৩.৯ সিয়ামের সুন্নাত আদব - ২৫. প্রত্যেক ইবাদতেরই কিছু আদব কায়দা ও শিষ্টাচার রয়েছে, সিয়ামের আদবগুলো কী কী?

সিয়াম পালনের কিছু মুস্তাহাব বা সুন্নাত আদব আছে যেগুলো পালন করলে সাওয়াব বেড়ে যাবে। আর তা ছেড়ে দিলে রোযা ভঙ্গ হবে না বা গোনাহও হবে না। তবে পুণ্যে ঘাটতি হবে, কিন্তু তা আদায় করলে সওয়াবের পরিপূর্ণতা আসে। নিম্নে এসব আদব উল্লেখ করা হলো:

১. সাহরী খাওয়া - রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“তোমরা সাহরী খাও, কারণ সাহরীতে বরকত রয়েছে।” (বুখারী: ১৯২৩, মুসলিম: ১০৯৫)

“আমাদের (মুসলিমদের) ও ইয়াহুদী-নাসারাদের সিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরী খাওয়া।” (মুসলিম: ১০৯৬) অর্থাৎ আমরা সিয়াম পালন করি সাহরী খেয়ে, আর ইয়াহুদী নাসারারা রোযা রাখে সাহরী না খেয়ে ।

 “মুমিনের সাহরীতে উত্তম খাবার হলো খেজুর।” (আবু দাউদ: ২৩৪৫)

“(রোযাদারদের জন্য) সাহরী হলো একটি বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরী খাওয়া বাদ দিও না। এক ঢােক পানি পান করে হলেও সাহরী খেয়ে নাও। কেননা সাহরীর খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন।” (আহামদ- ৩/১২)।

২. সাহরী দেরী করে খাওয়া: অর্থাৎ তা শেষ ওয়াক্তে খাওয়া উত্তম। রাতের শেষাংশে গ্রহণকৃত খাবারকে সাহরী বলা হয়।

৩. সাহরীর সময়কে ইবাদতের কাজে লাগানো: প্রতিরাতের শেষ তৃতীয়াংশ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আরশ থেকে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। আর বান্দাদেরকে এই বলে আহ্বান করেন,

“এখন যে ব্যক্তি আমার কাছে দু'আ করবে আমি তা কবুল করব, যা কিছু আমার কাছে এখন চাইবে আমি তাকে তা দিব এবং যে আমার কাছে এখন মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দিব।” (বুখারী: ৬৩২১, মুসলিম: ৭৫৮)

অতএব, তখন কুরআন অধ্যয়ন, তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদের সালাত আদায়, তাওবাহ-ইস্তিগফার ও দু'আ কবুলের জন্য এক উত্তম সময়। তাদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন, “তারা শেষ রাতে জেগে উঠে তাওবাহ-ইস্তিগফার করে।” (সুরা ৫১; যারিয়াত ১৮)।

৪. সূর্য অস্ত যাওয়ামাত্র ইফতার করা: তাড়াতাড়ি ইফতার করা। অধিক সাবধানতার নামে ইফতার বিলম্ব না করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“মানুষ যতদিন পর্যন্ত তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে।” (বুখারী: ১৯৫৭, মুসলিম: ১০৯৮)

“যতদিন মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন দীন ইসলাম বিজয়ী থাকবে। কেননা, ইয়াহূদী ও নাসারাদের অভ্যাস হলো ইফতার দেরীতে করা।” (আবু দাউদ: ২৩৫৩ হাদীসটি হাসান)

“তিনটি বিষয় নাবী চরিত্রের অংশ: সময় হওয়ামাত্র ইফতার করে ফেলা, সাহরী শেষ ওয়াক্তে খাওয়া এবং সালাতে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা।” (সহীহুল জামে', আরো দেখুন মাজমাউয যাওয়ায়িদ ১০৫; তাবরানী)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীগণ সকলের আগে তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন এবং সকলের চেয়ে দেরিতে সাহরী খেতেন। (মুসান্নাফ আঃ রাযযাক)

৫. খেজুর বা পানি দ্বারা ইফতার করা- আনাস (রা.) বলেছেন,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (মাগরিবের) সালাতের পূর্বে তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর পাওয়া না যেত তবে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। আর যদি শুকনা খেজুর পাওয়া না যেত তাহলে কয়েক ঢােক পানি দ্বারা ইফতার করতেন।” (আহমাদ- ৩/১৬৪) তবে পেট ভর্তি করে খাওয়া ইসলাম সমর্থন করে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“যে ব্যক্তি পেট ভর্তি করে খানা খায় তার ঐ পেট (আল্লাহর কাছে) একটি নিকৃষ্ট পাত্র।” (তিরমিযী: ২৩৮০) সুন্নাত হলো, পেটের তিন ভাগের একভাগ খাবার খাবে, আর তিন ভাগের একভাগ পানি পান করবে। বাকি এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রেখে দেবে।(তিরমিযী)

৬. ইফতারের সময় দুআ করা: এ মুহূর্তটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়ার সময়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“ইফতারের সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর এ মুক্তি দানের পালা রমযানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে। সে সময় সিয়াম পালনকারী প্রত্যেক বান্দার দুআ কবুল হয়।” (আহমাদ)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন,
“হে আল্লাহ! তোমার জন্য রোযা রেখেছি, আর তোমারই রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।” উল্লেখ্য যে, আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী উপরিউক্ত হাদীসটিকে দুর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
 
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইফতারের সময় নিম্নের এ দু'আটি পাঠ করতেন,

إِذَا أَفْطَرَ قَالَ: ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ

“পিপাসা নিবারিত হলো, শিরা-উপশিরা সিক্ত হলো এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কারও নির্ধারিত হলো।” (আবু দাউদ: ২৩৫৭ দারাকুতনী, বাইহাকী, আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন) ইফতারের সময় যখন আযান হয় তখন আযানের পরের সময়টা দু'আ কবুলের সময়। হাদীসে আছে আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের দু'আ কবুল হয়।

৬. বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা, সালাত আদায়, যিকর ও দুআ করা। রমযান যেহেতু কুরআন নাযিলের মাস সেহেতু এ মাসে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন অন্য সময়ের চেয়ে বেশি করা উচিত। রাসূলুল্লাহ বলেছেন,

“সিয়াম ও কুরআন কিয়ামতের দিন (আল্লাহর কাছে) মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, সিয়াম বলবে, হে রব! দিনের বেলায় আমি তাকে পানাহার ও যৌন উপভােগ থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর।” কুরআনও বলবে, হে রব! (রাতে কুরআন পাঠের কারণে) রাতের নিদ্রা থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই এ পাঠকের ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ মঞ্জুর কর। তিনি বলেন, অতঃপর উভয়েরই সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।(আহমাদ- ৬৫৮৯)

৭. ইবাদতের তাওফীক কামনা ও আল্লাহর দয়া অনুধাবন করা- আমরা যে ইবাদত করি তাও আল্লাহর দয়া। তিনি যে এ কাজে আমাদেরকে তাওফীক দিয়েছেন সেজন্য আমরা তার শুকরিয়া আদায় করি। অনেকের ভালো কাজও আবার কবুল হয় না।আল্লাহ তাআলা বলেন,
“কেবলমাত্র মুত্তাকীদের কাজই আল্লাহ কবুল করেন।” (সূরা ৫; মায়িদাহ ২৭) ভয় ও আশা নিয়ে যেন আমরা ইবাদত করি। গর্ব-অহঙ্কার ও হিংসা বান্দার ইবাদতকে নষ্ট করে দেয় এবং কুফরী ও শির্ক করলে তার কোন নেকই আল্লাহর কাছে পৌছে না বরং ইবাদতসমূহ ধ্বংস ও বাতিল হয়ে যায়।

৮. ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা - তাদেরকে যাকাত, ফিত্রা ও সাদাকাহ দেওয়া। হাদীসে এসেছে:

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমযানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত।” (বুখারী: ৪৯৯৭, মুসলিম: ২৩০৮)
 
৯. উত্তম চরিত্র গঠনের অনুশীলন করা- রমযান ধৈর্যধারনের মাস। আর সিয়াম হলো এ কার্য প্রশিক্ষণের ইনিস্টিটিউট। কাজেই এ সময় আমাদেরকে সুন্দর চরিত্র গঠনের অনুশীলন করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোযা রাখে, সে যেন তখন অশ্লীল কাজ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। রোযা রাখা অবস্থায় কেউ যদি তার সাথে গালাগালি ও মারামারি করতে আসে সে যেন বলে, ‘আমি রোযাদার’।” (মুসলিম: ১১৫১)

১০. অপচয় ও অযথা খরচ থেকে বিরত থাকা- খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আরাম-আয়েশে অনেকেই অপচয় ও অপব্যয় করে থাকে। এটা এক গর্হিত কাজ। এ থেকে বিরত থাকা।

“নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা ১৭; ইসরা ২৭)

১১. রুটিন করে সময়টাকে কাজে লাগানো- অহেতুক কথাবার্তা, আডডা বাজি, গল্প-গুজব, বেহুদা তর্কবিতর্ক পরিহার করা। রুটিন করে পরিকল্পনা ভিত্তিক কাজ করা। এতে জীবন অধিকতর ফলপ্রসূ হবে।

১২. দুনিয়াবী ব্যস্ততা কমিয়ে দেওয়া- রমযানের এ বরকতময় মাসে অর্থ উপার্জন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়ে আখিরাতের মুনাফা অর্জনের জন্য অধিকতর বেশি সময় দেওয়া আবশ্যক। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর আখিরাত চিরস্থায়ী। আল্লাহ তাআলা বলেন,  “আর আখিরাতের জীবন সর্বোত্তম এবং চিরস্থায়ী।' (সূরা ৮৭; আ'লা ১৭)

১৩. খাওয়া ও নিদ্রায় ভারসাম্য রক্ষা করা- কেউ কেউ এত বেশি খাবার খায় যে নাস্তা ও দুপুরের খাবার শুধু ইফতারের এক বেলায়ই পুষিয়ে নেয়। আবার তারাবীহ ও সেহরীর ওয়াক্তের দ্বিগুণ দিনের বেলায় ঘুমিয়ে তা কাযা করে। এভাবে চললে খাবার ও ঘুমের কুরবানী হলো কীভাবে? তাই এ বিষয়ে রোযাদারকে ত্যাগ-তিতিক্ষা করতে হবে এবং এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সিয়াম পালন করে যেতে হবে।

১৪. ফজর উদয় হওয়ার পূর্বেই রোযার নিয়ত করা।

১৫. আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা- রমযানের পবিত্র দিন ও রাতগুলোতে ইবাদত করার তাওফীক দেওয়ায় মাবুদের প্রশংসা করা ।