পক্ষান্তরে যার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে, সে যদি অসংশোধনীয় ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে তার থেকে দূরে থেকো এবং তার গায়ে পড়া বন্ধুত্ব গ্রহণ করো না। কোন ওজুহাতে তার জীবন থেকে সরে পড়। বিশেষ করে মুখ ও আহমক বন্ধু মোটেই পছন্দ করো না। কারণ, এমন বন্ধু হল আগুনের মত; তোমাকে জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলবে। মুখের মুখামি যখন মাথায় চড়ে, তখন তা আর কোন আত্মীয়তা, কোন ভালোবাসা অথবা প্রতিবেশ ইত্যাদির হকের খেয়াল রাখে না। সব কিছুকে ভুলে গিয়ে নিজের স্বভাব মত মুখামি করেই তৃপ্তি পায় মূখ মানুষ। তাতে তার বন্ধুর অপমান হলে সে কি করতে পারে? তার তো স্বাভাবিক আচরণ এটা।

অতএব দুশমন হলেও জ্ঞানীর সাহচর্য গ্রহণ করো, তবুও কোন আহম্মককে বন্ধু করে তোমার সংসর্গ দিও না। নচেৎ দেখবে, তুমি পাবে। মহান আল্লাহ তার খাস বান্দাদের বিভিন্ন গুণ বর্ণনার সময় তাদের একটি বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, “যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, 'সালাম।” (সূরা ফুরকান ৬৩ আয়াত) অথাৎ, তারা তাদের মূর্খামির সাথে জড়িয়ে না পড়ে তাদেরকে উপেক্ষা করে ও এড়িয়ে চলে।

আহাম্মক বন্ধু অনেক সময় মনের আবেগবশে বন্ধুর উপকার করার নিয়তে এমন কাজ করে বসে, যাতে প্রকৃতপ্রস্তাবে বন্ধুর অপকারই সাধিত হয়। আবার সেই উপকারের কোন প্রশংসা বা বদলা না পেলে সে কথা অপরের কাছে গেয়েও বেড়ায়। ফলে এমন বন্ধুর বন্ধুত্বে। ক্ষতি হয় দ্বিগুণ। এমন বন্ধু কখনো বাত ভালো করতে গিয়ে কুষ্ঠরোগ সৃষ্টি করে ফেলে। আবার কখনো বা সাপ মারতে ছিপ ভেঙ্গে বসে থাকে। এমন বন্ধু অকারণে রাগ করে, খামাখা আড়ি পাতে ও অভিমান করে, অপ্রয়োজনে কথা বলে, অযথা খরচ করে, প্রত্যেকের উপর আস্থা রাখে এবং অপকারী ও উপকারীর মাঝে পার্থক্য নির্বাচন করতে পারে না। সুতরাং এমন মিত্রের মিত্রতায় যে ঠকতে হবে, তা বলা নিষ্প্রয়োজন।

আর এ জন্যই বলা হয় যে, তিনটি জিনিস যদিও ঘটে, তবুও সত্বর অপসৃত হয়; মেঘের ছায়া, মিথ্যা সুনাম ও জ্ঞানী-অজ্ঞানীর বন্ধুত্ব। খবরদার! কোন অসদাচারীকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। করে ফেললে তাকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কর। সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে তার দুনিয়া থেকে দুরে সরে যাও। বেনামাযী, মদ্যপায়ী, ধূমপায়ী, বিদআতী, ব্যভিচারী ও চোরা প্রকৃতির বন্ধুর বন্ধুত্ব গ্রহণ করো না। এমন বন্ধুর সঙ্গ পরিত্যাগ কর, যে দ্বীনদার লোক দেখে নাক সিটকায়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, কুমন্তব্য করে। আর জেনে রেখো যে, খল বন্ধুর চেয়ে শত্রু অনেক গুণ ভালো।

এমন বন্ধুর বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন-ভিন্ন করে দাও, যে পাপ করে তোমার কাছে অথবা কোন বন্ধুমহলে প্রচার করে গর্ব প্রকাশ করে অথবা নির্লজ্জ পৃষ্ট্রের মত প্রকাশ্যে পাপ করে। লারে-লাপ্পা’ করে পাড়া মাতায়, টেপ-রেডিও-টিভির অশ্লীল গান-বাজনা-ছবি প্রকাশ্যে ফুল সাউন্ডে শোনে ও শোনায়, দেখে ও দেখায়। গুপ্ত পাপীর বাঁচার পথ আছে, কিন্তু প্রকাশ্য পাপীর বাচার পথ দুর্গম। প্রিয় নবী মুক্তি বলেন, “পাপ প্রকাশকারী ছাড়া আমার প্রত্যেক উম্মত ক্ষমাহ।” (বুখারী ৬০৬৯, মুসলিম ২৯৯০ নং)

এমন পাপাচার ও দুরাচার থেকে দূর না হতে পারলে জেনে রেখো, ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। সঙ্গ দোষে কি না হয়? ছুঁচো ছুঁলে গন্ধ হয়। শারাব খানায় বসলে বা আসা-যাওয়া করলে লোকে তোমাকে শারাবী বলবে; যদিও তুমি শারাব না খাও। তাছাড়া আজ নয় তো কাল শারাবের উগ্র গন্ধ তোমাকেও পাগল করে ফেলবে। অবশেষে তুমিও হয়তো শারাবীতে পরিণত হয়ে যাবে।

অতএব 'দুর্জনেরে পরিহারি, দুরে থেকে সালাম করি’ এমন বন্ধুর বন্ধুত্বকে কবর দিয়ে দাও। এমন বন্ধু থেকে শতবার আল্লাহর নিকট পানাহ চাও এবং সে জন্য অর্থ সহ ‘কুল আউযু বিরাব্বিন্নাস’ বার বার পাঠ কর।

অসৎ বন্ধুর বন্ধুত্ব গ্রহণ করে কাল কিয়ামতে পস্তাতে হবে। “সেদিন অত্যাচারী নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায়! আমি যদি রসূলের সাথে পথ অবলম্বন করতাম! হায়! দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার নিকট উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিল। আর শয়তান মানুষকে বিপদকালে ধোকা দেয়।” (সূরা ফুরকান ২৭-২৯ আয়াত)।

হে মুসলিম যুবক! মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে তাকে তুমি ভয় করে থাক। অতএব তোমার প্রিয়তম বন্ধু তিনিই এবং তাঁর বন্ধু তুমি। সুতরাং সে বন্ধুর কোন শত্রু তোমার বন্ধু। হতে পারে না। কারণ, প্রকৃতপক্ষে সে তোমারও শত্রু। মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না----।” (সূরা মুমতাহিনাহ ১ আয়াত) তোমার প্রিয়তম সুমহান বন্ধুকে যে বিশ্বাসই করে না, সে তোমার বন্ধু কিরূপে হতে পারে? “হে বিশ্বাসিগণ! বিশ্বাসিগণের পরিবর্তে অবিশ্বাসিগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।” (সূরা নিসা ১৪৪ আয়াত) তোমার শ্বাশত ধর্ম ও অম্লান নৈতিকতাকে যে মানতে চায় না এবং উল্টে তা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে, তাকে তুমি কিরূপে নিজের অন্তরঙ্গ বন্ধু করতে পার? “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পূর্ববর্তী সেই গ্রন্থপ্রাপ্ত (ইয়াহুদ ও নাসারা)গণ, যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলার বস্তুরূপে গ্রহণ করেছে, তাদেরকে ও কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। যদি তোমরা ঈমানদার হও, তাহলে আল্লাহকে ভয় কর।” (সূরা মাইদাহ ৫৭ আয়াত)

বস্তুতঃ “তুমি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় পাবে না, যারা আল্লাহ ও তার রসুলের বিরুদ্ধাচারীগণকে ভালোবাসে, যদিও সে (বিশ্বাসী) তাদের পিতা অথবা পুত্র, ভ্রাতা অথবা একান্ত আপনজন কেউ হয়----I” (সূরা মুজাদালাহ ২২ আয়াত) সুতরাং যে তোমার নিজের কেউ নয়, সে বিরুদ্ধাচারী তোমার ভালোবাসার কোন পাত্র?

হ্যাঁ, আর নৈতিকতার খাতিরেই তুমি কোন যুবতীর সহিত বিবাহের পূর্বে কোন প্রকারের বন্ধুত্ব করতে পার না। বিবাহের পরই সে তোমার পরমা বান্ধবী। আমল এক হলে সে ইহকাল ও পরকালে চিরকাল তোমার চিরসঙ্গিনী হয়ে থাকবে।

জেনে রেখো বন্ধু। আজ যাকে তুমি ভালোবাসবে কাল কিয়ামতের বিভীষিকাময় দিনে তারই সঙ্গে অবস্থান করতে হবে। যদি কোন খেলোয়াড়কে ভালোবাস, তাহলে সেই খেলোয়াড়ের সাথে, যদি কোন শিল্পী বা হিরোকে ভালোবাস, তাহলে সেই শিল্পী বা হিরোর সাথে, যদি কোন দ্বীনদার লোককে ভালোবাস, তাহলে সেই দ্বীনদার লোকের সাথে এবং কোন কাফেরকে ভালোবেসে থাকলে, সেই কাফেরের সাথে তোমার হাশর হবে। আর সেখানে তাদের যে অবস্থা হবে, তোমারও অবস্থা হবে অনুরূপ। সুতরাং বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা গড়ার সময় সে কথাও মনে রেখো। প্রিয় নবী স. বলেন, “মানুষ যাকে ভালোবাসবে (কিয়ামতের দিন) সে তারই সাথে অবস্থান করবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৫০০৮ নং)

যুবক বন্ধু! এবারে তোমাকে সেই কথাই বলি, যে কথায় বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। যাতে তুমি সহজে একজন বন্ধু লাভ করতে পার এবং তুমিও অপরের বন্ধুতে পরিণত হতে পার। বন্ধুত্বের প্রথম সোপান সাক্ষাতে সালাম দেওয়া। সালাম দেওয়ার মাধ্যমে কায়েম হয় সম্প্রীতি, হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে উভয়ের প্রতি উভয়ের ভালোবাসা। (মুসলিম ৫৪নং) এরপর গাঢ় পরিচয়, সুন্দর ব্যবহার, সাক্ষাতে সুমিষ্ট হাসি, উপটৌকন, উপহার ও দুআ বিনিময় ইত্যাদি।

এক ব্যক্তি মহানবী (সা.) এর নিকট এসে আরজ করল, 'হে আল্লাহর রসূল! আমাকে এমন একটা কাজ বলে দিন, যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষেও আমাকে ভালোবাসবে।' প্রিয় নবী ও বললেন, “দুনিয়ার মায়া ত্যাগ কর, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন৷ আর মানুষের হাতে যা কিছু আছে (অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি) তার প্রতি বিরাগ। প্রকাশ কর, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।” (ইবনে মাজাহ ৪১০২, সহীহুল জামে ৯২২ নং)। মানুষ চায় না যে, তার কাছে কেউ কিছু চাক। অতএব তুমি কোন মানুষের কাছে চাইলে তার মন সঙ্কুচিত হবে এবং তুমি তার নিকট থেকে তা না পেলে তোমার মনও ছোট হবে। এর ফলে ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হতে পারবে না। অন্যথা ঋণ, সাহায্য ইত্যাদি না। চাইলে অনায়াসে তুমি তার ভালোবাসার পাত্র হতে পারবে।

পক্ষান্তরে চারটি জিনিস ভালোবাসা সৃষ্টি করে; স্মিতমুখে সাক্ষাৎ, উপকার সাধন, সহমত অবলম্বন এবং কপটতা বর্জন। আর যার মুখ মিষ্টি তারই বন্ধু বেশী। খেয়াল রেখো যে, বন্ধুত্বের খাতিরে যা কিছু করছ, তার বিনিময়ে প্রতিদানের আশা করো । কারণ, ভালোবাসার একটি মহৎ উপায় হল, প্রতিদানে কিছু পাওয়ার আশা না করে নিঃস্বার্থভাবে কেবল ভালোবেসে যাওয়া।

আর এ কথাও মনে রেখো, অতি প্রেম যেখানে, নিত্য যেও না সেখানে৷ যাবে যদি নিত্যি, ঘটবে একটা কিত্যি। বরং অতিরঞ্জনের পথ বর্জন করে মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর। এ ব্যাপারে মহানবী মুক্তি বলেন, “(প্রত্যেক দিন সাক্ষাৎ না করে) একদিন বাদ পর দিন সাক্ষাত কর। তাতে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।” (বাযযার, ত্বাবারানী, হাকেম, সহীহুল জামে’ ৩৫৬৮ নং) প্রেমের বেদনার প্রকৃতিই এমন যে, প্রেমে বিরহের আঘাত যত বেশী পড়ে, প্রেমের ফোড়া ততই টলটলে হয়ে বেড়ে ওঠে। প্রেমাস্পদের প্রতি হৃদয়ের টান তত বেশী মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়ে মনকে ব্যাকুল করে তোলে। আর সেখান থেকে সৃষ্টি হয় প্রকৃষ্ট বন্ধুত্বের সুদৃঢ় বন্ধন।

হে যুবক বন্ধুবন্ধুত্বের পথ বড় বন্ধুর। এ পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। নয় ঝড়ঝঞ্চাহীন ও বিপদমুক্ত। কারণ, দোস্তী কুরবানী চায়। কুরবানী পেশ করতে না পারলে দোস্তীতে স্বস্তি পাওয়া যায় না। আর এখানেই হয় প্রকৃত বন্ধুর মহা অগ্নিপরীক্ষা। তাছাড়া সুসময়ে বন্ধু বটে অনেকেই হয়, অসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয়’ এই বাস্তব উদাহরণের নাম বন্ধুত্ব নয়। প্রকৃত বন্ধু হল সেই, যে বন্ধুর বিপদের সময় হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃত বন্ধু সে নয়, যে আমার দুর্নাম রটার সময় বলে, 'ও আমাদের গ্রামের একটা ছেলে। আর সুনাম প্রচারের। সময় বলে, 'ও আমার প্রাণপ্রিয় অথবা খাস বন্ধু!’ আসল বন্ধু সে নয়, যে আমার অভাবের সময় খোঁজ রাখে না। আর আমার ধনলাভের সময় এসে বলে, 'আই লাভ ইউ।' এমন কপট ও স্বার্থপর বন্ধু থেকে তোমাকে আল্লাহর পানাহ রইল।

প্রকৃত বন্ধু সে নয়, যে সামান্য মতবিরোধের ফলে বন্ধুত্বের মুলে কুঠারাঘাত হানে। উড়ো খবর ও কান-ভাঙ্গানিতে বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং বন্ধুত্বের বন্ধন-সূত্রকে ছিন্নভিন্ন করে। অথচ ঈমানের এক দাবী এই যে, বন্ধুত্বের অঙ্গীকার বন্ধু যথারীতি পালন করতে বদ্ধপরিকর থাকবে। (হাকেম ১ ১৬, সহীহুল জামে ২০৫৬ নৎ)।

প্রকৃত বন্ধু সে নয়, যে মুখের কথায় একশ ছড়ি গুনে খায়, অথচ আসলে সে ফুলের ঘায়ে মূৰ্ছা যায়। এমন বাকসর্বস্ব, ধৈর্যহীন, অদূরদর্শী বন্ধু থেকে আল্লাহ আমাকে ও তোমাকে আশ্রয় দান করুন। প্রকৃত বন্ধু তো সেই ব্যক্তি, যে পীড়িত হলে তার পীড়া দেখে তুমিও পীড়িত হও এবং তুমি পীড়িত হলে তার দর্শনলাভে ও সান্ত্বনাদানে সুস্থ হয়ে ওঠ। যে বন্ধু তোমাকে এসে বলে, ‘ইন্নী উহিব্রুকা ফিল্লাহ এবং তার প্রত্যুত্তরে তুমি তাকে বল, ‘আহাব্বাকাল্লাযী আহবাবতানী ফীহ।

ভাই যুবক! জীবনে চলার পথে বহু বন্ধুই আসে-যায় এবং মনের প্রেম-কোঠায় প্রবেশের জন্য তার সুদৃঢ় দ্বারে করাঘাত করে যায়। কিন্তু যে বন্ধু ঐ দ্বারে প্রবেশ করে মনের নিভৃত কোণে স্থায়ী আসন পেতে নিতে পারে, সেই হয় প্রকৃত বন্ধু। এমন বন্ধুই তুমি লাভ কর, এই কামনা করি।

অবশ্য আর একটি প্রকৃষ্ট বন্ধুর কথাও তোমাকে জানিয়ে রাখি, আর তা হল একটি মনের মত উপকারী বই। কোন বন্ধু না পেলে এ বন্ধু পাওয়া সাক্ষর মানুষের জন্য মোটেই কঠিন নয়। অতএব ভেবে ও খুঁজে দেখো, দেখবে এ বন্ধুর সাথে কোন দিন মনোমালিন্য ঘটবে না। ঘটবে না কোন স্বার্থপরতার মন কষাকষি। দুঃখের বিষয়, কড়ি ফটকা চিড়ে দই, কড়ি বিনে বন্ধু কই? কোন স্বার্থ ছাড়া কেবল আল্লাহ ও দ্বীনের উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব আর কে করে? খেয়াল করে দেখবে, যারাই তোমাকে বন্ধু বলে গলায় লাগাতে আসছে, তাদের অধিকাংশই তোমাকে সম্মান প্রদর্শন করলেও আসলে তোমার কি মান? তোমার শাখা-সোনার মান। অধিকাংশ বন্ধুই হল দুধের মাছি। এরা কোন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আসে, স্বার্থ উদ্ধার হলে অথবা স্বার্থে আঘাত লাগলে সরে পড়ে। যে জিনিসের জন্য সে বন্ধুরা তোমাকে ভালোবাসছিল তা তোমার কাছে না পেলে পরক্ষণে তোমাকে বিদায় জানাবে। আজ ধনবান আছ, এখন তোমার বন্ধু অনেক। কিন্তু কাল গরীব হয়ে গেলে সবাই তোমার নিকট থেকে কেটে পড়বে। আজ তোমার একটা পদ আছে বলে তোমার বন্ধুর অভাব নেই। কিন্তু কাল পদ চলে গেলে তোমার বন্ধুরাও তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে। পার্থিব স্বার্থে বন্ধুত্বের ধারা এই, রীতি এই।

আর দুনিয়ার এ রীতি বড় পুরাতন, নুতন নয়। কিন্তু তুমি তোমার বন্ধুর জন্য খাটি বন্ধু হও। সকল স্বার্থ ত্যাগ করে কেবল আল্লাহর ওয়াস্তে নিঃস্বার্থ বন্ধুরূপে পরিচয় ও প্রমাণ দাও। স্বার্থে আঘাত লাগলে ধৈর্য ধরে নাও। আর তার জন্য বন্ধুত্বের বুনিয়াদে আঘাত হেনো না। মনে রেখো, “কোন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত (পূর্ণ) মুমিন হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার ভায়ের জন্য তাই পছন্দ করেছে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।” (বুখারী ৭, মুসলিম ৪৫ নং) সাবধান! তোমার বন্ধু যে চিরদিন বন্ধু থাকবে, সে ধারণা সঠিক না-ও হতে পারে। আজ যে বন্ধু আছে কাল সে শত্রুতে পরিণত হতে পারে। সুতরাং তোমার রহস্য ও দুর্বলতার ব্যাপারে তোমাকে সতর্ক থাকা উচিত। আর এ জন্যই দূরদর্শী সমাজ-বিজ্ঞানী নবী ৯৪ বলেন, “তোমার বন্ধুকে মধ্যমভাবে ভালোবাস (অর্থাৎ, তার ভালোবাসাতে তুমি অতিরঞ্জন করো)। কারণ, একদিন সে তোমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। আর তোমার শত্রুকে তুমি মধ্যমভাবে শত্রু ভেবো। (অর্থাৎ, তাকে শত্রু ভাবাতে বাড়াবাড়ি করো না। কারণ, একদিন সে তোমার বন্ধুতে পরিণত হতে পারে।” (সুতরাং তখন তোমাকে লজ্জায় পড়তে হবে।) (তিরমিযী ১৯৯৭, সহীহুল জামে’ ১৭৮ নং)

শেখ সাদী বলেন, 'যা তোমার গোপন, তা নিজের বন্ধুকেও বলো না; যদিও সে তোমার বন্ধুত্বে খাঁটি। কারণ, বলা যায় না, কালচক্রে সে তোমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। আর অতি কদর্য অসদ্ব্যবহার বা পারতপক্ষের কোন কঠিন শাস্তি কোন শত্রুর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করো। না। কারণ, কোনদিন সে তোমার ঘনিষ্ট বন্ধুতেও বদলে যেতে পারে। সুতরাং পূর্ব হতেই সতর্ক থেকো; যাতে ভবিষ্যতে পস্তাতে না হয় এবং লজ্জিত হতেও না হয়। তিনি আরো বলেন, যে গোপনীয় কথা তুমি গোপন রাখতে চাও, তা তোমার বন্ধুকেও বলো না। কারণ, তোমার বন্ধুরও অনেক বন্ধু আছে। সেও তাদের নিকট তা প্রকাশ করতে পারে।

হ্যাঁ, আর এমনি করেই সৃষ্টি হয় মনোমালিন্য, তারপর বিচ্ছিন্নতা ও শত্রুতা। আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব হলেও কোন এক পক্ষের পাপের কারণেই উভয়ের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। মহানবী ঐ বলেন, “যখন কোন দুই ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তখন তাদের কারো একজনের কোন পাপ সংঘটন ছাড়া আল্লাহ তাদের মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করেন।” (সহীহুল জামে ৫৬০৩ নং) যুবক বন্ধু! অতএব খেয়াল রেখো, যাতে বন্ধুত্বের পর বিশেষ করে ঐ বন্ধুত্বের কারণে তোমাদের কারো দ্বারা যেন কোন পাপ সংঘটিত না হয়। সুতরাং সতর্ক দৃষ্টি রেখো, যাতে তোমার বন্ধুর কুদৃষ্টি তোমার বোন, স্ত্রী অথবা কন্যার উপর না পড়ে। মানুষ তো। আর তার মন তো মন্দপ্রবণ এবং শয়তান বড় শত্রু। বন্ধুর সহিত তোমার বন্ধুত্ব যতই গাঢ় ও নিবিড় হোক না কেন, সে গাঢ়তা ও নিবিড়তা তোমার বোন-স্ত্রী-কন্যার মনে প্লাবিত হবে কেন? জানের বন্ধু হলেও, ফিরিস্তাতুল্য চরিত্র হলেও পর্দার আয়াত তো আর মনসুখ হচ্ছে না। আর যদি তাই মনে করে পর্দার কুরআনী বিধানকে অবজ্ঞা কর, তাহলে জেনে রেখো, তোমার জানতে অথবা অজান্তে এমন কীর্তি ঘটতে পারে, যার জন্য তোমার ইহকালও বরবাদ হতে পারে এবং পরকাল ধংস তো করলেই। বন্ধু তখন বিষফোড়া হবে এবং তার গুপ্ত যন্ত্রণায় ছটফট করবে। যখন না পাবে মরণের কোন পথ, আর না-ই পাবে শান্তির কোন প্রলেপ। তাছাড়া তোমার ও তোমার বংশের দুর্নাম রটতে থাকবে এবং তখন তুমি শাক দিয়ে মাছ ঢাকতেও পারবে না। পরন্তু তোমার তো জানা আছে যে, দাইয়ুস বেহেস্তে যাবে না।

পক্ষান্তরে এ কথা দুনিয়া জানে যে, একজন দুশমন যা ক্ষতি করতে পারে, তার চাইতে অনেক গুণ বেশী করতে পারে একজন বন্ধু। শত্রুর ক্ষতির হাত থেকে সতর্ক থাকা যায়, কিন্তু। বন্ধুর ব্যাপারে তা হয় না। শত্রু পাহারা দেওয়া যায়, কিন্তু বন্ধু পাহারা দেওয়া যায় না। ফলে অসতর্ক থাকা অবস্থাতেই কাছে থেকেই বন্ধুর বন্দুক বুক ঝাঝরা করে দেয়। আবার শত্রু প্রকাশ্য হলে তার দ্বারা যত ক্ষতি হয়, বন্ধু শত্রু হয়ে গেলে তার দ্বারা ক্ষতি হয় আরো মারাত্মক, অধিক ভয়ানক।

আপন যখন পর হয় এবং বন্ধু যখন শত্রুতে পরিণত হয়ে যায়, তখনকার মর্মব্যথা যে কত নিদারুণ, কত গভীর হয়ে বন্ধুকে নিষ্পেষিত করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার আন্তরিকতা ও গাঢ়তা অনুযায়ী সেই বেদনার পরিমাণ কম ও বেশী হয়ে থাকে। বন্ধুত্বের গাঢ়তা বেশী থাকলে বেদনা ও আক্ষেপের পরিমাণ বেশী হয়ে থাকে। এত ভালোবেসে শেষে এত অবহেলার স্মৃতি ও আঘাতে হৃদয় দগ্ধীভূত হয়ে মানুষ অনেক সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু এমন দুটি জিনিস আছে, যা হারিয়ে গেলে তার জন্য কেঁদে চক্ষুদ্বয় হতে রক্তধারা প্রবাহিত করলেও তার এক দশমাংশ হকও আদায় হয় না। সে দু'টির একটি হল, যৌবন এবং অপরটি হল, বন্ধু।

আপনজন ও বন্ধুর কথায় মনে দাগ কাটে বড়। তবুও ভুলে যেতে হয়। বন্ধুর বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু বাস্তব এই যে,

‘হাড় ভাঙ্গলে জোড়া লাগে কলে আর বলে,

মন ভাঙ্গলে জোড়া লাগে না ইহ-পরকালে।

কাটা চামড়ায় জোড়া লাগে ঠিকই, কিন্তু দাগ থেকে যায়। দুশমনির সব কথাই ভুলে যেতে হয়, কিন্তু কিছু কথা আছে, যা মনে রাখতে হয়; ভুললে চলে না। আর তা হয় ভবিষ্যতের জন্য বড় শিক্ষা ও উপদেশ।

যে সব কারণে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় তার মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন অন্যতম। অনেক মানুষ আছে, যাদেরকে বাইরে ও দুরে থেকেই ভালো লাগে, ভিতরে ও কাছে এলে লাগে তার বিপরীত। আর ভাই-বোন বা ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে দূরের বন্ধু কাছে হয়, গোপন বিষয়ে খবর নেওয়ার পথ অধিক ও সূক্ষম হয়, ভুল বুঝাবুঝির মত ক্ষেত্র তৈরী হয়। ফলে সৃষ্টি হয় বিষ্ণা, কলহ ও বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের আর এক কারণ হল টাকা। তাই বন্ধুত্ব রাখতে হলে টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। নচেৎ টাকা এমন জিনিস যে, সে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারে, আবার বিচ্ছেদও। কথায় বলে, 'টাকা তুমি যাচ্ছ কোথা? পিরীত যথা। আসবে কবে? বিচ্ছেদ যবে।

এ সব ছাড়া অনেক মানুষ আছে, যারা কতটা পেলাম’ কেবল সেই হিসাব রাখে। পক্ষান্তরে কতটা দিলাম সে হিসাব রাখে না। অর্থাৎ, না পেলে হৈচৈ করে, অথচ দেওয়ার মনমানসিকতা রাখে না। এই মানুষরাই সব সময় অপর পক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে থাকে এবং নিজের ঘাড়ে দোষ নিতেই চায় না। এরা চায় আঘাত দোব, কিন্তু আঃ শুনব না। বারুদে আগুন দোব, কিন্তু বিস্ফোরণ দেখব না। এরা চায় আগুন ধরাব, আর ধূপের সুগন্ধ নেব।' এই শ্রেণীর স্বার্থপর, বিবেক ও ইনসাফহীন মানুষের সাথে যে বন্ধুত্ব রাখা বড় দায়, তা বহু অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রের জানা।

তুমি মনের মত বন্ধু পাও, বন্ধুমহলে সুখী হও, সংসার ও দ্বীন-ধর্মে উপকৃত হও এবং কিয়ামতের ছায়াহীন প্রখর রৌদ্রময় দিনে আল্লাহর ছায়া লাভ কর, মনে-প্রাণে এই কামনা করি।