এবং যার জন্য শাফা‘আত করবেন তার প্রতি যদি মহান আল্লহ সন্তুষ্ট থাকেন তবে সেক্ষেত্রে শাফা‘আত করার সুযোগ আল্লাহ প্রদান করবেন। যার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট নন তার জন্য কেউই শাফা‘আত করবে না। সর্বাবস্থায় শাফা‘আত গ্রহণ করা বা না করা মহান আল্লাহর ইচ্ছা। মহান আল্লাহ বলেন:

مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلا بِإِذْنِهِ

‘‘কে সে যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করবে?’’[10]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:

يُدَبِّرُ الأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلا تَذَكَّرُونَ

‘‘তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর অনুমতি লাভ না করে সুপারিশ করার কেউ নেই। তিনিই আল্লাহ তোমাদের প্রতিপালক; সুতরাং তাঁর ‘ইবাদত কর। তবু ও কি তোমরা অনুধাবন করবে না?’’[11]

তিনি আরো বলেন:

لا يَمْلِكُونَ الشَّفَاعَةَ إِلا مَنِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَنِ عَهْدًا

‘‘যে দয়াময়ের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে সে ব্যতীত অন্য কারো সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকবে না।’’[12]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:

يَوْمَئِذٍ لا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلا

‘‘দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন সে ব্যতীত কারো সুপারিশ সে দিন কোন কাজে আসবে না।’’[13]

আল্লাহ তাবারাকা ও তা‘আলা আরো বলেন:

وَلا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ

‘‘যাকে অনুমতি দেয়া হয় সে ব্যতীত আল্লাহর নিকট কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না।’’[14]

অন্যত্র তিনি বলেন:

وَلا يَشْفَعُونَ إِلا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ.

‘‘তিনি যাদের প্রতি সন্তুষ্ট তাদের ছাড়া আর কারো জন্য তারা সুপারিশ করে না এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত।’’[15]

وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى

‘‘আকাশে কত ফিরিশ্তা রয়েছে! তাদের কোনো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।’’[16]

উপরের আয়াতগুলি থেকে আমরা নিম্নের বিষয়গুলি বুঝতে পারি:

(১) শাফা‘আতের মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো শাফা‘আতের কোনো ক্ষমতা বা অধিকার নেই।

(২) আল্লাহ অনুমতি দিলে কেউ শাফ‘আত করতে পারবেন।

(৩) যার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট শুধু তাকেই অনুমতি প্রদান করবেন।

(৪) আল্লাহর অনুমতিক্রমে ফিরিশতাগণ সুপারিশ করবেন বলে কুরআনে স্পষ্টত বলা হয়েছে। এছাড়া অন্য কারা তাঁর অনুমতিক্রমে সুপারিশ করতে পারবেন তা স্পষ্টত উল্লেখ করা হয় নি। হাদীস শরীফে এ বিষয়ক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

(৫) যে ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করা হবে তার জন্যও আল্লাহর অনুমোদন পূর্বশর্ত।

(৬) যে ব্যক্তির প্রতি স্বয়ং আল্লাহ সন্তুষ্ট রয়েছেন সে ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো জন্য কেউ সুপারিশ করবেন না।

[1] সূরা (২) বাকারা: ৪৮ আয়াত।
[2] সূরা (২) বাকারা: ১২৩ আয়াত।
[3] সূরা (২) বাকারা: ২৫৪ আয়াত।
[4] সূরা (৩৬) ইয়াসীন: ২৩ আয়াত।
[5] সূরা (৬) আন‘আম: ৫১ আয়াত।
[6] সূরা (৬) আন‘আম: ৭০ আয়াত।
[7] সূরা (৩২) সাজদা: ৪০ আয়াত।
[8] সূরা (১০) ইউনুস: ১৮ আয়াত।
[9] সূরা (৩৯) যুমার: ৪৪ আয়াত।
[10] সূরা (২) বাকারা: ২৫৫ আয়াত।
[11] সূরা (১০) ইউনুস: ৩ আয়াত।
[12] সূরা (১৯) মারইয়াম: ৮৭ আয়াত।
[13] সূরা (২০) তাহা: ১০৯ আয়াত।
[14] সূরা (৩৪) সাবা: ২৩ আয়াত।
[15] সূরা (২১) আম্বিয়া: ২৮ আয়াত।
[16] সূরা (৫৩) নাজম: ২৬ আয়াত।