একজন মানুষকে মুমিন বলে গণ্য হতে কি কি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে তা কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হাদীসেও তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইসলামের পরিভাষায় এগুলিকে ‘আরকানুল ঈমান’ বলা হয়।

মহান আল্লাহ বলেন:

لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآَخِرِ وَالْمَلائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآَتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآَتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ

‘‘পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোর মধ্যে কোনো পূণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য তার যে বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহে, পরকালে, মালাকগণে (ফিরিশতাগণে), গ্রন্থসমূহে এবং নবীগণে, এবং ধন সম্পদের প্রতি মনের টান থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন-অনাথ, অভাবগ্রস্ত, পথিক, সাহায্যপ্রার্থনাকারিগণকে এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থ প্রদান করে, এবং সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূর্ণ করে এবং অর্থ-সংকটে, দুঃখ ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করে। এরাই প্রকৃত সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকী।’’[1]

এখানে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়েছেন যে, শুধু আনুষ্ঠানিকতার নাম ইসলাম নয়, প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতায় কোনো পূণ্য নেই। ইসলাম বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়। এখানে আল্লাহ মুমিনের বিশ্বাসের মৌলিক পাঁচটি বিষয় এবং তার মৌলিক কর্ম ও চরিত্রের বর্ণনা দান করেছেন। অন্যত্র আল্লাহ বলেন:

آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ

‘‘রাসূল তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে ইমান এনেছেন এবং মুনিগণও। তারা সকলেই আল্লাহে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর গ্রন্থসমূহে এবং তাঁর রাসূলগণে ইমান আনয়ন করেছেন। আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে তারতম্য করি না।’’[2]

এখানে ঈমানের স্তম্ভগুলির মধ্য থেকে ৪টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য আয়াতে ৫টি বিষয়ের উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا آَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي أَنْزَلَ مِنْ قَبْلُ وَمَنْ يَكْفُرْ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآَخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلالا بَعِيدًا

‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহে, তাঁর রাসূলে, তাঁর রাসূলের উপর যে গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন তাতে এবং যে গ্রন্থ তিনি পূর্বে অবতীর্ণ করেছেন তাতে ঈমান আন। এবং কেউ আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতাগণ, তাঁর গ্রন্থসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং পরকালকে অবিশ্বাস করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে।’’[3]

এভাবে কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে উপরের বিষয়গুলি একত্রে বা পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসেও ঈমানের রুক্নগুলি উল্লেখ করা হয়েছে। এই পুস্তকের শুরুতে আবূ হুরাইরা বর্ণিত একটি হাদীসে আমরা দেখেছি যে, ঈমানের পরিচয় দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘(ঈমান এই যে,) তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহয়, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর পুস্তকসমূহে, তাঁর সাক্ষাতে, তাঁর রাসূলগণে এবং তুমি বিশ্বাস করবে শেষ পুনরুত্থানে এবং তুমি বিশ্বাস করবে তাকদীর বা নির্ধারণের সবকিছুতে।’’[4]

এই ঘটনারই বর্ণনা করেছেন উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) অন্য হাদীসে। তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি তথায় আসলেন। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ অত্যন্ত ধবধবে সাদা এবং মাথার চুলগুলো অত্যন্ত পরিপাটি ও কাল। .... তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করে বলেন: ‘‘ঈমান সম্পর্কে প্রশ্ন করে বলেন, ঈমান কী তা আমাকে বলুন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّه

‘‘ঈমান হলো এই যে, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর গ্রন্থসমূহে, তাঁর রাসূলগণে এবং পরকালে, এবং বিশ্বাস করবে আল্লাহর পূর্ব নির্ধারণে (ভাগ্যে),  তাঁর ভাল এবং মন্দে।’’[5]

এভাবে বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, ইসলামী ঈমানের বা ‘আল-আকীদাহ আল ইসলামিয়্যাহ’-র ছয়টি মৌলিক স্তম্ভ রয়েছে: (১) আল্লাহর উপর ঈমান, (২) আল্লাহর মালাকগণের (ফিরিশতাগণের) প্রতি ঈমান (৩) আল্লাহর গ্রন্থসমূহের প্রতি ঈমান, (৪) আল্লাহর রাসূলগণের উপর ঈমান, (৫) পুনরুত্থান, কিয়ামত, পরকাল বা আখিরাতের উপর ঈমান, এবং (৬) তাকদীর বা আল্লাহর নির্ধারণ ও সিদ্ধান্তের উপর ঈমান। এ বিষয়গুলোকে আরকানে ঈমান, অর্থাৎ ঈমানের  স্তম্ভসমূহ, ভিত্তিসমূহ বা মূলনীতিসমূহ বলা হয়।

[1] সূরা (২) বাকারা: ১৭৭ আয়াত।
[2] সূরা (২) বাকারা: ২৮৫ আয়াত।
[3] সূরা (৪) নিসা: ১৩৬ আয়াত।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৭, ৪/১৭৩৩; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৯, ৪০, ৪৭।
[5] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৫-৩৬।