নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

বনু তামীম আগে থেকেই মুসলমান হয়েছিল। কিন্তু তাদের কিছু লোক তখনও মুসলমান হয়নি। তারা জিযিয়া দিতে অস্বীকার করে এবং অন্যান্য গোত্রকেও জিযিয়া না দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে রাজস্ব কর্মকর্তা উয়ায়না বিন হিছন ৯ম হিজরীর মুহাররম মাসে ৫০ জনের একটি অশ্বারোহী দল নিয়ে অতর্কিতে হামলা করেন। তখন তারা সবাই পালিয়ে যায়। তাদের ১১ জন পুরুষ, ২১ জন মহিলা ও ৩০ জন শিশু বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হয় এবং রামলা বিনতুল হারেছ-এর গৃহে তাদের রাখা হয়। পরদিন বনু তামীমের কয়েকজন বিশিষ্ট নেতা বন্দীমুক্তির বিষয়ে আলোচনার জন্য মদীনায় আসেন। যেমন নু‘আইম বিন ইয়াযীদ, ক্বায়েস বিন হারেছ, ক্বায়েস বিন ‘আছেম, উত্বারিদ বিন হাজেব, আক্বরা‘ বিন হাবেস, হুতাত বিন ইয়াযীদ, যিবরিক্বান বিন বদর, আমর বিন আহতাম প্রমুখ (ইবনু হিশাম ২/৫৬১)। কুরতুবী ৭০ জনের কথা বলেছেন (কুরতুবী, তাফসীর সূরা হুজুরাত ৪-৫ আয়াত)। হ’তে পারে উপরোক্ত ব্যক্তিগণ ছিলেন তাদের নেতা।

তাদের দেখে তাদের নারী-শিশুরা কান্না জুড়ে দেয়। তাতে তারা ব্যাকুল হয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর কক্ষের সামনে এসে তাঁর নাম ধরে চিৎকার দিয়ে ডাকতে থাকে, اُخْرُجْ إلَيْنَا يَا مُحَمَّدُ يَا مُحَمَّدُ ‘হে মুহাম্মাদ! হে মুহাম্মাদ! বেরিয়ে এস’। এ সময় রাসূল (ছাঃ) দুপুরে খেয়ে(نَامَ لِلْقَائِلَةِ) ঘুমাচ্ছিলেন (কুরতুবী)।[1] রাসূল (ছাঃ) কোন জবাব দেননি। বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) বলেন, তখন তাদের জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন,يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّ حَمْدِى زَيْنٌ وَإِنَّ ذَمِّى شَيْنٌ فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم- ذَاكَ اللهُ تَعَالَى ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার প্রশংসাই সুন্দর এবং আমার নিন্দাই অসুন্দর। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, ওটি আল্লাহ’ (অর্থাৎ প্রকৃত প্রশংসা ও নিন্দা আল্লাহর জন্য নির্ধারিত) তিরমিযী হা/৩২৬৭। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বেরিয়ে এলেন ও তাদের সাথে কথা বললেন। এ সময় সূরা হুজুরাত ৪ ও ৫ আয়াত নাযিল হয়। যেখানে বলা হয়,إِنَّ الَّذِينَ يُنَادُونَكَ مِنْ وَرَاءِ الْحُجُرَاتِ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ- وَلَوْ أَنَّهُمْ صَبَرُوا حَتَّى تَخْرُجَ إِلَيْهِمْ لَكَانَ خَيْرًا لَهُمْ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘যারা তোমাকে কক্ষের বাহির থেকে উঁচু স্বরে আহবান করে, তাদের অধিকাংশ জ্ঞান রাখেনা’। ‘যদি তারা তোমার বের হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করত, তাহ’লে সেটাই তাদের জন্য উত্তম হ’ত’ (হুজুরাত ৪৯/৪-৫)। এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে এরূপ মন্দ আচরণ যেন কেউ ভবিষ্যতে না করে সে বিষয়ে সকলকে সাবধান করে দেওয়া হয়।

অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বনু তামীম নেতাদের সাথে বসলেন। কিন্তু তারা তাদের বংশীয় অহমিকা বর্ণনা করে বক্তৃতা ও কবিতা আওড়ানো শুরু করে দিল। প্রথমে তাদের একজন বড় বক্তা উত্বারিদ বিন হাজেব(عُطَارِد بن حَاجِب) বংশ গৌরবের উপরে উঁচু মানের বক্তব্য পেশ করলেন। তার জওয়াবে রাসূল (ছাঃ) ‘খাত্বীবুল ইসলাম’(خَطِيبُ الْإِسْلاَمِ) ছাবেত বিন ক্বায়েস বিন শাম্মাস (রাঃ)-কে পেশ করলেন। অতঃপর তারা তাদের কবি যিবরিক্বান বিন বদরকে পেশ করল। তিনিও নিজেদের গৌরবগাথা বর্ণনা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কবিতা পাঠ করলেন। তার জওয়াবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ‘শা‘এরুল ইসলাম’(شَاعِرُ الْإِسْلاَمِ) হযরত হাসসান বিন ছাবেত (রাঃ)-কে পেশ করলেন।

উভয় দলের বক্তা ও কবিদের মুকাবিলা শেষ হ’লে বনু তামীমের পক্ষ হ’তে আক্বরা বিন হাবেস(الأَقْرَع بن حَابِس) বললেন, তাদের বক্তা আমাদের বক্তার চাইতে উত্তম। তাদের কবি আমাদের কবির চাইতে উত্তম। তাদের আওয়ায আমাদের আওয়াযের চাইতে উঁচু এবং তাদের বক্তব্য সমূহ আমাদের বক্তব্য সমূহের চাইতে উন্নত’। অতঃপর তারা ইসলাম কবুল করলেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের উত্তম উপঢৌকনাদি দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন। অতঃপর তাদের বন্দীদের ফেরৎ দিলেন’।[2]

মুবারকপুরী বলেন, জীবনীকারগণ বর্ণনা করেছেন যে, এই সেনাদল ৯ম হিজরীর মুহাররম মাসে প্রেরিত হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে স্পষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। কেননা ঘটনায় বুঝা যায় যে, আক্বরা বিন হাবেস ইতিপূর্বে ইসলাম কবুল করেননি। অথচ তাঁরা সবাই বলেছেন যে, ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত হোনায়েন যুদ্ধ শেষে গণীমত বণ্টনের পর হাওয়াযেন গোত্রের বন্দীদের ফেরৎ দানের সময় বনু তামীমের পক্ষে তিনি তাদের বন্দী ফেরৎ দিতে অস্বীকার করেন। যাতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি আগেই মুসলমান হয়েছিলেন’ (আর-রাহীক্ব ৪২৬ পৃঃ টীকা ১)

এক্ষেত্রে আমাদের মন্তব্য এই যে, আক্বরা সহ বনু তামীম আগেই মুসলমান হয়েছিল বলেই তারা রাসূল (ছাঃ)-এর পক্ষে হোনায়েন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। আর সেকারণেই তাদের কাছ থেকে জিযিয়া ও যাকাত আদায়ের দায়িত্ব উয়ায়না বিন হিছনকে দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের কিছু লোক যারা তখনও মুসলমান হয়নি। তারা জিযিয়া দিতে অস্বীকার করায় এবং অন্যান্য গোত্রকে জিযিয়া প্রদানের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার কারণেই তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরিত হয়েছিল। এমনও হ’তে পারে যে, আক্বরা বিন হাবেস-এর প্রচেষ্টায় উক্ত প্রতিনিধি দল মদীনায় আসে এবং ইসলাম কবুল করে। অতএব আক্বরা বিন হাবেস-এর উপরোক্ত বক্তব্য একথা প্রমাণ করে না যে, তিনি ইতিপূর্বে মুসলমান ছিলেন না।

[শিক্ষণীয় : (১) সম্মানী ব্যক্তিকে সম্মানজনক সম্বোধন করা এবং সময় ও পরিবেশ বুঝে কথা বলা উচিৎ। (২) নেতাদেরকে অত্যন্ত ধৈর্যশীল হ’তে হয় এবং সাধারণ ব্যক্তিদের ক্ষমা করতে হয়। (৩) একটি সংগঠনে বিভিন্ন মেধা ও গুণের অধিকারী মানুষ প্রয়োজন। (৪) প্রয়োজন বোধে বক্তৃতা ও কবিতা প্রতিযোগিতা করা জায়েয।]

[1]. ইবনুল ক্বাইয়িম এখানে যোহরের আগের কথা বলেছেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৪৬)। কিন্তু পূর্বাপর সম্পর্ক বিবেচনায় বিষয়টি যোহরের পরে মনে হয়। ইবনু হিশাম কোন সময়ের কথা বলেননি (২/৫৬২, ৫৬৭)।

[2]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা হুজুরাত ৪-৫ আয়াত; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৪৬; ইবনু হিশাম ২/৫৬২, ৫৬৭; তিরমিযী হা/৩২৬৭।