প্রশ্ন-৭৫ : কিছু ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর জনৈক ছাত্রের ফাতওয়ায় কিছু মুসলিম অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করেছে, এর বিধান কী?

উত্তর : আমার ধারণা মতে কোন মুসলিম কখনও অমুসলিমের বন্ধুত্ব-অভিভাবকত্ব গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু তোমরা অপরের বন্ধুত্ব-অভিভাবকত্ব গ্রহণের বিষয়টিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছ। আর যদি বাস্তবেই তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে তাহলে হয় সে জাহিল (মূর্খ) নতুবা মুসলিমই নয় বরং মুনাফিক। মুসলিম ব্যক্তি কখনও কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারে না।

তবে অনেক কাজ রয়েছে যেগুলোকে তোমরা বন্ধুত্ব মনে করো কিন্তু বাস্তবে সেগুলো বন্ধুত্ব নয়। যেমন কাফিরদের সাথে ক্রয়-বিক্রয় করা। তাদেরকে উপঢৌকন দেয়া। তাদের হাদিয়া গ্রহণ করা ইত্যাদি জায়েয। এ কাজগুলো বন্ধুত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং এগুলো দুনিয়াবী লেনদেন ও কল্যাণকর কাজের বিনিময় মাত্র। যেমন কাফিরকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরাতের সময় আব্দুল্লাহ ইবনে উরাইকিত্ব আল-লাইছীকে মাদীনার পথপ্রদর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। অথচ সে তখনও কাফির ছিল। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল রাস্তা সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার দ্বারা ফায়দা হাসিল করা।

এমনিভাবে প্রয়োজন হলে মুসলিম ব্যক্তির জন্যও কাফিরের শ্রমিক হিসেবে কাজ করা বৈধ। কেননা এর দ্বারা তো শুধু সেবার বিনিময়ই উদ্দেশ্য। এগুলো মাহাববাত-ভালোবাসার অন্তর্ভুক্ত নয়। পিতা কাফির হলেও সন্তানের জন্য তার সাথে সদাচার করা ওয়াজিব। এটাও মহাববতের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং এগুলো সৎ কাজের বিনিময় মাত্র। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

{ لا تَجِدُ قَوْماً يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ}

তুমি পাবে না আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন জাতিকে, যারা ভালবাসে আল্লাহ ও তার রসূলের বিরুদ্ধাচারীদেরকে- হোক না সে তাদের পিতা। (সূরা আল মুজাদালাহ আয়াত নং ২২)

কিন্তু তাদের সদাচরণ করা হবে এটা দুনিয়াবী কল্যাণকর কাজ এবং পিতার অনুগ্রহের বিনিময়। এমনিভাবে মুসলিম ও কাফিরদের মাঝে সংঘটিত সন্ধি ও নিরাপত্তা চুক্তি বন্ধুত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। আরো অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলোকে কতিপয় জাহিল ব্যক্তি বন্ধুত্ব বলে ধারণা করে। অথচ তা বন্ধুত্ব নয়।[1]

যদি মুসলিমগণ মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে তা মুকাবিলা করার জন্য কাফিরদের দ্বারস্থ হয় তাহলে এটাকে বন্ধুত্ব বলা হবে না এবং এটা চাটুকারিতার অন্তর্ভুক্তও হবে না। বরং এটা মুদারাহ বা দ্বারস্থ হওয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে। মুদাহানাহ বা চাটুকারিতা ও মুদারাহ বা দ্বারস্থ হওয়ার মাঝে পার্থক্য হলো: আল মুদারাহ জায়েয আর আল মুদাহানাহ জায়েয নয়। কেননা মুদারাহ হলো যদি কোন মুসলিম অথবা মুসলিমদের উপর বিপদ-আপদ পতিত হয় এবং সে তা দূর করতে চেষ্টা করে এবং কাফিরেরা সেই বিপদ দূর করিয়ে দেয়। এটা মুদাহানাহ বা তোষামোদী এবং বন্ধুত্বের অন্তর্ভুক্ত হবে না।

এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করার জন্য ফিক্বহ বা সূক্ষ্ম ইলমের প্রয়োজন। ইলম ছাড়াই কাফিরদের সাথে সকল কাজকে মু‘আলাত বা বন্ধুত্ব-অভিভাবকত্ব বলে তাফসীর করা ভুল ও মূর্খতা। এ কাজ জনগণকে ধোঁকা-প্ররোচনা দেয়ার শামিল।

সারকথা : আহলে ইলম ফক্বীহগণ ছাড়া অন্য কেউ এ ব্যাপারে অনধিকার চর্চা করতে পারবে না। কোন প্রাথমিক ছাত্র এবং ইসলাম সম্পর্কে অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তি এ ব্যাপারে নাক গলাতে পারবে না। তারা তো আন্দাজে কথা বলে, হারামকে হালাল বানায় এবং হালালকে হারাম বানায়। জনগণের উপর অপবাদ আরোপ করে। তারা শারঈ হুকুম না জেনেই বলে যে এটা মুওয়ালাত বা বন্ধুত্বের অন্তর্ভুক্ত। এটা বরং ব্যক্তির নিজের জন্যই বড় ক্ষতিকর। কেননা সে ইলম ছাড়াই আল্লাহর ব্যাপারে কথা বলছে।[2]


[1]. যারা নিজেদেরকে দাঈ, পরামর্শদাতা ও নেতা হিসাবে দাঁড় করাতে চান, কাফেরদের সাথে চুক্তি, লেনদেন ইত্যাদি ব্যাপারে তাদের ভূমিকা কী? তাদের সাথে লেনদেন বিষয়ে বিভিন্ন দলীল ও নবীজীবনীর ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী?

তারা দুই ধরনের: হয় তারা মূর্খ, না হয় এসব ব্যাপারে তারা জ্ঞান রাখেন। মূর্খ হলে নেতৃত্বে যাওয়ার আগে তাদের শিখে নেয়া জরূরী। আর জ্ঞানী হলে তাদেরকে আমরা বলবো, আল্লাহকে ভয় করুন, জনগণকে হক টা বলুন। প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না।

[2]. আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে ইলম ছাড়া কথা বলা খুবই মারাত্মক এবং ভয়াবহ পাপ। এ পাপ শিরকের চেয়েও বড় পাপ।  আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالأِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَاناً وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ

বল, আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ- যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের শরীক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর উপরে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না। (সূরা আল-আ‘রাফ আয়াত নং ৩৩)

এ আয়াতে অপেক্ষাকৃত ছোট গুনাহের পর তার চেয়েও বড় গুনাহের আলোচনা বিন্যস্ত রয়েছে।

আল্লাহর সাথে শিরক স্থাপন করা বড় পাপ কিন্তু উল্লেখিত অপেক্ষাকৃত বড় পাপের ধারাবাহিকতায় শিরকের পরে যে ব্যক্তি আল্লাহর ব্যাপারে বানিয়ে  কথা বলে তার কথা উল্লেখিত হয়েছে। এর কারণ হলো আল্লাহর ব্যাপারে বানিয়ে কথা বলার দ্বারা ব্যক্তি শুধু আল্লাহর সাথে শরীক বা সমকÿ দাবিদারই হয় না বরং নব শরী‘আতের উদ্ভাবক ও প্রবর্তক হয়ে যায়। না‘উযুবিল্লাহ।