আরবী ‘আমন’ শব্দ থেকে ঈমান শব্দটির উৎপত্তি। আম্ন (أمن) অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, আস্থা, বিশ্বস্ততা, হৃদয়ের স্থিতি ইত্যাদি। ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ: নিরাপত্তা প্রদান, আস্থা স্থাপন, বিশ্বাস ইত্যাদি। শব্দটির অর্থ সম্পর্কে ৪র্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ আবুল হুসাইন আহমদ ইবনু ফারিস (৩৯৫হি) বলেন: ‘‘হামযা, মীম ও নূন: এই ধাতুটির মূল অর্থ দুটি: প্রথম অর্থ: বিশস্ততা, যা খিয়ানতের বিপরীত এবং দ্বিতীয় অর্থ বিশ্বাস করা বা কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করা। আমরা দেখছি যে, অর্থ দুটি খুবই নিকটবর্তী ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।’’[1]

তিনি উভয় অর্থে ঈমান শব্দের অর্থ আলোচনা করে উল্লেখ করেন যে, প্রথম অর্থে ঈমান অর্থ নিরাপত্তা প্রদান করা বা আমানতদার বলে মনে করা। আর দ্বিতীয় অর্থে ঈমান অর্থ বিশ্বাস করা, বিশ্বস্ততায় আস্থা স্থাপন করা।[2]

বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাস বিশ্বাস অর্থে কুরআন ও হাদীসে সর্বদা ‘ঈমান’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ‘বিশ্বাস করল’ অর্থে ‘আ-মানা, আমানূ ইত্যাদি ক্রিয়াপদ, ‘বিশ্বাস কর’ অর্থে তু’মিনু, নু’মিনু ইত্যাদি ক্রিয়াপদ, আদেশ অর্থে ‘আ-মিন, আ-মিনূ ইত্যাদি ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বাসী অর্থে মুমিন, মুমিনূন ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আর বিশ্বাস অর্থে ‘ঈমান’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। কুরআন কারীমে বলা হয়েছে:

وَقَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ وَالإِيمَانَ

‘‘আর যারা ঈমান ও ইলম (বিশ্বাস ও জ্ঞান) প্রদত্ত হয়েছে তারা বলল...।’’[3]

অন্যত্র ইরশাদ করা হয়েছে:

وَمَنْ يَكْفُرْ بِالإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

‘‘আর কেউ ঈমান প্রত্যাখ্যান করলে তার কর্ম বিনষ্ট বা নিষ্ফল হবে এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’’[4]

অন্যত্র বলা হয়েছে:

رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلإِيمَانِ أَنْ آَمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآَمَنَّا

‘‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা একজন আহবানকারীকে ঈমানের দিকে আহবান করতে শুনেছি: ‘তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনয়ন কর’; সুতরাং আমরা ঈমান আনয়ন করেছি।’’[5]

অন্যত্র ঘোষণা করা হয়েছে:

وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آَيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا

‘‘যখন তাঁর আয়াত তাদের নিকট পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে।’’[6]

আব্দু কাইস গোত্রের প্রতিনিধিদের বিষয়ে ইবনু আববাস (রা) বলেন,

أَمَرَهُمْ بِالإِيمَانِ بِاللَّهِ وَحْدَهُ قَالَ أَتَدْرُونَ مَا الإِيمَانُ بِاللَّهِ وَحْدَهُ قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ شَهَادَةُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ ....

‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে ‘একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমানের’ নির্দেশ প্রদান করেন এবং বলেন, তোমরা কি জান যে, একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান কী? তাঁরা বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিকতর অবগত আছেন। তিনি বলেন (একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান এই যে,) তুমি সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ (ইবাদত যোগ্য বা উপাস্য) কেউ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর রাসূল...।’’[7]

হাদীস শরীফে সর্বদা ‘বিশ্বাস’ বা ধর্মবিশ্বাসকে ঈমান নামেই অভিহিত করা হয়েছে। এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন:

كَانَ النَّبِيُّ সাঃ بَارِزًا يَوْمًا لِلنَّاسِ فَأَتَاهُ رجل (جِبْرِيلُ) فَقَالَ: يا رسول الله، مَا الإِيمَانُ؟ قَالَ: الإِيمَانُ أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَبِلِقَائِهِ وَرُسُلِهِ وَتُؤْمِنَ بِالْبَعْثِ الآخر، وتؤمن بالقدر كله. قَالَ: مَا الإِسْلامُ؟ قَالَ: الإِسْلامُ أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ وَلا تُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَتُقِيمَ الصَّلاةَ وَتُؤَدِّيَ الزَّكَاةَ الْمَفْرُوضَةَ وَتَصُومَ رَمَضَانَ

‘‘একদিন নবী (ﷺ) লোকজনের মধ্যে ছিলেন। এমতাবস্থায় একব্যক্তি (জিবরাঈল আ.) তাঁর নিকট আগমন করে বলেন, ঈমান কী? তিনি উত্তরে বলেন: (ঈমান এই যে,) তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহয়, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর পুস্তকসমূহে, তাঁর সাক্ষাতে, তাঁর রাসূলগণে এবং তুমি বিশ্বাস করবে শেষ পুনরুত্থানে এবং তুমি বিশ্বাস করবে তাকদীর বা নির্ধারণের সবকিছুতে। তিনি প্রশ্ন করেন: ইসলাম কী? তিনি বলেন: ইসলাম এই যে, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, কোনো কিছুকে তাঁর সাথে শরীক বানাবে না, সালাত কায়েম করবে, ফরয যাকাত প্রদান করবে এবং রামাদানের সিয়াম পালন করবে।’’[8]

এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঈমান ও ইসলামের উভয়ের পরিচিত প্রদান করেছেন। ইসলাম শব্দটি আরবী ‘সালাম’ (سلم) শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সমর্পন ইত্যাদি। ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পন করা, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। আভিধানিক ভাবে ঈমান বিশ্বাসের দিক এবং ইসলাম কর্মের দিক। তবে ব্যবহারিক ভাবে ঈমান ও ইসলাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এ বিষয়ে আমরা ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) বলেন:

والإيمان هو الإقرار والتصديق، وإيمان أهل السماء والأرض لا يزيد ولا ينقص من جهة المؤمن به، ويزيد وينقص من جهة اليقين والتصديق. والمؤمنون مستوون في الإيمان والتوحيد متفاضلون بالأعمال. والإسلام هو التسليم والانقياد لأوامر الله  تعالي. فمن طريق اللغة فرق بين الإيمان والإسلام. ولكن لا يكون إيمان بلا إسلام، ولا يوجد إسلام بلا إيمان، وهما كالظهر مع البطن، والدين اسم واقع علي الإيمان والإسلام والشرائع كلها

‘‘ঈমান হচ্ছে (মুখের) স্বীকৃতি ও (অন্তরের) সত্যায়ন। বিশ্বাসকৃত বিষয়াদির দিক থেকে (যে যে বিষয়ে বিশ্বাস করা হয়েছে তাতে) আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীদের ঈমান বাড়ে না এবং কমে না, কিন্তু ইয়াকীন বা বিশ্বাসের দৃঢ়তা-গভীরতা ও সত্যায়নের দিক থেকে ঈমান বাড়ে এবং কমে।  এভাবে ঈমান ও তাওহীদের ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। কর্মের ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। ইসলাম অর্থ আল্লাহর নির্দেশের জন্য আত্মসমর্পন করা এবং অনুগত হওয়া। আভিধানিকভাবে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তবে বাস্তবে ও ব্যবহারে ইসলাম ছাড়া কোনো ঈমান হয় না এবং ঈমান ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কাজেই ঈমান ও ইসলাম হলো পিঠের সাথে পেটের ন্যায়। ঈমান, ইসলাম ও সমস্ত শরীয়তকে একত্রে দীন বলা হয়।’’[9]

বিভক্তি ও ফিরকাসমূহের আলোচনায় আমরা দেখব যে, ঈমান ও আমলের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ ছিল বিভক্তির কারণগুলির অন্যতম। খারিজীগণ ও তাদের সমমনা ফিরকাগুলি আমল বা ইসলামের বিধান মত কর্ম করাকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে গণ্য করেছে। ফলে বিধান পালনের বিচ্যুতি তাদের মতে ঈমানের বিচ্যুতি বা কুফর বলে গণ্য। অপরদিকে মুরজিয়াগণ ঈমানকে আল্লাহর নির্দেশ পালন বা ইসলামের বিধিবিধান পালন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেছে। তাদের মতে কোনোরূপ ইসলাম পালন ছাড়াই ঈমানের চূড়ান্ত পূর্ণতায় পৌঁছানো সম্ভব। তারা পাপী মুসলিমকে পরিপূর্ণ ঈমানদার ও নিশ্চিত জান্নাতী বলে গণ্য করেছে। উভয় মতের মধ্যে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারীগণ বিশ্বাস করেন যে, পাপী মুমিন কাফির নন, আবার ঈমানের পূর্ণতাও তিনি লাভ করেন নি। তবে এ বিশ্বাসের ব্যাখ্যায় আহলুস সুন্নাতের ইমামগণের পারিভাষিক সংজ্ঞার মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের দুটি মত রয়েছে।

(১) ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও অন্যান্য কোনো কোনো ইমামের মতে আমল বা বিধান পালন ঈমানের অংশ নয়, বরং ঈমানের দাবি ও সম্পূরক। তাদের মতে ঈমান হলো অন্তরের বিশ্বাস ও মুখে সে বিশ্বাসের স্বীকৃতির নাম। তাদের মতে বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে স্বীকৃতি বেশি কম হয় না বা ঈমানের হ্রাসবৃদ্ধি হয় না, তবে বিশ্বাসের গভীরতার দিক দিয়ে হ্রাসবৃদ্ধি হয়।

(২) অন্য তিন ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ বলেন যে, আমল বা কর্ম ঈমানের অংশ, তবে মনের বিশ্বাস বা মুখের স্বীকৃতির মত অংশ নয়, বরং দ্বিতীয় পর্যায়ের অংশ। এজন্য তাদের মতে কর্মের অনুপস্থিতি দ্বারা ঈমানের অনুপস্থিতি প্রমাণিত হয় না, তবে দুর্বলতা ও কমতি প্রমাণিত হয়। তাঁর বলেন ঈমান হলো অন্তরের বিশ্বাস, মুখের স্বীকৃতি ও দেহের কর্ম। এদের মতে কর্মের কারণে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।

এ দু মতের মধ্যে শব্দ প্রয়োগে যতই পার্থক্য থাক না কেন, মূল বিশ্বাসে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ উভয় মতের অনুসারিগণই একমত যে,

(১) ঈমান ও আমল দুটিই আল্লাহর নির্দেশ এবং বান্দাকে দুটিই অর্জন করতে হবে। ঈমান বিহীন ইসলাম বা ইসলাম বিহীন ঈমান অকল্পনীয়।

(২) কর্মের ত্রুটির কারণে বা কবীরা গোনাহের কারণে বান্দা কাফির হয় না, তবে আল্লাহর শাস্তির যোগ্য হবে।

[1] ইবনু ফারিস, আহমদ (৩৯৫হি), মু’জামু মাকায়িসিল লুগাহ ১/১৩৩।
[2] প্রাগুক্ত ১/১৩২-১৩৩।
[3] সূরা (৩০) রূম : ৫৬ আয়াত।
[4] সূরা (৫) মায়িদা: ৫ আয়াত।
[5] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৯৩ আয়াত।
[6] সূরা (৮) আনফাল: ২ আয়াত।
[7] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৯, ৪৫, ৪/১৫৮৮, ৬/২৬৫২, ২৭৪৭; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৭।
[8] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৭, ৪/১৭৩৩; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৯, ৪০, ৪৭।
[9] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৪১-১৫০।