মহান আল্লাহ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে কিছু অলৌকিক বা অস্বাভাবিক কর্ম সম্পাদন করাতেন যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। এ সকল কর্ম তাদের নবুয়তের দাবীর সত্যতা প্রমাণ করত। কোনো নবী মৃতকে জীবিত করেছেন, কেউ জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিরাপদে থেকেছেন। কুরআন ও হাদীসে এ সকল কর্মকে আয়াত, নিদর্শন বা চিহ্ন বলা হয়েছে। পরবর্তী যুগের পরিভাষায় এগুলিকে মু’জিযা বলা হয়। এবিষয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আল্লাহ অনেক ‘আয়াত’ বা মুজিযা দান করেছিলেন। অন্যান্য সকল নবীর মুজিযা ছিল তাৎক্ষণিক। অর্থাৎ তাঁর সময়ের মানুষেরা তা প্রত্যক্ষ করেছেন, কেউ কেউ ঈমান এনেছে, কেউ অবিশ্বাস করেছেন। পরবর্তী যামানার মানুষেরা তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান নি। তাঁরা শুধুমাত্র এ সকল মুজিযার কথা পড়েছেন বা শুনেছেন।

যেহেতু মুহাম্মাদ (ﷺ) সর্বকালের সকল মানুষের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন, তাই আল্লাহ তাঁকে একটি চিরস্থায়ী মুজিযা দান করেছেন, তা হলো পবিত্র কুরআন। আল্লাহ কুরআন নাযিল করে তৎকালীন আরবদেরকে কুরআনের ছোট একটি সূরার অনুকরণে একটি সূরা লিখে পেশ করতে আহবান করেন। তারা তাতে অক্ষম হয়।

আমরা দেখেছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে স্তব্দ করতে এবং ইসলামের অগ্রযাত্রা রোধ করতে মক্কার কাফিরগণ নিজেদের জীবন ও সম্পদ বাজি রেখেছে। অথচ তাদের জন্য খুবই সহজ ছিল যে, কুরআনের এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করে কুরআনের একটি ছোট্ট সূরার অনুরূপ সূরা রচনা করে জনসমক্ষে উপস্থিত করে দাবি করা যে, এই দেখ আমরা মুহাম্মাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তার জবাব দিয়েছি। যেহেতু জনমত ছিল তাদের পক্ষে এবং অধিকাংশ মানুষই তাদের মতের ছিল সেহেতু মোটামুটি কাছাকাছি একটি সূরা তৈরি করেই তার হৈ চৈ করতে পারত এবং তাদের পক্ষের মানুষদের মনোবল জোরদার করতে পারত। কিন্তু কখনোই তার এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নি। কারণ তারা জানত যে, এতে তাদের পক্ষের আরবদের সামনেই তাদের অসহায়ত্ব ও অক্ষমতা প্রকাশ পেয়ে যাবে এবং ইসলামের প্রচার বৃদ্ধি পাবে।

কুরআনের ভাষার ন্যায় এর জ্ঞানও মুজিযা। বৈজ্ঞানিক নতুন নতুন আবিষ্কারের সাথে সাথে প্রতি যুগেই মানব জাতি কুরআনের নতুন নতুন মুজিযা জানতে পেরেছেন। আধুনিক যুগেও যে সকল অমুসলিম বৈজ্ঞানিক, গবেষক বা পন্ডিত কুরআন অধ্যয়ন করছেন তারও স্বীকার করছেন যে এই গ্রন্থ কোনো মানুষের রচিত নয়, বরং তা মহান স্রষ্টা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। কেউ তাতে ঈমান এনেছেন, কেউ এড়িয়ে গিয়েছেন। এ ভাবে কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগের মানুষ নতুনভাবে এই চিরস্থায়ী মুজিযার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নবুয়তের সত্যতা বুঝতে পারবে।

এছাড়া মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আরো অনেক মুজিযা দান করেছিলেন যা তাঁর সমসময়িক মানুষেরা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ সকল মুজিযার মধ্যে কিছু মুজিযার বিবরণ কুরআনে রয়েছে। অন্যান্য মুজিযার বিবরণ হাদীস থেকে জানা যায়। কুরআনে উল্লিখিত মুজিযাগুলির মধ্যে অন্যতম দুটি মুজিযা:

(১) ইসরা ও মি’রাজ: অলৌকিকভাবে রাত্রিভ্রমন ও ঊর্ধ্বগমন

মহান আল্লাহ কুরআনে সূরা বনী ইসরাঈলে বলেছেন:

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آَيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

‘‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমন করিয়েছেন মসজিদুল হারাম (মক্কার মসজিদ) থেকে মসজিদুল আকসা (যিরূশালেমের মসজিদ) পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য।’’[1]

অন্যত্র সূরা নাজমে আল্লাহ বলেছেন:

أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى وَلَقَدْ رَآَهُ نَزْلَةً أُخْرَى عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى لَقَدْ رَأَى مِنْ آَيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى

 ‘‘সে (মুহাম্মাদ (ﷺ)) যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে তার সাথে বিতর্ক করবে? নিশ্বয়ই সে তাকে (জিবরীলকে) আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহা-র (প্রান্তবর্তী বদরী বৃক্ষের) নিকট। যার নিকট অবস্থিত জান্নাতুল মা‘ওয়া (অবস্থানের জান্নাত)। যখন বৃক্ষটি যদ্বারা আচ্ছাদিত হবার তদ্বারা ছিল আচ্ছাদিত। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয় নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয় নি। সে তো তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলি দেখেছিল।’’[2]

এ সকল আয়াত এবং বহুসংখ্যক সহীহ হাদীস প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মিরাজে গমন করেন। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে তা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত। আর ‘বান্দা’ বলতে আত্মা ও দেহের সমন্বিত মানুষকেই বুঝানো হয়। মহান আল্লাহ বলেন: ‘‘তুমি কি তাকে দেখেছ, যে বাধা দেয় এক বান্দাকে, যখন সে সালাত আদায় করে?’’[3] অন্যত্র সূরা জিন্ন-এর মধ্যে তিনি বলেন: ‘‘আর এই যে, যখন আল্লাহর বান্দা তাঁকে ডাকার জন্য দন্ডায়মান হলো তখন তারা তার নিকট ভিড় জমালো।’’[4] নিঃসন্দেহে উপরের দুই স্থানেই ‘বান্দা’ বলতে দেহ ও আত্মার সমন্বিত ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে। এথেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এখানেও ‘বান্দা’ বলতে দেহ ও আত্মার সমন্বিত ব্যক্তিকেই রজনীযোগে ভ্রমন করানোর কথা বলা হয়েছে।

এছাড়া আমরা জানি যে, কাফিরগণ ইসরা ও মি’রাজ (নৈশভ্রমন ও ঊর্ধ্বারোহন) অস্বীকার করে এবং একে অসম্ভব বলে দাবি করে। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মিরাজের কথা বললেন তখন কতিপয় দুর্বল ঈমান মুসলিম একে অসম্ভব মনে করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নবুয়তের বিষয়ে সন্দীহান হয়ে ইসলাম পরিত্যাগ করে। এ থেকে নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জাগ্রত অবস্থায় দৈহিকভাবে মিরাজ সংঘটিত হওয়ার কথাই বলেছিলেন। নইলে কাফিরদের অস্বীকার করার ও দুর্বল ঈমান মুসলিমদের ঈমান হারানোর কোনো কারণই থাকে না। স্বপ্নে এরূপ নৈশভ্রমন বা স্বর্গারোহণ কোনো অসম্ভব বা অবাস্তব বিষয় নয় এবং এরূপ স্বপ্ন দেখার দাবি করলে তাতে অবাক হওয়ার মত কিছু থাকে না। যদি কেউ দাবি করে যে, ঘুমের মধ্যে সে একবার পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে এবং একবার পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে চলে গিয়েছে, তবে তার দেহ স্বস্থানেই রয়েছে এবং দৈহিক অবস্থার পরিবর্তন হয় নি, তবে কেউ তার এরূপ স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনা অস্বীকার করবে না বা এতে অবাকও হবে না।

আধুনিক বিজ্ঞান সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে যে, জাগ্রত অবস্থায় সশরীরের এরূপ অলৌকিক নৈশভ্রমন ও ঊর্ধ্বারোহণ অসম্ভব নয়। মি’রাজের ঘটনাবালির মধ্যে আরো অনেক বৈজ্ঞানিক মুজিযার সন্ধান পেয়েছেন আধুনিক বিজ্ঞানীরা।

(২) চন্দ্র খন্ডিত করা

মক্কার কাফিরগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে অলৌকিক নিদর্শন দাবি করে। তখন রত্রি বেলায় তাঁর ইশারায় পূর্ণিমার চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। কিছু পরে আবার তা একত্রিত হয়। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন:

اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ وَإِنْ يَرَوْا آَيَةً يُعْرِضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ مُسْتَمِرٌّ

‘‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা কোনো নিদর্শন (অলৌকিক চিহ্ন) দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এ তো চিরাচরিত যাদু।’’[5]

বিভিন্ন সহীহ হাদীসে চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সহীহ হাদীসের গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা), আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা), আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা), আনাস ইবনু মালিক (রা), জুবাইর ইবনু মুতয়িম (রা) ও হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান এই ৬ জন সাহাবী থেকে প্রায় ২০টি পৃথক সনদে এ বিষয়ক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আলিমগণ এ বিষয়ক হাদীসগুলিকে মুতাওয়াতির বলে গণ্য করেছেন।

এ ছাড়া আরো অগণিত আয়াত বা মুজিযা মুতাওয়াতির ও আহাদ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলির বিস্তারিত তালিকার জন্যই পৃথক পুস্তকের প্রয়োজন। তাঁর দু‘আয় খাদ্যে অলৌকিক বরকতের ঘটনা ঘটেছে অগণিতবার। সামান্য কয়েকটি রুটি দ্বারা শতাধিক মানুষ তৃপ্তির সাথে আহার করেছেন। সামান্য আধ আজলা পানির মধ্যে তিনি হাত রাখলে আঙুলের মধ্য থেকে পানির ঝর্ণা বের হয় যাতে কয়েক হাজার মানুষের এক বিশাল বাহিনীর সকলেই ওযু-গোসল ও পানি পান করেন। তাঁর দু‘আয় মৃত ঝর্ণায় পানির সঞ্চার হয়, মাত্র দু পাত্র পানি থেকে হাজার হাজার পাত্র পূর্ণ করা হয়, অলৌকিকভাবে বৃষ্টিপাত হয়, ফসল অলৌকিকভাবে বৃদ্ধি পায়। বৃক্ষ তাঁর নির্দেশে পালন করে,  কথা বলে ও সাক্ষ্য দেয়। শুষ্ক খেজুরের গুড়ি তাঁর জন্য মানব শিশুর ন্যায় ক্রন্দন করে। তাঁর দু‘আয় অন্ধ দৃষ্টিশক্তি প্রাপ্ত হয়, মৃত্যুপথযাত্রী রোগী আরোগ্য লাভ করেব, বাকশক্তিহীন কথা বলে, পাগল সুস্থ হয়।

তাঁর অলৌকিক নিদর্শন বা মুজিযার মধ্যে অন্যতম তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ। তিনি তাঁর নিজের সম্পর্কে, তাঁর বিভিন্ন সাহাবী সম্পর্কে, মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অসংখ্য ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, যা তার জীবদ্দশায় ও তার পরে পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে।[6]

[1] সূরা ইসরা (বনী ইসরাঈল), ১ আয়াত।
[2] সূরা (৫৩) নাজ্ম: ১২-১৮।
[3] সূরা (৯৬) আলাক, ৯-১০ আয়াত।
[4] সূরা (৭২) জিন্ন, ১৯ আয়াত।
[5] সূরা (৫৪) কামার, ১-২ আয়াত।
[6] রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনী ও মুজিযা সম্পর্কিত উপরের তথ্যাদি ও বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন: ইবনু হিশাম, আস-সিরাতুন নাবাবীয়াহ; ইবনু হিববান, আস সিরাতুন নাবাবীয়াহ; যাহাবী, আস সিরাতুন নাবাবীয়াহ, বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াহ, আহমদ ইবনু মুহাম্মাদ কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল্লাদুন্নিয়াহ; মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ শামী, আস-সীরাহ আশ-শামিয়্যাহ সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ; মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব; সাফিউদ্দীন মুবারাকপূরী, আর রাহীকুল মাখতুম; ড. মাহাদী রিযকুল্লাহ, আস সীরাতুন নাবাবীযা ফী দাওয়িল মাসাদিরিল আসলিয়্যাহ, ড. আকরাম দিয়া আর উমারী, আস সীরাতুন নাবাবীয়াহ আস সহীহাহ ও অন্যান্য সিরাত ও হাদীসের গ্রন্থ।