শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী ১ টি
‘আরব জনপদে উল্লেখযোগ্য মূর্তিসমূহ

আরবের লোকেরা ছোট এবং বড় বিভিন্ন রকমের মূর্তিদেরকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মূর্তি নিম্নরূপ :

লাত :

এটি ‘ত্বায়েফ’ নামক স্থানের ‘ছক্বীফ’ গোত্রের প্রসিদ্ধ এক দেবী মূর্তির নাম। এর মাধ্যমে তারা কুরায়েশ গোত্রের উপর গর্ব করতো। ইমাম ইবনে কাছীর এর বর্ণনা মতে এটি ছিল একটি সাদা পাথরের মূর্তি। এর মধ্যে একটি ঘরের চিত্র অংকিত ছিল। কা‘বা ঘরের ন্যায় এটিকে তারা পর্দা দ্বারা আবৃত করে রেখেছিল। অনুরূপভাবে তারা কা‘বা শরীফের প্রাঙ্গণের ন্যায় এর প্রাঙ্গণকেও পবিত্র জ্ঞান করতো। ছক্বীফ গোত্র থেকেই এর খাদেম নিয়োগ করা হতো। ইমাম ইবনে জারীর এর বর্ণনা মতে তারা ‘আল্লাহ’ শব্দের স্ত্রী লিঙ্গ হিসেবে এর নাম ‘লাত’ রেখেছিল।[1] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, সেখানে সুদূর অতীতে একটি চারকোণা বিশিষ্ট পাথরে বসে একজন ইয়াহূদী ব্যক্তি হাজীদের জন্য ‘সাতু’ তৈরী করে খেতে দিত। লোকটি সেখানে মৃত্যুবরণ করলে তার সততা ও ভাল কর্মের জন্য লোকেরা এ-পাথরকে সম্মান করে এর পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করতে আরম্ভ করে।[2] কুরায়েশ এবং সমগ্র আরব গোত্রের লোকেরাও একে পূজা ও সম্মান করতো।[3]

উযযা :

‘উয্যা’ নামের এ দেবীটি মক্কার নিকটবর্তী ‘নাখলাহ’ নামক স্থানে স্থাপিত ছিল। এটা কুরায়েশ গোত্রের দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়মাপের দেবতা ছিল।[4] কুরায়েশরা কা‘বা শরীফের হরমের ন্যায় এর জন্যও একটি হরম (পবিত্র এলাকা) নির্ধারণ করেছিল। সম্ভবত এটি ছিল কুরায়েশদের যুদ্ধের দেবী। তাদের সাথে কারো যুদ্ধ হলে তারা এ দেবীর কাছে যুদ্ধে জয় কামনা করতো। সে জন্যই উহুদ যুদ্ধের সময় আবূ সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিমদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন : ‘‘আমাদের উয্যা দেবতা আছে, তোমাদের কোনো উয্যা নেই।’’[5] মূলত এ দেবতাটি ছিল বত্নে নাখলাহ নামক স্থানের তিনটি ছোট বাবলা গাছের সমষ্টি।[6] এ গাছগুলোতে একটি মহিলা জিন থাকতো। এর উপাসকরা তা বুঝতে না পারলেও এ জিনই এর উপাসকদেরকে এ গাছের মধ্য থেকে অলৌকিকভাবে শব্দ শুনাতো।[7] মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদ ইবন আল-ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে তা ধ্বংস করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তিনি পর পর তৃতীয় গাছটি কাটতে উদ্যত হলে আকস্মিকভাবে সে জিনটি ঘাড়ে হাত রেখে, দাঁত কটমট করে, এলোমেলো কেশে কুৎসিত হাবশী মহিলার আকৃতিতে আত্ম প্রকাশ করে। খালেদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তরবারী দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করলে তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে হঠাৎ একটি কবুতরে রূপান্তরিত হয়ে মরে যায়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ফিরে এসে সর্বশেষ গাছ কাটতে গিয়ে তিনি যা দেখলেন তা তাঁকে জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তা শুনে বললেন :

«تِلْكَ الْعُزَّى وَ لاَ عُزَّى بَعْدَهَا لِلْعَرَبِ»

‘‘এ হাবশী মহিলাই মূলত ‘উয্যা’ ছিল, আরবদের জন্য এরপর আর কোন উয্যা থাকবে না।’’[8] অপর এক বর্ণনামতে উয্যা নামের এ দেবীটি একটি সাদা পাথর ছিল।[9]

মানাত :এটি প্রাচীন দেব-দেবীদের মাঝে অন্যতম একটি দেবীর নাম। সম্ভবত এটি ছিল কুরবানীর দেবী। এর নামে পশুর রক্ত প্রবাহিত করা হতো।[10] এটাকে ভাগ্যদাতা ও মৃত্যুদানকারী বলে মনে করা হতো।[11] মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী ‘কুদায়েদ’ নামক স্থানে এটি স্থাপিত ছিল। হজ্জ উপলক্ষে ‘ইয়াসরিব’ তথা মদিনার আওস এবং খযরজ গোত্রদ্বয়ের লোকেরা এসে এর চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করতো।[12] এতে (শয়তানের পক্ষ থেকে নিযুক্ত) একটি মহিলা জিন থাকতো এবং এ জিনই এর পূজারীদেরকে নানা রকম অলৌকিক কর্মকাণ্ড করে দেখাতো। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে সা‘য়ীদ ইবন যায়দ আল-আশহালী রাদিয়াল্লাহু আনহু এ মূর্তিটি ধ্বংস করতে যান। এ সময় সে জিনটি কালো বর্ণের একটি মহিলা আকৃতিতে উলঙ্গ অবস্থায় এলোমেলো কেশে আত্মপ্রকাশ করে নিজের জন্য ধ্বংসের আহ্বান করে বুক চাপড়াতে ছিল। সা‘য়ীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে এ অবস্থাতেই হত্যা করেন।[13]

>
[1]. ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ৪/২৫।

[2]. তদেব।

[3]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৮; ইবনে জারীর আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২৭/৫৯।

[4]. ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/৮৪; ড. ফারুক হামাদাহ, আল-ওয়াসিয়্যাতুন নববীয়্যাহ; (আল-মাগরিব : দারুছ ছেক্বাফাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ১৬।

[5]. মাওলানা সয়ৈদ সুলায়মান নদভী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪১৮।

[6]. ড. হাসান ইব্রাহীম হাসান, তারীখুল ইসলাম; (কায়রো : মাকতাবাতুন নাহদাতিল মিশরিয়্যাঃ, ১৪ সংস্করণ, ১৯৯৬ খিষ্টাব্দ.), পৃ. ৬১; মাওলানা সৈযদ সুলায়মান নদভী, তারীখু আরদিল ক্বুরআন; (করাচী : দারুল এশা‘আত, ১ম সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ৪২০; ইবনে জারীর আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২৭/৫৯।

[7]. ইবনুল জাওযী, প্রাগুক্ত ; পৃ. ৬৮।

[8]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৮-১৬৯; আল-মুবারক পূরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪০৯-৪১০।

[9]. وقال آخرون كانت العزى حجرا أبيض وقال آخرون كان بيتا بالطائف تعبده ثقيف -দেখুন : ইবনে জারীর আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২৭/৫৯।

[10]. মাওলানা সৈয়দ সুলায়মান নদভী, তারীখু আরদিল কুরআন; (করাচী : দারুল এশা‘আত, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), পৃ. ৪১৮।

[11] . তদেব।

[12] . তদেব।

[13]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪১০; -আত-ত্ববারী, আবু জা‘ফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর, প্রাগুক্ত ; ২৭/৫৯।