ইসলাম কিউ এ ফতোয়া সমগ্র ইসলামী আইন ও এর মূলনীতি শাইখ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ ১ টি
অন্য কোন রাত্রিতে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় না করে শুধু লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করার বিধান কি?

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।

এক:

লাইলাতুল কদর বা ভাগ্য রজনীতে ইবাদত করার মহান ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। আমাদের মহান প্রতিপালক উল্লেখ করেছেন যে, এই রজনী হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লেখ করেছেন যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে ও প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল কদরে নামায পড়বে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

১. নিশ্চয়ই আমি এটি নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। ২. তোমাকে কিসে জানাবে লাইলাতুল ক্দর কি? ৩. লাইলাতুল ক্দর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। ৪. সে রাতে ফেরেশতারা ও রূহ (জিবরাইল) তাঁদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করেন। ৫. শান্তিময় সেই রাত, ফজরের সূচনা পর্যন্ত।” [সূরা আল কদর, ৯৭: ১-৫]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে এবং প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল ক্দরে নামায পড়বে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”[সহীহ বুখারী (১৯০১) ও মুসলিম (৭৬০)]হাদিসে “ঈমান সহকারে” কথাটির অর্থ হচ্ছে- এই রাতের মর্যাদা ও বিশেষ আমল শরিয়তসম্মত হওয়ার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। আর “প্রতিদানের আশা” কথাটির অর্থ হচ্ছে- নিয়্যতকে আল্লাহ তাআলার জন্য একনিষ্ঠ করা।

দুই :

কোন রাতটি লাইলাতুল ক্দর তা নিয়ে ‘আলেমদের মাঝে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। ‘ফাত্হুল বারী’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে এ সংক্রান্ত অভিমত ৪০ টির উপরে পৌঁছেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সঠিক মত হল লাইলাতুল কদর রমজান মাসের শেষ দশকের কোন এক বেজোড় রাত।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্দর অনুসন্ধান কর।”[সহীহ বুখারী (২০১৭) ও সহীহ মুসলিম (১১৬৯), তবে শব্দচয়ন ইমাম বুখারী]

ইমাম বুখারী এই হাদিসটির শিরোনাম লিখেছেন “রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত লাইলাতুল ক্দর অনুসন্ধান”।

এই রাতটি গোপন রাখার পেছনে রহস্য হল মুসলমানদেরকে রমজানের শেষ দশকের সবগুলো রাতে ‘ইবাদত-বন্দেগী, দোয়া ও যিকিরের উপর সক্রিয় রাখা। একই রহস্যের কারণে জুমার দিনের যে সময়টিতে দোয়া কবুল হয় তা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি এবং একই কারণে আল্লাহর ঐ ৯৯ টি নাম সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি যে নামগুলোর ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি নামগুলো গণনা করবে [অর্থাৎ মুখস্ত করবে, এর অর্থ বুঝবে এবং সে অনুযায়ী আমল করবে] সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[সহীহ বুখারী (২৭৩৬) ও সহীহ মুসলিম (২৬৭৭)]

হাফেজ ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন:

“তাঁর বক্তব্য অর্থাৎ ইমাম বুখারীর বক্তব্য “পরিচ্ছেদ: রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্দর অনুসন্ধান” এই শিরোনাম থেকে লাইলাতুল ক্দর রমজান মাসে হওয়া, রমজানের শেষ দশকে হওয়া এবং শেষ দশকের বেজোড় কোন রাতে হওয়ার ব্যাপারে প্রবল ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে সেটি কোন রাত- এমন কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। এ সংক্রান্ত হাদিসের বর্ণনাগুলো একত্রিত করলে এতটুকু প্রমাণই ফুটে উঠে।” [ফাতহুল বারী (৪/২৬০)]

তিনি আরও বলেছেন :

‘আলেমগণ বলেন, এই রাতটির নির্দিষ্ট তারিখ গোপন রাখার পিছনে হিকমত হল মানুষ যেন এ রাতের মর্যাদা লাভের জন্য চেষ্টা সাধনা করে। নির্দিষ্ট তারিখ জানা থাকলে মানুষ শুধু নির্দিষ্টভাবে সেই রাতে ইবাদত-বন্দেগী করত। একই ধরনের ব্যাখ্যা জুমার দিনের (দোয়া কবুলের) সুনির্দিষ্ট সময় গোপন রাখার ব্যাপারে ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।” [ফাত্হুল বারী (৪/২৬৬)]

তিন:

পূর্বোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, কারো পক্ষে নির্দিষ্ট কোন রাতের ব্যাপারে এ নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয় যে, এটিই ‘লাইলাতুল ক্দর’। বিশেষতঃ যখন আমরা জানি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটি কোন রাত তা সুনির্দিষ্টভাবে উম্মতকে জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি জানিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা এর জ্ঞান উঠিয়ে নিয়েছেন।

উবাদা ইবনে সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘লাইলাতুল ক্দর’ এর ব্যাপারে খবর দিতে বের হলেন। এ সময় দু’জন মুসলমান ঝগড়া করছিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :

“আমি আপনাদেরকে ‘লাইলাতুল ক্দর’ এর ব্যাপারে অবহিত করতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তি বিবাদে লিপ্ত হওয়ায় তা (সেই জ্ঞান) উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আশা করি উঠিয়ে নেয়াটা আপনাদের জন্য বেশি ভাল হয়েছে। আপনারা সপ্তম (২৭ তম), নবম (২৯ তম) এবং পঞ্চম (২৫ তম) তারিখে এর সন্ধান করুন।”[সহীহ বুখারী (৪৯)]

ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির আলেমগণ বলেন:

“রমজান মাসে নির্দিষ্ট কোন রাতকে লাইলাতুল ক্দর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সুস্পষ্ট দলীলের প্রয়োজন। তবে অন্যান্য রাতের চেয়ে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোন একটিতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এর মধ্যে ২৭তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন হাদিস থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ বিষয়টি আমরা ইতিপূর্বেও উল্লেখ করেছি।”

[ফাতাওয়াল্‌ লাজনাহ আদ্‌দায়িমা (ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র) (১০/৪১৩)]

তাই একজন মুসলিমের নির্দিষ্ট কোন রাতকে লাইলাতুল ক্দর হিসেবে চিহ্নিত করা উচিৎ নয়। কারণ এতে করে এমন বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়, আসলে যে বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভবপর নয়। এবং এতে করে ব্যক্তি নিজেকে প্রভুত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করার সম্ভাবনা তৈরী হয়। হতে পারে লাইলাতুল কদর ২১তম রাতে অথবা ২৩তম রাতে অথবা ২৯তম রাতে। তাই কেউ যদি শুধু ২৭তম রাতে নামায আদায় করে এতে করে তিনি অফুরন্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবেন এবং এই মুবারকময় রাতের ফজিলত হারাবেন।

সুতরাং একজন মুসলিমের উচিৎ গোটা রমজান জুড়ে আনুগত্য ও ‘ইবাদতের কাজে সর্বোচ্চ সাধনা চালানো। আর শেষ দশকে আরো বেশি তৎপর হওয়া। এটিই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শ। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন : “(রমজানের শেষ) দশ রাত্রি শুরু হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমর বেঁধে নামতেন। তিনি নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং তাঁর পরিবারবর্গকে (ইবাদাতের জন্য) জাগিয়ে দিতেন।” [ সহীহ বুখারী (২০২৪) ও সহীহ মুসলিম (১১৭৪)]

আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

http://islamqa.info/bn/50693