২.১২ জামাআতে সালাত (জামাআতের হুকুম) - ২৬. জামাআতে সালাত আদায়ের হুকুম কী?

সালফে সালেহীন একদল আলেমের মতে ফরজ সালাত জামাআতের সাথে আদায় করা হুশ জ্ঞানসম্পন্ন প্রত্যেক বালেগ সক্ষম পুরুষের জন্য ফরজে আইন, এমনকি সফরে থাকলেও। অপর আরেক দল আলেমের মতে জামাআতে নামায ওয়াজিব। কেননা, জামাআতে সালাত আদায়ের নির্দেশ কুরআনে এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

“তোমরা সালাত আদায় কর ও যাকাত দাও এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর (অর্থাৎ জামাআতের সাথে সালাত আদায় কর)।” (সূরা ২; বাকারা ৪৩)। আর যারা জামাআতে সালাত আদায় করবে না তাদেরকে শাস্তির হুঁশিয়ারী দেওয়া হয়েছে। এর দলীল হিসেবে উলামায়ে কেরাম এ আয়াতটি উল্লেখ করেছেন,

“যেদিন (যাবতীয়) রহস্য উদঘাটিত হয়ে পড়বে, তখন তাদের সাজদাবনত হওয়ার আহ্বান জানানো হবে, এসব (হতভাগ্য) ব্যক্তিরা (কিন্তু সেদিন সাজদা করতে) সক্ষম হবে না, (সেদিন) তাদের দৃষ্টি নিম্নগামী হবে, অপমান তাদের ভারাক্রান্ত করে রাখবে; (দুনিয়ায়) যখন তাদের (আল্লাহর সম্মুখে) সাজদা করতে ডাকা হয়েছিল, (তখন) তারা সুস্থ (সক্ষম) ছিল।” (সূরা ৬৮; কলম ৪২-৪৩)

হাশরের মাঠে আল্লাহ যখন সিজদা করতে বলবেন, তখন (জামাত তরককারীরা) সিজদা করতে পারবে না। তাদের পিঠ বাকা করতে পারবে না।(বুখারী: ৪৯১৯)। হাদীসে এ বিষয়ে অনেক তাকিদ দেওয়া হয়েছে। তন্মধ্যে:

(১) জামাআতে সালাত আদায় যেমন আল্লাহর নির্দেশ, তেমনি রাসূলেরও নির্দেশ। তিনি বলেছেন, “যখনই সালাতের সময় হবে তখনই তোমাদের কেউ একজন আযান দিবে এবং তোমাদের মধ্যকার বয়োজ্যাষ্ঠ ব্যক্তিকে ইমাম বানিয়ে (জামাআতের সাথে) সালাত আদায় করবে।” (বুখারী: ৬২৮)। আর রাসূলের এ নির্দেশ জামাআতে সালাত ওয়াজিব প্রমাণ করে।

(২) বিপরীতে যারা জামাআতে হাজির হয় না তাদের বাড়ি-ঘর রাসূলুল্লাহ (স) আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতেন। (বুখারী: ৬৪৪)

(৩) অন্ধ ব্যক্তিকেও জামাত ত্যাগ করার অনুমতি রাসূলুল্লাহ (স.) দেননি। একবার উম্মে মাকতূম নামে এক অন্ধ লোক নবীজিকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি একজন অন্ধ লোক। ঘরটিও আমার দূরে, আমাকে পথ দেখিয়ে যে চালায় সেও ঠিকমতো কথা শুনে না। অতএব, আমি কি (জামাআতে না এসে) নিজ ঘরে সালাত আদায় করতে পারি? রাসূলুল্লাহ (স.) প্রশ্ন করলেন, তুমি কি আযান শুনতে পাও? সাহাবী উম্মে মাকতুম বললেন, হা। জবাবে রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন, তোমার জন্য কোন অনুমতির সুযোগ দেখছি না (অতএব, জামাআতে শরীক হতেই হবে)। (আবু দাউদ: ৫৫২)।

(৪) আযান শুনতে পেয়েও বিনা উযরে মসজিদে এসে জামাআতে শরীক না হলে তার সালাত হবে না (ইবনে মাজাহ: ৭৯৩)। সৌদি আরবের খ্যাতনামা মুফতী শেখ ইবনে বায (রহ) বলেন, তার সালাত পরিপূর্ণ হবে না; অপূর্ণাঙ্গ থাকবে।

(৫) জামাআতে সালাত আদায় না করা মুনাফেকীর লক্ষণ।(মুসনাদে আহমাদ- ২/২৯৩)

(৬) আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা) বলেছেন, কোন মুসল্লি ফজর ও এশার জামাআতে না এলে তার সম্পর্কে আমরা খারাপ ধারণা করতাম। (অর্থাৎ সে মুনাফিক কি-না এ সন্দেহ করতাম)। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা- ১/৩৩২)।

(৭) জামাত ত্যাগকারীদের অন্তরে আল্লাহ খতম (সিল) মেরে দেন। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, জামাত ত্যাগ করার বিষয়ে তোমরা সতর্ক থেকো। কেননা, জামাআতে সালাত আদায় না করলে আল্লাহ তাদের দিলে মোহর মেরে দিবেন। ফলে তারা গাফেলদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবে।(ইবনে মাজাহ: ৭৯৪)

(৮) জামাত ত্যাগকারীদের উপর শয়তানের আধিপত্য বিস্তার হয়। আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, লোকালয়ে হোক বা বনে-জঙ্গলে হোক কমপক্ষে তিনজন লোক একত্রে বসবাস করলেও তারা যেন জামাআতে সালাত আদায় করে। তা না হলে শয়তান তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করবে। (আবু দাউদ: ৫৪৭)

(৯) আযান হওয়ার পর উযর ছাড়া জামাআতে শরীক না হয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়া হারাম। (মুসলিম)।

(১০) জামাআতে কে কে এলো না, রাসূলুল্লাহ (স.) তা অনুসন্ধান করতেন। (আবু দাউদ: ৫৫৪) এতে প্রতীয়মান হয় যে জামাআতে সালাত ওয়াজিব ।

(১১) এতদসঙ্গে সাহাবায়ে কেরামেরও এ বিষয়ে ‘ইজমা' যে জামাআতে সালাত আদায় ওয়াজিব। (তিরমিযী: ২১৭)।

(১২) কেউ যদি দিনগুলোতে রোযা রাখে, আর রাতগুলোতে সালাত আদায় করে, কিন্তু জুমুআ ও জামাআতে না আসে তবে সে জাহান্নামের আগুনের বাসিন্দা। (তিরমিযী: ২১৮ দুর্বল)

(১৩) যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের আক্রমণের মুখেও জামাআতে সালাত আদায় রহিত ছিল না।(সূরা ৪; নিসা ১০২)

(১৪) ফজর ও এশার জামাআতে যারা হাজির হয় না তাদেরকে এ অনুপস্থিতি মুনাফেকীর লক্ষণ হিসেবে হাদীসে চিহ্নিত হয়েছে।

(১৫) সাহাবী ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, মানুষকে দু’জন লোকের কাঁধে ভর করে হাঁটিয়ে এনে (জামাআতের) কাতারে খাড়া করানো হতো। (মুসলিম)

(১৬) সালফে সালেহীনদের কেউ কেউ জামাত ছুটে গেলে কাঁদতেন, অন্যেরা তাকে সান্ত্বনা দিতো।

(১৭) সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব বলেন, সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেও কোন দিন তার (জামাত ছুটেনি) তাকবীরে উলা ছুটেনি। পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত সালাতে কোন দিন কারো পিঠ দেখেননি অর্থাৎ প্রথম কাতারে তিনি সালাত আদায় করেছেন, কারো পিছনে নয়।

(১৮) ইবনে জামাআহ বলেন, যেদিন তার মা মারা যান, সেদিনটিতে ছাড়া চল্লিশ বছরেও তার কোন দিন তাকবীরে উলা ছুটেনি।

(১৯) যারা মসজিদে জামাআতে আসতো না মক্কার এককালীন আমীর আত্তাব বিন উসাইদ উমাযী তার গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেন।

(২০) আজও কাবার দেশে আযান দেওয়ার সাথে সাথে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, ইউনিভার্সিটি, অফিস, আদালত, কলকারখানা ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। লোকেরা তখন দলে দলে মসজিদে জামাআতে শরীক হয়।