জেনে রাখুন যে, কবর থেকে পুনরুত্থানের প্রমাণ রয়েছে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতে। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এবং অবিকৃত সৃষ্টিগত স্বভাব দ্বারাও এটি সাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা তার মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে সংবাদ দিয়েছেন এবং এ মর্মে দলীল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অনেক আয়াতে তিনি পুনরুত্থান অস্বীকারকারীদের প্রতিবাদ করেছেন। শুধু তাই নয়; সমস্ত নবী-রসূল তাদের নিজ নিজ জাতির লোকদেরকে পুনরুত্থান সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন এবং বিরুদ্ধবাদীদেরকে তার প্রতি ঈমান আনয়নের দাবি করেছেন। আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সর্বশেষ নবী ছিলেন, তাকে যেহেতু কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে প্রেরণ করা হয়েছে, তাই তিনি আখিরাতের বিষয়গুলোর এমন সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, যা পূর্ববর্তী অন্যান্য আসমানী কিতাবে পাওয়া যায় না। কিয়ামতে কুবরা তথা বড় কিয়ামতের বিষয়টি আদম, নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবী আলাইহিমুস সালামের নিকট পরিচিত ছিল।

আল্লাহ তা‘আলা আদমকে যখন দুনিয়াতে নামিয়ে দিলেন তখন তিনি বলেছেন,

          ﴿اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ۖ وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَىٰ حِينٍ قَالَ فِيهَا تَحْيَوْنَ وَفِيهَا تَمُوتُونَ وَمِنْهَا تُخْرَجُونَ﴾

‘‘তোমরা নেমে যাও, তোমরা পরষ্পরের শত্রু এবং তোমাদের জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত পৃথিবীতেই রয়েছে বসবাসের জায়গা ও জীবন যাপনের উপকরণ। তোমরা পৃথিবীতে জীবন যাপন করবে, সেখানেই মৃত্যু বরণ করবে এবং সেখান থেকেই পুনরুত্থিত হবে।’’। (সূরা আল-বাকারা: ৩৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿فِيهَا تَحْيَوْنَ وَفِيهَا تَمُوتُونَ وَمِنْهَا تُخْرَجُونَ﴾

‘‘সেখানেই তোমাদের জীবন যাপন করতে হবে এবং সেখানেই মরতে হবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের সবশেষে আবার বের করে আনা হবে’’। (সূরা আরাফ: ২৫) অভিশপ্ত ইবলীস যখন বললো,

   ﴿رَبِّ فَأَنظِرْنِي إِلَىٰ يَوْمِ يُبْعَثُونَ قَالَ فَإِنَّكَ مِنَ الْمُنظَرِينَ إِلَىٰ يَوْمِ الْوَقْتِ الْمَعْلُومِ﴾

‘‘হে আমার রব! এ কথাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এদেরকে যখন পুনরায় উঠানো হবে সে সময় পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দাও। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে সেদিন পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হলো  যার সময় আমি জানি’’। (সূরা আল-হিজর: ৩৬-৩৮)

নূহ আলাইহিস সালাম তার লোকদেরকে বলেছেন,

﴿وَاللَّهُ أَنبَتَكُم مِّنَ الْأَرْضِ نَبَاتًا ثُمَّ يُعِيدُكُمْ فِيهَا وَيُخْرِجُكُمْ إِخْرَاجًا﴾

‘‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে মাটি থেকে বিস্ময়কর রূপে উৎপন্ন করেছেন। আবার এ মাটির মধ্যে তোমাদের ফিরিয়ে নেবেন এবং এ মাটি থেকেই তোমাদের বের করে আনবেন’’। (সূরা নূহ: ১৭-১৮) ইবরাহীম (আ.) তার জাতির লোকদেরকে বলেছেন:

﴿وَالَّذِي أَطْمَعُ أَن يَغْفِرَ لِي خَطِيئَتِي يَوْمَ الدِّينِ ﴾

‘‘আর তার কাছে আমি আশা করি, প্রতিদান দিবসে তিনি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন’’। (সূরা শুআরা: ৮২) আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আ.) এর কথা উল্লেখ করে কুরআনে বলেন,

 ﴿إِنَّ السَّاعَةَ آتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيهَا لِتُجْزَىٰ كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَىٰ فَلَا يَصُدَّنَّكَ عَنْهَا مَن لَّا يُؤْمِنُ بِهَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَتَرْدَىٰ﴾

‘‘কিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তার সময়টা গোপন রাখতে চাই, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তিই তার প্রচেষ্টা অনুযায়ী প্রতিদান লাভ করতে পারে। কাজেই যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনেনা এবং নিজের প্রবৃত্তির দাস হয়ে গেছে সে যেন তোমাকে সে সময়ের চিন্তা থেকে নিবৃত্ত না করে। অন্যথায় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে’’। (সূরা তোহা: ১৫-১৬)

মূসা (আ.) তার কাওমের লোকদের উদ্দেশ্যে আরো বলেছেন,

   ﴿وَاكْتُبْ لَنَا فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ إِنَّا هُدْنَا إِلَيْكَ ۚ قَالَ عَذَابِي أُصِيبُ بِهِ مَنْ أَشَاءُ وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ ۚ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالَّذِينَ هُم بِآيَاتِنَا يُؤْمِنُونَ﴾

‘‘আর আমাদের জন্য এ দুনিয়ার কল্যাণ লিখে দাও এবং আখিরাতেরও, আমরা তোমার দিকে ফিরেছি। জবাবে বলা হলো, শাস্তি তো আমি যাকে চাই তাকে দিয়ে থাকি কিন্তু আমার অনুগ্রহ সব জিনিষের উপর পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। কাজেই তা আমি এমন লোকদের নামে লিখবো যারা নাফরমানী থেকে দূরে থাকবে, যাকাত দেবে এবং আমার আয়াতের প্রতি ঈমান আনবে’’। (সূরা আরাফ: ১৫৬)

আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, কাফেরদেরকে যখন জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে, তখন তারা স্বীকার করবে যে, রসূলগণ তাদেরকে এ দিন সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

  ﴿أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَتْلُونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِ رَبِّكُمْ وَيُنذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَٰذَا ۚ قَالُوا بَلَىٰ وَلَٰكِنْ حَقَّتْ كَلِمَةُ الْعَذَابِ عَلَى الْكَافِرِينَ﴾

‘‘তোমাদের কাছে কি তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে রসূলগণ আসেননি যারা তোমাদেরকে তোমাদের রবের আয়াতসমূহ শুনিয়েছেন এবং এ বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছেন যে, একদিন তোমাদেরকে এ দিনটির সম্মুখীন হতে হবে? তারা বলবে, হ্যাঁ, এসেছিল। কিন্তু আযাবের সিদ্ধান্ত কাফেরদের জন্য অবধারিত হয়ে গেছে’’। (সূরা যুমার: ৭১)

সুতরাং সবশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত দিবসের যে সংবাদ দিয়েছেন, সমস্ত নবী-রসূলই সে সংবাদ প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, শিঙ্গা তৃতীয়বার ফুঁ দেয়ার সময় মৃতগণ তাদের কবর থেকে বের হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ﴾

‘‘অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। তৎক্ষনাৎ তারা দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে’’। (সূরা যুমার: ৬৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُم مِّنَ الْأَجْدَاثِ إِلَىٰ رَبِّهِمْ يَنسِلُونَ﴾

‘‘তারপর শিংগায় ফুঁ দেয়া হবে এবং সহসা তারা নিজেদের রবের সামনে হাযির হবার জন্য নিজেদের কবর থেকে বের হবে’’। (সূরা ইয়াসীন: ৫১)

ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ছা’লাবীর তাফসীরে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে সূরা যুমারের তাফসীরে মারফু হিসাবে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা যমীনে বৃষ্টি প্রেরণ করবেন। চল্লিশ দিন পর্যন্ত যমীনে বৃষ্টিপাত হতে থাকবে। এতে তাদের উপর ১২ হাত পানি জমে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মানুষদের দেহগুলোকে শাক-সবজি ও তৃণলতা উদ্গত হওয়ার ন্যায় অঙ্কুরিত হওয়ার আদেশ দিবেন। দেহুগুলো যখন পূর্বের ন্যায় পূর্ণতা লাভ করবে, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আরশ বহনকারী ফেরেশতাদেরকে জীবিত হওয়ার আদেশ দিবেন। জিবরীল, মীকাঈল, ইসরাফীল, মালাকুল মাওতকেও জীবিত হওয়ার আদেশ দিবেন। তারা জীবিত হলে ইসরাফীলকে শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার আদেশ দিলে তিনি তাতে মুখ লাগাবেন। অতঃপর তিনি রূহ সমূহকে ডাক দিবেন। সমস্ত রূহকে আনয়ন করা হবে। মুমিনদের রূহসমূহ নূর চমকাতে থাকবে এবং কাফের ও মুনাফেকদের রূহসমূহ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকবে। ইসরাফীল সবগুলো রূহকে শিঙ্গার ভিতর ঢুকাবেন।

অতঃপর তাকে শিঙ্গায় পুনরূত্থানের ফুঁ দেয়ার আদেশ দেয়া হবে। এতে সমস্ত রূহ মৌমাছির ন্যায় শিঙ্গা থেকে বের হয়ে আসমান-যমীনের মধ্যকার ফাঁকা জায়গা পরিপূর্ণ করে ফেলবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, আমার বড়ত্ব ও মর্যাদার শপথ! প্রত্যেক রূহ নিজ নিজ দেহে চলে যাও। রূহগুলো তখন প্রত্যেকের নাকের ছিদ্র দিয়ে নিজ নিজ দেহের মধ্যে প্রবেশ করবে। অতঃপর সাপে কাটা রোগীর শরীরের সর্বত্র যেমন বিষ ছড়িয়ে পড়ে সেভাবেই দেহের সর্বত্র রূহ সঞ্চালিত হবে। অতঃপর দ্রুততার সাথে যমীনকে বিদীর্ণ করা হবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার কবরই সর্বপ্রথম বিদীর্ণ করা হবে। অতঃপর তোমরা সকলেই কবর থেকে তোমাদের প্রভুর নিকট দ্রুত উপস্থিত হবে।

ইমাম বুখারী ও মুসলিম আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

ثُمَّ يُنْزِلُ اللَّهُ مِنْ السَّمَاءِ مَاءً فَيَنْبُتُونَ كَمَا يَنْبُتُ الْبَقْلُ لَيْسَ مِنْ الْإِنْسَانِ شَيْءٌ إِلَّا يَبْلَى إِلَّا عَظْمًا وَاحِدًا وَهُوَ عَجْبُ الذَّنَبِ وَمِنْهُ يُرَكَّبُ الْخَلْقُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ»

‘‘অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। সেখানে তারা এমনভাবে বেড়ে উঠবে যেমনভাবে বীজ থেকে তৃণলতা উদ্গত হয়। বনী আদমের দেহের অংশ ‘আজবুয যানাব’ ব্যতীত সবকিছুই যমীন খেয়ে ফেলে। এ থেকেই বনী আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং কিয়ামতের দিন এ থেকেই তাকে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে’’।[1]

সহীহ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় এসেছে, মানুষের শরীরের একটি হাড্ডী আছে, যা মাটি কখনো খেতে পারে না। এ থেকেই কিয়ামতের দিন সৃষ্টিকে পুনর্বার সৃষ্টি করা হবে। লোকেরা বললো, ইয়া রসূলাল্লাহ! এটি কোন্ হাড্ডী? তিনি বললেন, এটি হলো আজবুয যানাব। আলেমগণ বলেছেন, পিঠের একদম নীচের ক্ষুদ্রতম হাড্ডীর নাম হলো আজবুয যানাব। হাদীছে এসেছে যে, এটি হলো সরিষার দানার মত। এ থেকে মানুষের শরীর নতুনভাবে তৈরী হবে। মুশরেকরা মৃত্যুর পর মানুষকে পুনরায় নতুন জীবনে সৃষ্টি করার বিষয়কে অসম্ভব মনে করেছিল। তাই তারা পুনরুত্থান ও পুনর্জীবনকে অস্বীকার করেছিল।

আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে পুনরুত্থানের কথা শপথ করে বলার আদেশ দিয়েছেন যে, এটি সংঘটিত হবেই। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَأْتِينَا السَّاعَةُ قُلْ بَلَىٰ وَرَبِّي لَتَأْتِيَنَّكُمْ عَالِمِ الْغَيْبِ لَا يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ وَلَا أَصْغَرُ مِن ذَٰلِكَ وَلَا أَكْبَرُ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ﴾

‘‘কাফেররা বলে, আমাদের উপর কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে না। হে নবী! তুমি বলো, আমার রবের শপথ, তা তোমাদের উপর অব্যশই আসবে। তিনি গায়েবের সকল খবর রাখেন। তার কাছ থেকে অণু পরিমাণ কোনো জিনিস আকাশসমূহে লুকিয়ে নেই এবং পৃথিবীতেও না। অণুর চেয়ে বড়ই হোক কিংবা তার চেয়ে ছোটই হোক, সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা আছে’’। (সূরা সাবা: ৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَيَسْتَنبِئُونَكَ أَحَقٌّ هُوَ قُلْ إِي وَرَبِّي إِنَّهُ لَحَقٌّ وَمَا أَنتُم بِمُعْجِزِينَ﴾

‘‘তারপর তারা জিজ্ঞেস করে যে, তুমি যা বলছো তা কি যথার্থই সত্য? বলো: আমার রবের শপথ! এটা যথার্থই সত্য এবং এর প্রকাশ হবার পথে বাধা দেবার মতো শক্তি তোমাদের নেই’’। (সূরা ইউনুস: ৫৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿زَعَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَن لَّن يُبْعَثُوا قُلْ بَلَىٰ وَرَبِّي لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ وَذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ﴾

‘‘কাফেররা দাবী করে বলেছে যে, মরার পরে আর কখনো তাদের জীবিত করে উঠানো হবেনা। হে নবী! তুমি তাদের বলে দাও, আমার রবের শপথ, তোমাদের অবশ্যই উঠানো হবে। তারপর তোমরা যা করেছো তা অবশ্যই তোমাদেরকে অবহিত করা হবে। এরূপ করা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ’’। (সূরা তাগাবুন: ৭)

কিয়ামত অতি নিকটবর্তী হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانشَقَّ الْقَمَرُ﴾

‘‘কিয়ামতের সময় নিকটবর্তী হয়েছে এবং চাঁদ বিদীর্ণ হয়েছে’’। (সূরা কামার: ১)


আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿اقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مُّعْرِضُونَ﴾

‘‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় এসে গেছে, অথচ সে গাফিলতির মধ্যে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আছে’’। (সূরা আম্বীয়া: ১)

পুনরুত্থান অস্বীকারকারীদেরকে দোষারোপ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِلِقَاءِ اللَّهِ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ﴾

‘‘প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকে মিথ্যা বলেছে তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং তারা মোটেই সঠিক পথে ছিল না’’। (সূরা ইউনুস: ৪৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿أَلَا إِنَّ الَّذِينَ يُمَارُونَ فِي السَّاعَةِ لَفِي ضَلَالٍ بَعِيدٍ﴾

‘‘জেনে নাও, যারা সে সময়ের আগমণের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি করার জন্য বিতর্ক করে তারা গোমরাহীর মধ্যে বহুদূর অগ্রসর হয়েছে’’। (সূরা শুরা: ১৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى وَجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمًّا مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ كُلَّمَا خَبَتْ زِدْنَاهُمْ سَعِيرًا ذَٰلِكَ جَزَاؤُهُم بِأَنَّهُمْ كَفَرُوا بِآيَاتِنَا وَقَالُوا أَإِذَا كُنَّا عِظَامًا وَرُفَاتًا أَإِنَّا لَمَبْعُوثُونَ خَلْقًا جَدِيدًا أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ قَادِرٌ عَلَىٰ أَن يَخْلُقَ مِثْلَهُمْ وَجَعَلَ لَهُمْ أَجَلًا لَّا رَيْبَ فِيهِ فَأَبَى الظَّالِمُونَ إِلَّا كُفُورًا﴾

‘‘আমি কিয়ামতের দিন তাদের সমবেত করবো তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায় এবং অন্ধ, বোবা ও বধির অবস্থায়। তাদের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। যখনই জাহান্নামের অগ্নি নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে তখনই আমি তাদের জন্য অগ্নি আরো বৃদ্ধি করে দিব। এটি হচ্ছে তাদের এ কাজের প্রতিদান যে, তারা আমার নিদর্শন অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, যখন আমরা হাড় ও মাটি হয়ে যাবো তখন কি আবার আমাদের নতুন করে সৃষ্টি করে উঠানো হবে? তারা কি খেয়াল করেনি, যে আল্লাহ পৃথিবী ও আকাশম-লী সৃষ্টি করেছেন তিনি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করার অবশ্যই ক্ষমতা রাখেন? তিনি তাদের জন্য একটি সময় নির্ধারণ করে রেখেছেন, যার আগমন অবধারিত। কিন্তু যালেমরা অস্বীকার না করে ক্ষান্ত হলো না’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৯৭-৯৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

﴿وَقَالُوا أَإِذَا كُنَّا عِظَامًا وَرُفَاتًا أَإِنَّا لَمَبْعُوثُونَ خَلْقًا جَدِيدًا قُلْ كُونُوا حِجَارَةً أَوْ حَدِيدًا أَوْ خَلْقًا مِّمَّا يَكْبُرُ فِي صُدُورِكُمْ ۚ فَسَيَقُولُونَ مَن يُعِيدُنَا ۖ قُلِ الَّذِي فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ ۚ فَسَيُنْغِضُونَ إِلَيْكَ رُءُوسَهُمْ وَيَقُولُونَ مَتَىٰ هُوَ قُلْ عَسَىٰ أَن يَكُونَ قَرِيبًا يَوْمَ يَدْعُوكُمْ فَتَسْتَجِيبُونَ بِحَمْدِهِ وَتَظُنُّونَ إِن لَّبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيلًا﴾

 ‘‘এবং তারা বলে, আমরা যখন হাড় ও মাটি হয়ে যাবো তখন কি আমাদের আবার নতুন করে সৃষ্টি করে উঠানো হবে? এদেরকে বলো, তোমরা পাথর বা লোহা হয়ে যাও অথবা তার চেয়েও বেশী কঠিন কোনো জিনি, যার অবস্থান তোমাদের ধারণায় জীবনী শক্তি লাভ করার বহুদূরে (তবুও তোমাদের উঠানো হবেই)। তারা নিশ্চয় জিজ্ঞাসা করবে, কে আমাদের আবার জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনবে? বলো, যিনি প্রথমবার তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনিই দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করবেন। তারা মাথা নেড়ে নেড়ে জিজ্ঞাসা করবে, আচ্ছা, তাহলে এটা কবে হবে? বলো, সে সময়টা হয়তো নিকটেই এসে গেছে। যেদিন তিনি তোমাদের ডাকবেন, তোমরা তার প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করতে করতে তার ডাকের জবাবে বের হয়ে আসবে এবং তখন তোমাদের এ ধারণা হবে যে, তোমরা অল্প কিছুক্ষণ মাত্র এ অবস্থায় কাটিয়েছো’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৪৯-৫২)

শারহুত্ তাহাবীয়ার ব্যাখ্যাকার উপরোক্ত আয়াতগুলো ব্যাখ্যায় বলেন, হে প্রিয় পাঠক! তাদের প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাব যে রকম বিস্তারিতভাবে দেয়া হয়েছে, তাতে আপনি চিন্তা করুন। তারা প্রথমে বলেছে, আমরা যখন হাড় ও মাটি হয়ে যাবো তখন কি আমাদের আবার নতুন করে সৃষ্টি করে উঠানো হবে? এ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে, তোমরা যদি ধারণা করে থাকো যে, তোমাদের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই এবং তোমাদের কোনো রবও নেই, তাহলে তোমরা কেন এমন সৃষ্টিতে পরিণত হয়ে যাওনা, যার কোনো মৃত্যু নেই? যেমন মজবুত পাহাড় এবং লোহা কিংবা তোমাদের ধারণায় এর চেয়ে অধিক মজবুত কোনো সৃষ্টি।

অতএব তোমরা যদি বলো যে, আমরা হচ্ছি এমন সৃষ্টি, যা চিরস্থায়ী হয় না, তাহলে তোমাদের সৃষ্টিকর্তার মাঝে এবং তোমাদেরকে মৃত্যুর পর পুনরায় নতুন করে সৃষ্টি করার মাঝে কোন জিনিস প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালো?

উপরের দলীলটি অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। তোমাদেরকে যদি পাথর, লোহা অথবা এর চেয়ে অধিক শক্ত কোনো বস্তু হতেও সৃষ্টি করা হতো, তাহলেও তিনি তোমাদেরকে নিঃশেষ করতে ও তোমাদের শরীরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে সক্ষম। শুধু তাই নয়; তোমাদের শরীরকে এক অবস্থা হতে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন করতেও তিনি সক্ষম। মানুষের শরীরের হাড় এবং অন্যান্য বস্তু শক্ত হওয়া সত্ত্বেও যিনি একে নিঃশেষ ও মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে সক্ষম, তাকে এর চেয়ে কম কিছু করতে কিসে অক্ষম করতে পারে? অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, কাফেররা আরেকটি প্রশ্ন করে থাকে। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, কে আমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করবে? বিশেষ করে যখন আমাদের দেহসমূহ পচে যাবে এবং মাটির সাথে মিশে যাবে, তখন কে আমাদেরকে পুনরায় জীবিত করবে? আল্লাহ তা‘আলা তাদের জবাব এভাবে দিয়েছেন যে,

قُلِ الَّذِي فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ

‘‘বলো, তিনিই তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন, যিনি প্রথমবার তোমাদের সৃষ্টি করেছেন’’ (সূরা বনী ইসরাঈল:৫১)।

যখন তাদের উপর এই দলীল কায়েম হয়ে গেল এবং তার হুকুম কবুল করে নেয়া আবশ্যক হয়ে গেলো, তখন তারা অন্য একটি প্রশ্ন করলো। তারা বললো, কিয়ামত কখন প্রতিষ্ঠিত হবে? তখন তাদের জবাবে বলা হয়েছে, অবাক হবার কিছুই নেই, সে সময়টা হয়তো নিকটেই এসে গেছে।


[1]. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৭৬০৪।