أولا: الاحتفال بمناسبة المولد النبي في ربيع الأول - ১. রবীউল আওয়াল মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম দিবস উপলক্ষে মীলা‏দ মাহফিল উদ্যাপন করা

অমুসলিম ইয়াহূদী-নাসারাদের অনুসরণ থেকেই এসেছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মদিবস উপলক্ষে ঈদে মীলাদুন্ নবীর অনুষ্ঠান। অজ্ঞ মুসলমানেরা এবং একদল গোমরাহ আলেম প্রতি বছর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম উপলক্ষে রবিউল আওয়াল মাসে এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কেউ কেউ মসজিদে এই অনুষ্ঠান করে থাকে। আবার কেউ ঘরে বা এর জন্য প্রস্তুতকৃত স্থানে এ অনুষ্ঠান করে থাকে। আর এতে অসংখ্য সাধারণ লোক উপস্থিত হয়। খ্রিষ্টানরা যেমন ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মদিবস উদযাপন করে থাকে, তাদের অন্ধ অনুসরণ করেই মুসলিমগণ এ অনুষ্ঠান শুরু করেছে।

এ অনুষ্ঠানে বিদআত ও খ্রিস্টানদের সাথে সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার শিরক ও পাপাচার। এতে এমন কিছু কবিতা আবৃতি করা হয়, যাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যাপারে এমন বাড়াবাড়ি রয়েছে, যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দু‘আ করা এবং আশ্রয় প্রার্থনা করা পর্যন্ত নিয়ে যায়। অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন,

«لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ»

‘‘ খ্রিস্টানরা যেমন মারইয়ামের পুত্র ঈসা (আ.) এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা আমার ব্যাপারে সেরূপ বাড়াবাড়ি করো না। আমি কেবলমাত্র আল্লাহর একজন বান্দা। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও রসূল বলো’’।[1]

প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করাকে الإطراء বলা হয়। খ্রিস্টানরা ঈসা (আ.) এর মর্যাদা বাড়াতে বাড়াতে আল্লাহর পুত্র হওয়ার আসনে বসিয়েছিল। আবার কেউ কেউ তাকে স্বয়ং আল্লাহ হিসাবে বিশ্বাস করে তার ইবাদত শুরু করেছে। কেউ বা তাকে তিন আল্লাহর এক আল্লাহ হিসাবে নির্ধারণ করে নিয়েছে। কিছু কিছু বিদআতী নবী প্রেমিক বিশ্বাস করে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। তা ছাড়া এ সমস্ত মীলাদ মাহফিলে যে সব পাপ কাজের চর্চা করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে দলবদ্ধভাবে গান গাওয়া, ঢোল বাজানো এবং সূফীদের বানানো বিদআতী নিয়মে বিভিন্ন যিকির-আযকার করা। কখনও কখনও নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে এ সমস্ত কাজে অংশ নিয়ে থাকে। যার কারণে অনেক সময় অশালীন কাজকর্ম সংঘটিত হওয়ার সংবাদও শুনা যায়। এমনকি যদি এ সমস্ত অনুষ্ঠান এধরণের অশ্লীল কাজ হতে মুক্ত হয় এবং শুধুমাত্র একত্রিত হয়ে খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ-ফুর্তির মাঝে সীমিত থাকে, তথাপিও তা বৈধ নয়। কারণ এটি নব আবিষ্কৃত অনুষ্ঠান। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দীনের ব্যাপারে প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী। তা ছাড়া এতে অন্যান্য অনুষ্ঠানের মত অশ্লীল কাজ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

আমরা মীলাদ অনুষ্ঠানকে বিদআত বলি। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন আপনারা বিদআত বলেন? উত্তর হলো, আল্লাহর কিতাব, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাত, সাহাবীদের আমল এবং সম্মানিত তিন যুগের কোনো যুগে এর কোন অস্তিত্ব ছিল না। তাই আমরা এটাকে বিদআত বলি। কারণ যে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হবে, কুরআন বা সুন্নায় অবশ্যই তার পক্ষে দলীল থাকতে হবে। আর মীলাদ মাহফিলের পক্ষে এ রকম কোন দলীল নেই বলেই এটি এটি বিদআত, যা হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পর তৈরী করা হয়েছে। মিশরের ফাতেমীয় শিয়া শাসকরা এটি সর্বপ্রথম ইসলামের নামে মুসলিমদের মাঝে চালু  করেছে। বিখ্যাত আলেমে দীন ইমাম আবু হাফস্ তাজুদ্দীন ফাকেহানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, একদল লোক আমাদের কাছে বারবার প্রশ্ন করছে যে, কিছু সংখ্যক মানুষ মীলাদের নামে রবীউল আওয়াল মাসে যে অনুষ্ঠান করে থাকে, শরী‘আতে কি এর কোনো ভিত্তি আছে?

প্রশ্নকারীগণ সুস্পষ্ট উত্তর চেয়েছিল। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে উত্তর দিলাম যে, আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতে এর পক্ষে কোনো দলীল পাইনি এবং যে সমস্ত আলেম মুসলিম জাতির জন্য দীনের ব্যাপারে আদর্শ স্বরূপ এবং পূর্ববর্তীদের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী তাদের কারও থেকে এ ধরণের আমলের প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং এই মীলাদ নামের ইবাদতটি একটি জঘণ্য বিদআত, যা দুর্বল ঈমানদার ও পেট পূজারী লোকদের আবিষ্কার মাত্র।

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রহি.) বলেন, এমনি আরও বিদআতের উদাহরণ হল, কিছু সংখ্যক মানুষ হয়ত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম দিবস পালনে খ্রিষ্টানদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে কিংবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান দেখানোর জন্য তার জন্ম দিবসকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঠিক জন্ম তারীখ সম্পর্কে আলেমগণ যথেষ্ট মতবিরোধ করেছেন। সালাফগণ এ ধরণের অনুষ্ঠান করেননি। কাজটি যদি ভালো হত, তাহলে অবশ্যই তারা কাজটি করার দিকে আমাদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী থাকতেন। তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন। তারা ছিলেন ভালো কাজে আমাদের চেয়ে অনেক আগ্রগামী। তবে তাদের ভালোবাসা ও সম্মান ছিল তার অনুসরণ, আনুগত্য, তার আদেশের বাস্তবায়ন এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তার সুন্নাতকে বাস্তবায়ন করার মধ্যেই। তিনি যে দীন নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন, তার প্রচার ও প্রসারের ভিতরে এবং অন্তর-মন, জবান এবং শক্তি দিয়ে সে পথে জিহাদের মাধ্যমে। এটিই ছিল উম্মতের প্রথম যুগের আনসার ও মুহাজির এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারীদের পথ। শাইখুল ইসলামের কথা এখানেই শেষ।

মীলাদ নামের এ বিদআতটির প্রতিবাদে ছোট-বড় অনেক কিতাব রচনা করা হয়েছে। এতে বিদআত ও নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে অন্যান্য মীলাদ অনুষ্ঠানের দ্বার উম্মুক্ত করার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন মাশায়েখ ও নেতাদের মীলাদ পালন করা, যাতে মন্দ কাজের আরো অনেক দরজা খোলার ভয় রয়েছে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। বর্তমানে এ মীলাদ মাহফিল শুধু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম দিবসের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। এখন নেতা-নেত্রী, পীর-ফকীর, শায়েখ-মাশায়েখ এমনকি সাধারণ মানুষের জন্ম দিবসেও মীলাদ মাহফিল উদ্যাপন করা হয়ে থাকে।[2]


[1]. সহীহ বুখারী, হা/৩৪৪৫।

[2]. শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বায (রহি.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা অন্য কারও জন্মোৎসব পালন করা জায়েয নয়, বরং তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কারণ এটি দীনের মাঝে একটি নতুন প্রবর্তিত বিদআত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও এ কাজ করেননি। তার নিজের বা তাঁর পূর্ববর্তী কোন নবী বা তাঁর কোন আত্মীয়, কন্যা, স্ত্রী অথবা কোন সাহাবীর জন্মদিন পালনের নির্দেশ দেননি। খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম অথবা তাবেয়ীদের কেউ এ কাজ করেননি। এমন কি পূর্ব যুগের কোন আলেমও এমন কাজ করেন নি। তারা সুন্নাহ সম্পর্কে আমাদের চেয়ে অধিকতর জ্ঞান রাখতেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার শরীয়াত পালনকে সর্বাধিক ভালবাসতেন। যদি এ কাজটি ছাওয়াবের হত, তাহলে আমাদের আগেই তারা এটি পালন করতেন।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দীন। এ দীন পরিপূর্ণ বিধায় আমাদেরকে তার অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বিদআত (নতুন কিছু সংযোজন করা) থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘আমাদের এই দীনের মাঝে যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, তা প্রত্যাখ্যাত হবে। তিনি আরও বলেন, ‘‘তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত পালন করবে। আর তা দৃঢ়তার সাথে ধারণ করবে। সাবধান! তোমরা দীনের মধ্যে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রত্যেক নব প্রবর্তিত বিষয়ই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা’’। এ সমস্ত হাদীছে বিদআত প্রবর্তনের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ হয়েছে এবং উম্মতকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

‘‘অতএব, যারা তার নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিত্না (বিপর্যয়) তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে। (সূরা নূর: ৬৩) আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেন:

﴿وَمَاَآتاَكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا﴾

‘‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর। এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা থেকে তোমরা বিরত থাক’’। (সূরা হাশর: ৭) আল্লাহ আরও বলেন,

﴿لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُوْلِ اللَّهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الآخِرَ﴾

‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহকে বেশী স্মরণ করে, পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবনীতে এক সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে। (সূরা আহযাব: ২১) আল্লাহ বলেন,

﴿الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمْ الْإِسْلَامَ دِينًا﴾

‘‘আজকের দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসাবে মনোনীত করলাম’’। (সূরা মায়েদা: ৩)

এই আয়াতের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য মনোনীত দীনকে আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাতের পূর্বেই পূর্ণ করে দিয়েছেন। তিনি এই বিষয়টি পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন যে, তার ওফাতের পরে লোকেরা কথায় বা কাজে যে সব নতুন প্রথার উদ্ভাবন করে শরীয়াতের সাথে যুক্ত করবে, তা বিদআত হিসাবে প্রত্যাখ্যাত হবে। যদিও এগুলোর উদ্দেশ্য ভাল হয়। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণ বিদআত থেকে মুসলিম জনগণকে সতর্ক করেছেন ও ভয় প্রদর্শন করেছেন। কেননা এটা ধর্মের ভিতরে অতিরিক্ত সংযোজন, যার অনুমতি আল্লাহ তায়া’লা কোন মানুষকে প্রদান করেন নি। ইহা আল্লাহর দুশমন ইয়াহুদী-খ্রীষ্টান কর্তৃক তাদের ধর্মে নব নব প্রথা সংযোজনের সাথে সামঞ্জস্য স্বরূপ। সুতরাং এরূপ করার অর্থ এই যে, ইসলাম অসম্পূর্ণ ছিল। মীলাদপন্থীরা মীলাদের মাধ্যমে  তা পূর্ণ করে দিলেন। এটা যে কত বড় অপরাধ এবং আল্লাহর বাণীর বিরোধী, তা সর্বজন বিদিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ﴾

‘‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম’’। (সূরা মায়েদা: ৩)

মীলাদ মাহফিল বা নবীর জন্মোৎসব পালন বা এ জাতীয় অন্যান্য উৎসবাদির প্রবর্তনের দ্বারা এ কথাই বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়া’লা এই উম্মতের জন্য ধর্মকে পূর্ণতা দান করেন নি এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উপর অর্পিত রেসালাতের দায়িত্ব পালন করেন নি। (নাউযুবিল্লাহ) পরবর্তীতে মীলাদপন্থীরা এসে তাকে পূর্ণ করে দিয়েছেন। এতে মারাত্মক ভয়ের কারণ রয়েছে এবং এ ধরণের ইবাদত তৈরী করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়া’লা এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর আপত্তি উত্থাপনের শামিল। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য দীনকে সার্বিকভাবে পূর্ণ করত তার নিয়ামত সম্পূর্ণ করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের সুস্পষ্ট বার্তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তিনি এমন কোন পথ, যা জান্নাতের দিকে নিয়ে যায় এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে উম্মতকে তা বলে দিতে কোন প্রকার ত্রুটি করেননি।

এ কথা সকলের জানা যে, আমাদের নবী সকল নবীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ। তিনি সবার চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণভাবে দীনের পয়গাম ও উপদেশ বার্তা পৌঁছিয়েছেন। যদি মীলাদ মাহফিল আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত দীনের অংশ হত, তাহলে তিনি অবশ্যই উম্মতের কাছে বর্ণনা করতেন বা তার সাহাবীগণ তা করতেন। যেহেতু এমন কিছু পাওয়া যায় না, তাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের সাথে এই মীলাদ মাহফিলের কোন সম্পর্ক নেই বরং এটা বিদআত, যা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে সাবধান থাকতে বলেছেন।

যদি আমরা এই মীলাদ মাহফিলের বিষয়টি সম্পর্কে কুরআন মাযীদের দিকে ফিরে যাই, তাহলে দেখতে পাই আল্লাহ তায়া’লা তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যা আদেশ করেছেন বা যা থেকে নিষেধ করেছেন, তিনি আমাদেরকে তা অনুসরণ করার আদেশ দিয়েছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি এই দীনকে উম্মতের জন্য পূর্ণতা দান করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তার মধ্যে মীলাদ মাহফিলের কোন ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। এভাবে যদি আমরা সুন্নাতের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাজ করেন নি, এর আদেশও দেন নি। এমন কি তার সাহাবীগণও তা করেন নি। তাই আমরা বুঝতে পারি যে, এটা ধর্মীয় কাজ নয় বরং ইয়াহূদী-খ্রীষ্টানদের উৎসব সমূহের অন্ধ অনুকরণ মাত্র। যে ব্যক্তির সামান্যতম বিচক্ষণতা আছে এবং হক গ্রহণে ও তা বুঝার সামান্য আগ্রহ রাখে, তার বুঝতে কোন অসুবিধা হবে না যে, ধর্মের সাথে মীলাদ মাহফিল বা যাবতীয় জন্ম বার্ষিকী পালনের কোন সম্পর্ক নেই। বরং যে বিদআতসমূহ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন, এটি সেগুলোরই অন্তর্ভূক্ত।

বিভিন্ন স্থানে অধিক সংখ্যক লোক এই বিদআতী কাজে লিপ্ত দেখে কোন বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে প্রবঞ্চিত হওয়া সংগত নয়। কেননা সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে সঠিক পথ জানা যায়না। বরং শরীয়াতের দলীলের মাধ্যমে তা অনুধাবন করা হয়।

এই মীলাদ মাহফিলসমূহ বিদআত হওয়ার সাথে সাথে অনেক এলাকায় অন্যান্য পাপের কাজ থেকেও মুক্ত নয়। যেমন নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা, গান-বাজনা ও মাদক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি। সর্বোপরি এসব মাহফিলে শির্কে আকবার তথা বড় ধরণের শিরকও সংঘটিত হয়ে থাকে। আর তা হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অন্যান্য আওলীয়ায়ে কেরামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা, তাদের কাছে দু’আ করা, সাহায্য ও বিপদে মুক্তির প্রার্থনা করা এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে তারা গায়েবের খবর জানেন। এই সমস্ত কাজ করলে মানুষ কাফের হয়ে যায়।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অনেক লোক এ ধরণের বিদআতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই তৎপর ও সচেষ্ট এবং এর পিছনে যুক্তি-প্রমাণ দাঁড় করাতে প্রস্তুত। এ ধরণের অনুষ্ঠানের পিছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। অথচ তারা নামাযের জামা‘আত ও জুমআতে অনুপস্থিত থাকাতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করে না। যদিও আল্লাহ তা’আলা এ আমলগুলো পালন করা ওয়াজিব করেছেন। তারা এটাও উপলদ্ধি করে না যে, সালাতের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ছেড়ে দিয়ে তারা চরম অন্যায় করছে। নিঃসন্দেহে এটা দুর্বল ঈমান এবং পাপাচারের মাধ্যমে অন্তরকে কুলষিত করে নেয়ার পরিচয় বহন করে।

আরো বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, অনেকের ধারণা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। তাই তারা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে দাঁড়িয়ে যায়। এটা বিরাট মূর্খতা ও অসত্য ছাড়া অন্য কিছু নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত দিবসের পূর্বে আপন কবর থেকে বের হবেন না বা কারো সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবেন না এবং কোন সমাবেশেও উপস্থিত হবেন না; বরং কিয়ামত পর্যন্ত অন্যান্য নবীদের মতই স্বীয় কবরে অবস্থান করবেন এবং তাঁর পবিত্র রূহ মোবারক প্রভুর নিকট উর্ধাকাশে ইলিস্নয়ীনের সম্মানজনক স্থানে সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ثُمَّ اِنَّكُمْ بَعْدَ ذَلِكَ لَمَيِّتُوْنَ ثُمَّ اِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تُبْعَثُوْنَ﴾

‘‘এরপর তোমাদেরকে অবশ্যই মরতে হবে। অতঃপর কিয়ামতের দিনে পুনরায় জীবিত করা হবে’’। (সূরা মুমিনুন: ১৬) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমার কবরই সর্বপ্রথম উন্মুক্ত করা হবে। আমিই প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশ সবার আগে গৃহীত হবে।

   রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর দুরূদ পাঠ করা ও সালাম পাঠ করা নিঃসন্দেহে একটি ভাল আমল এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক উত্তম পন্থা। যেমন আল্লাহ তায়া’আলা বলেছেন,

﴿اِنَّ اللّهَ وَ مَلَائِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى النَّبِيِّ يَاَيُّهَا الَّذِيْنَ اَمَنُوْا صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا﴾

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দুরূদ পাঠান। হে মুমেনগণ! তোমরাও তার উপর দরূদ ও সালাম প্রেরণ করো’’। (সূরা আহযাব: ৫৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠায়, আল্লাহ তার প্রতিদান স্বরূপ তার উপর দশবার রহমত নাযিল করেন।

সব সময়ই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর দুরূদ পড়ার বৈধতা রয়েছে। তবে সালাতের শেষে পড়ার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে, বরং সালাতের মধ্যে শেষ তাশাহ্হুদে দুরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। অনেক ক্ষেত্রে এই দুরূদ পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদা। যেমন আযানের পরে, জুমু‘আর দিনে ও রাতে এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম উল্লেখ হলে। এব্যাপারে অনেক হাদীছ রয়েছে।

এরূপ বিদআতী অনুষ্ঠান এমন সব মুসলমান দ্বারাও সংঘটিত হচ্ছে , যারা তাদের আকীদা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ভালবাসার ব্যাপারে খুবই দৃঢ়তা রাখে। তাকে বলতে হবে, যদি তুমি সুন্নী ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসারী হওয়ার দাবী রাখ, তাহলে বল, তিনি স্বয়ং বা তার কোন সাহাবী বা তাদের সঠিক অনুসারী কোন তাবেয়ী কি এ কাজটি করেছেন? না এটা ইয়াহূদী-খ্রীষ্টান বা তাদের মত আল্লাহর অন্যান্য শত্রুদের অন্ধ অনুকরণ? এ ধরণের মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ভালবাসা প্রতিফলিত হয় না। যা করলে ভালবাসা প্রতিফলিত হয়, তা হল তার নির্দেশের অনুসরণ করা, তিনি যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করা, যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করা। আল্লাহ যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, কেবল সেভাবেই তার উপাসনা করা।

কুরআন ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং খোলাফায়ে রাশেদীন ও তাবেয়ীদের প্রদর্শিত পথে চলার ভিতরেই রয়েছে মুসলমানদের জন্য ইহ ও পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তি।