আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী ভূমিকা (المقدمة) শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান ১ টি

بسم الله الرحمن الرحيم

সৃষ্টিজগতের প্রভু ও প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার জন্য সমস্ত প্রশংসা। তিনি আমাদেরকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তার তাওহীদ বাস্তবায়ন করার আদেশ করেছেন এবং তার আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদের মুখাপেক্ষী নন; বরং আমরাই তার মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَنْ يُطْعِمُونِ (৫৭) إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ﴾

‘‘আমি জিন এবং মানবকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোনো রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাই না। আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং প্রবল শক্তিধর ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা আয যারিয়াত: ৫৬-৫৮)
তাওহীদ (একত্ব) এর দিকে আহবান করা এবং ইখলাস (একনিষ্ঠতা) এর সাথে তার ইবাদত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলগণকে পাঠিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,


﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ﴾

‘‘তোমার পূর্বে আমি যাকেই রসূল হিসাবে প্রেরণ করেছি, তাকে আদেশ প্রদান করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত করো’’। (সূরা আল আম্বীয়া: ২৫)


وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له ولو كره المشركون، وأشهد أن محمدًا عبده ورسوله إلى الناس أجمعين، صلى الله عليه وعلى آله وأصحابه الذين هاجروا وجاهدوا وصبروا والذين آووا ونصروا وسلم تسليما كثيرًا إلى يوم الدين.

অতঃপর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ  নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তার কোনো শরীক নেই। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে থাকে।
আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রসূল। তিনি তাকে সমস্ত মানুষের জন্য প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার উপর, তার পরিবারের উপর এবং তার ঐসব সাহাবীর উপর সালাত (দরুদ) ও সালাম বর্ষণ করুন, যারা তার সাথে হিজরত করেছে, জিহাদ করেছে এবং ধৈর্যধারণ করেছে। সে সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা তার ঐসব আনসার সাথীর উপরও সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন, যারা তাকে মদীনায় আশ্রয় দিয়েছে ও তাকে সাহায্য করেছে। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অজস্র শান্তির ধারা বর্ষিত হোক। আমীন
অতঃপর, পরিশুদ্ধ আকীদার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করা এবং তার দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক বিষয়। কেননা এর উপরই আমলের বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাদের অনুসারীগণ সর্বপ্রথম আকীদা সংশোধনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সে সঙ্গে তারা ঐসব বিষয় থেকেও সতর্ক করেছেন, যা মানুষের আকীদাকে নষ্ট করে অথবা তাকে ত্রুটিযুক্ত করে।
কুরআনুল কারীমের আয়াতগুলোতে এ দিকটির প্রতিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দাওয়াতে মানুষের আকীদা-বিশ্বাস সংশোধনের গুরুত্ব দিতেন সবচেয়ে বেশি।
মক্কায় ১৩ বছর অবস্থান করে মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং ইবাদতকে আল্লাহর জন্য খালেস-একনিষ্ঠ করার আহবান জানিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা যখন তার জন্য মক্কা বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন, তখন তিনি সর্বপ্রথম কাবাঘরের মূর্তিগুলো ভাঙতে শুরু করলেন এবং সেটার নিশানা-চিহ্ন মুছে ফেলতে লাগলেন। সে সঙ্গে তিনি ইখলাসের সাথে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার হুকুম করলেন। তিনি এক, অদ্বিতীয় এবং তার  কোনো শরীক নেই।


এ উম্মতের আলেমগণ তাদের পরিশ্রমের বিরাট অংশ আকীদা সংশোধনের জন্য ব্যয় করেছেন, তারা এ উদ্দেশ্যেই জিহাদ করেছেন, উম্মতের লোকদেরকে ইহা শিক্ষা দিয়েছেন এবং এর উপর অনেক বই-পুস্তক লিখেছেন। তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আকীদা ও তাওহীদের কিতাবসমূহ ইসলামী পাঠাগারের বিরাট স্থান দখল করেছে। পাঠাগারের কিতাবগুলোর তালিকার সূচনাতেই রয়েছে আকীদার বইগুলোর নাম।
তাই এ বিরাট কাজে আমার সামান্য শ্রম ব্যয় করার ইচ্ছা পোষণ করে কিতাবটি লেখার কাজে হাত দিলাম। কিতাবটি আমি পাঠকদের সামনে পেশ করছি। এতে আমি নতুন কিছু সংযোজন করিনি। নির্ভেজাল তাওহীদ ও সহীহ আকীদাকে ভালোভাবে বুঝার জন্য এ সংক্রান্ত কিছু ভুলভ্রান্তি পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। সে সঙ্গে বর্তমান সময়ের মানুষ সহীহ আকীদার ক্ষেত্রে যে ভুল-ভ্রান্তির চর্চা করছে এখানে সেদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, যাতে করে মানুষের কাছে এগুলোর হুকুম পরিষ্কার হয়ে যায় এবং যারা ভুল-ভ্রান্তিতে লিপ্ত রয়েছে, তাদের কাছে সেসব ভুল-ভ্রান্তি পরিষ্কার হয়। এতে সম্ভবত তারা সত্যের দিকে ফিরে আসবে এবং অন্যদেরকে এ দিকেই ফিরে আসার নছীহত করবে। আশা করা যায় যে, তারা সতর্ক হবে।  
আমি এ কিতাবের বিষয়গুলো দীনের ইমাম ও মুসলিমদের আলেমগণের কিতাব থেকে সংগ্রহ করেছি। যেমন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া, তার ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম, ইমাম ইবনে কাছীর, শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব এবং তার ছাত্রদের মধ্য থেকে যারা তাওহীদ ও আকীদা সংশোধন-সংস্কারের দাওয়াতে আত্মনিয়োগ করেছেন, তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে আমি কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যা ফাতহুল মাজীদের উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছি। সুতরাং আমি দাবি করছি না যে, আমি এতে নতুন কিছু নিয়ে এসেছি। আমি কেবল কিছু জানা বিষয়কে পাঠকদের বোধশক্তির কাছাকাছি করেছি মাত্র। যখনই কোনো বিষয় বর্ণনা করেছি, তখন সুযোগ বুঝে সেগুলোকে বর্তমান সময়ের মানুষের বাস্তব অবস্থার সাথে মিলিয়ে দিয়েছি মাত্র।


এ কিতাবের মূল বিষয়গুলো সৌদি আরব থেকে প্রচারিত আল-কুরআনুল কারীম রেডিওর বিভিন্ন ইলমী মজলিসে প্রচার করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার তাওফীক না হলে বিষয়গুলো কিতাব আকারে প্রকাশ পেতো না। সে সঙ্গে কতিপয় দীনি ভাই আমার কাছে এগুলোকে একত্র করে সাজিয়ে-গুছিয়ে বই আকারে প্রকাশ করার প্রস্তাবও করেছেন। ইনশা-আল্লাহ এগুলো দ্বারা মানুষ দীর্ঘদিন উপকৃত হবে এবং এর কল্যাণ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার দিকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে অবদানও রাখতে পারবো। বিশেষ করে যখন দীনের সঠিক দাওয়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা বিরাজ করছে, আকীদা সংশোধনের দাওয়াত না দিয়ে অনেক দাঈ যখন তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি বেশী গুরুত্ব প্রদান করছে এবং বলতে গেলে আকীদার বিষয়গুলো ছেড়েই দিয়েছে, তখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে এ বিষয়ে বই-পুস্তক লেখার গুরুত্ব আরো বেশী হয়ে দাড়িয়েছে।
বর্তমান সময়ে অনেক দাঈ লোকদেরকে বিভিন্ন সমাধিস্থল ও মাযারে শিরকে আকবার, বিদআত ও কুসংস্কারে ডুবে থাকতে দেখে এবং গোমরাহীর আহবানকারীদেরকে মূর্খ ও সাধারণ মানুষদের উপর জয়লাভ করতে দেখেও তা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা না করে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত রয়েছে। অথচ গোমরাহী ইমামগণ অজ্ঞ মানুষগুলোকে অলী-আওলীয়াদের কবর ও মাযারের দিকে টেনে নিচ্ছে। অলীদের কবরগুলোকে মানুষের জন্য উৎসবের স্থানে পরিণত করছে, তাদের বিবেক-বুদ্ধি ও ধন-সম্পদ নিয়ে খেল-তামাশা করছে। এসব ভ- অন্যায়ভাবে অজ্ঞ লোকদের স্বঘোষিত নেতা হয়েছে এবং তারা আলেম ও আল্লাহর অলী হওয়ার দাবি করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করছে।


আফসোসের বিষয় হলো, বর্তমানে এমন অনেক দাঈ রয়েছে, যারা আকীদা সংশোধনের দিকে কোনো গুরুত্ব দেন না। তাদের কেউ কেউ বলে থাকেন, লোকদেরকে তাদের নিজ নিজ আকীদার উপর বহাল থাকতে দাও এবং তাদের কাজের প্রতিবাদ করতে যেয়ো না। লোকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করো এবং তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করো না। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, لنجتمع على ما اتفقنا عليه وليعذر بعضنا بعضا فيما اختلفنا فيه অর্থাৎ যে বিষয়ে আমরা সকলেই একমত তার উপর ঐক্যবদ্ধ হবো এবং যাতে আমরা মতভেদ করেছি, তাতে আমরা পরস্পরকে ছাড় দিবো। তারা এ রকম অন্যান্য বাক্যও বলেছেন, যা আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের সুস্পষ্ট বিরোধী। উল্লেখ্য যে, এখানে তারা যে ঐক্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তা দ্বারা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করাকে বুঝিয়েছেন। আর যাতে উম্মত মতভেদ করেছে বলে উল্লেখ করেছেন, তা দ্বারা তারা আকীদা ও তাওহীদকে বুঝিয়েছেন। তাদের কথা সম্পূর্ণ বাতিল।
আসল কথা হলো, আকীদার ক্ষেত্রে উম্মতের প্রথম যুগের আলেমগণ মোটেই মতভেদ করেননি এবং এক্ষেত্রে কোনো মতভেদ গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,


﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, আনুগত্য করো রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা শাসক (কর্তৃত্বশীল ও বিদ্বান) তাদেরও। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তার রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাকো। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম’’। (সূরা আন নিসা: ৫৯)
আমাদের সকলের জেনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের দিকে ফিরে যাওয়া এবং তার বিরোধীতা বর্জন করা ব্যতীত মুসলিমদের ঐক্য ও শক্তি অর্জন হওয়ার কোনো আশা নেই। বিশেষ করে আকীদার বিষয়ে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরী। কেননা এটিই তাদের দীনের মূল বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,


﴿وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا﴾

 ‘‘তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জুকে মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না। (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)
মদীনার ইমাম মালেক ইবনে আনাস রহিমাহুল্লাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বর্ণনা করেছেন। এটি একটি বিরাট কথা। মুসলিমদের উচিত কথাটি ভালোভাবে বুঝা এবং তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। তিনি বলেছেন,


لا يَصْلُحُ آخِرُ هذه الأمةِ إلا بما صَلَحَ به أوَّلُها

‘‘এ উম্মতের প্রথম যুগের লোকেরা যার মাধ্যমে সংশোধিত হয়েছে, তা ব্যতীত শেষ যুগের লোকদের সংশোধন হওয়া অসম্ভব।
আল্লাহ তা‘আলাই সঠিক পথের তাওফীক দাতা, তিনিই সঠিক পথের সন্ধান দাতা।

وصلى الله وسلم على نبينا محمد و آله وصحبه

দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তার পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের উপর।

ড. সলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান