শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১ টি
কুরায়শ ও ‘আরবদের জ্ঞানগত শির্কী কর্ম

কাহিনদের কাছে ভাগ্য জানার জন্য যাওয়া : তৎকালের আরবের জনগণ কাহিন (Diviner)[1] বা (গণক), আররাফ (Fortune teller)[2]ও জ্যোতির্বিদদের (Astrologer)[3] কথায় বিশ্বাস করতো এ ধারণার ভিত্তিতে যে, এরা গায়েব সম্পর্কে কম-বেশী জ্ঞান রাখে। সে জন্য তারা যা বলে তা অনেকটা সত্য হয়ে থাকে। এরা সবাই মানুষের ভাগ্য ও অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে মন্তব্য করতো, শর‘য়ী দৃষ্টিতে কারো ব্যাপারে অদৃশ্য সম্পর্কে অবহিত থাকার ধারণা করা শির্ক। সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের কাছে যাওয়া ও তাদের কথায় বিশ্বাস করা থেকে মু’মিনদের বারণ করে বলেন :

«مَنْ أَتَى كَاهِنًا، أَوْ عَرَّافًا، فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ»

‘‘যে ব্যক্তি কোন কাহিন তথা গণক অথবা ভবিষ্যত বক্তার কাছে গেল এবং সে-যা বলে তা বিশ্বাস করলো, সে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার সাথে কুফরী করলো।’’[4]

জ্যোতির্বিদদের সম্পর্কে তিনি বলেন :

«مَنْ اقْتَبَسَ عِلْمًا مِنَ النُّجُومِ، اقْتَبَسَ شُعْبَةً مِنَ السِّحْرِ زَادَ مَا زَادَ»

‘‘যে ব্যক্তি জ্যোতির্বিদ্যা অর্জন করলো সে যেন জাদু বিদ্যার একটি অংশ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করলো, যে যত বেশী জানলো সে তত বেশী জাদু বিদ্যা অর্জন করলো।’’[5]

সে সময়ের কাহিনরা ছিল জিন সাধক। জিনের সহযোগিতায়ই তারা মানুষের ভাগ্য ও অদৃশ্যে সংঘটিত হওয়া বিষয়াদি সম্পর্কে কথা বলতো। জিনরা উর্ধ্বাকাশে যেয়ে ফেরেশতাদের কথোপকথন শুনার জন্য ওৎ পেতে বসে থাকতো। কখনও একটি কথা শুনলে এর সাথে একশ’টি মিথ্যা কথা মিশিয়ে তাদের বন্ধু কাহিনের কাছে এসে বলতো।[6] এভাবে জিনদের সহযোগিতায় তারা পার্থিব দিক দিয়ে উপকৃত হতো। আর জিনরা সাধারণ জনমনে কাহিনদের ব্যাপারে অদৃশ্য সম্পর্কে জানার শির্কী ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে দিতে পারাকেই নিজেদের জন্য উপকার হিসেবে গণ্য করতো। জিনরা যে ফেরেশতাদের কথা শুনার জন্য উর্ধ্বাকাশে যেতো সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন- জিনেরা বলে :

﴿ وَأَنَّا لَمَسۡنَا ٱلسَّمَآءَ فَوَجَدۡنَٰهَا مُلِئَتۡ حَرَسٗا شَدِيدٗا وَشُهُبٗا ٨ وَأَنَّا كُنَّا نَقۡعُدُ مِنۡهَا مَقَٰعِدَ لِلسَّمۡعِۖ فَمَن يَسۡتَمِعِ ٱلۡأٓنَ يَجِدۡ لَهُۥ شِهَابٗا رَّصَدٗا ٩ ﴾ [الجن: ٨، ٩]

‘‘আমরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করে তা কঠোর প্রহরী ও উল্কাপিন্ড দ্বারা পরিপূর্ণ দেখতে পেয়েছি। আমরা আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সংবাদ শ্রবণার্থে বসতাম। এখন কেউ সংবাদ শুনলে সে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডকে ওৎ পেতে থাকতে দেখে।’’[7]

কাহিন ও জিনদের পরস্পরের দ্বারা উপকৃত হওয়া ও আখেরাতে তাদের কী পরিণতি হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :

﴿ وَيَوۡمَ يَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا يَٰمَعۡشَرَ ٱلۡجِنِّ قَدِ ٱسۡتَكۡثَرۡتُم مِّنَ ٱلۡإِنسِۖ وَقَالَ أَوۡلِيَآؤُهُم مِّنَ ٱلۡإِنسِ رَبَّنَا ٱسۡتَمۡتَعَ بَعۡضُنَا بِبَعۡضٖ وَبَلَغۡنَآ أَجَلَنَا ٱلَّذِيٓ أَجَّلۡتَ لَنَاۚ قَالَ ٱلنَّارُ مَثۡوَىٰكُمۡ خَٰلِدِينَ فِيهَآ إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۗ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٞ ١٢٨ ﴾ [الانعام: ١٢٨]

‘‘যে দিন আমি সকলকে একত্রিত করবো, সেদিন জিনদেরকে লক্ষ্য করে বলবো : হে জিনসকল শুনো : তোমরা মানুষদের দ্বারা অতিমাত্রায় উপকৃত হয়েছো, (তখন) তাদের মানুষ বন্ধু (কাহিনরা) বলবে : হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা পরস্পরের দ্বারা উপকৃত হয়েছি, আমাদের জন্য আপনি যে সময় নির্ধারণ করে রেখেছিলেন, আমরা সে সময়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। তাদের এ কথার জবাবে আল্লাহ বলবেন : জাহান্নামই তোমাদের চিরস্থায়ী আবাস স্থল, তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক খুবই বিজ্ঞ ও জ্ঞানী।’’[8]

>
[1]. কাহিন বলা হয় সে ব্যক্তিকে যে গোপন তথ্যাদি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানার দাবী করে এবং সে অনুযায়ী ভবিষ্যতে কার ভাগ্যে কী ঘটবে, সে সম্পর্কে জনগণকে আগাম সংবাদও দিয়ে থাকে। দেখুন : আল-জুরজানী, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৮৩; সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী আরেকটু বাড়িয়ে বলেন : ‘‘এদের কেউ কেউ দাবী করে যে, তাদের আনুগত্যকারী একটি জিন রয়েছে, আর সে জিনই তাদেরকে গোপন খবরাদি সরবরাহ করে।’’ দেখুন : সফিয়্যুর রহমান আল-মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৮।

[2]. আর-রাফ : এ ব্যক্তিও একধরনের গণক। কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ বা কারো কোন কাজ বা অবস্থা থেকে আগাম কিছু বিষয়াদি ও কারণ জানার মাধ্যমে গোপন জিনিষের স্থান সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করে। দেখুন : সফিয়্যুর রহমান আল-মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩৮।

[3]. ‘মুনাজ্জিম’ বলা হয় সে ব্যক্তিকে, যে তারকারাজির গতিবিধি ও স্থানসমূহ লক্ষ্য করে এর মাধ্যমে সে ভবিষ্যতে জগতের অবস্থাদি ও ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে জানতে চায়। দেখুন : মুল্লাহ ‘আলী আল-কারী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ; (মুলতান : মাকতাবাহ ইমদাদিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ২/২, ৩।

[4]. ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ২/৪০৮, ৪২৯, ৪৭৬।

[5]. আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; কিতাবুত ত্বিব, বাব : তারকারাজী সম্পর্কে রাসূল যা বলেন; ৪/২২৬।

[6]. ইবনে কাছীর, তাফসীরুল ক্বুরআনিল ‘আযীম; ২/৫৬৮।

[7]. আল-কুরআন, সূরা জিন : ৯, ১০।

[8]. আল-কুরআন, সূরা আন‘আম : ১২৮। শেখ আব্দুর রহমান ইবন হাসান আলুশ্ শায়খ, ফতহুল মাজীদ; (লাহুর : আনসারুস সুন্নাতিল মুহাম্মদিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), পৃ. ২৯৮।